
গিয়েছিলাম আজিজ সুপারে, বরাবরের মতই বই ঘাটতে। ভাবের রাজ্যে পৃথিবী তাচ্ছিল্যময়। আর তাই প্রায়ই আমি বই এর দোকানে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জাতীয় বই হাতে নিয়ে চোখের কোণা দিয়ে অ্যাডভেঞ্চার আর হরর বই খুঁজতে থাকি। বিদিতে ঢুকতে গিয়েই দেখি কাঁচের মধ্যে একটা বুড়োলোক তার গোঁফ ধরে টানছে আর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করছে। চোখে তখনো আমার ভাবজের কালা পর্দা বসানো, তাই না তাকিয়ে ঢুকে গেলাম। ক্রাচের কর্ণেল বইটা নামাতে গিয়ে দেখি তখনো বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরক্ত হয়ে অন্যপাশে অ্যাসটেরিক্সের নতুন অনুবাদটা দেখতে গেলাম। অ্যাসটেরিক্সের বইটা তুলতেই আবার বৃদ্ধ। বাধ্য হয়ে হাতে নিলাম। প্রথম তিন পৃষ্ঠা পড়লাম এবং কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করলো। এই বই প্রকাশ হয়েছে ফেব্রুয়ারী ২০১১। আর এখন জুন মাস। বই মেলাতে কি আমি মাঠ ঝাড়ু দিয়েছি?? নতুবা এই বই আমার নজর এড়ায় কি করে! সাথে সাথে কাউন্টারে দিলাম। পাত্তা না দেয়ার প্রতিশোধ বৃদ্ধ ভালোই নিলো। কড়কড়ে ২০০টি টাকা দিতে হলো।
বাসায় এসে বইটি খোলা মাত্র বৃদ্ধ হাসি মুখে বললো, “বেটার লেট দেন নেভার!” কাঁচুমাচু মুখে পড়া শুরু করলাম। এক নিঃশ্বাসে (অবশ্যই এক নিঃশ্বাসে কারণ পিচ্চি বই) পড়া শেষ করে হাত বাড়ালাম তার দিকে, “আপনার সাথে পরিচিত হয়ে অনেক খুশী হলাম”। এভাবেই আমার পরিচয় হয় বাংলাদেশের প্রথম রহস্য কমিকের গোয়েন্দা মিঃ ঝাকানাকার সাথে। কমিকস যে ক্যাটাগোরিরই হোক না কেন, সাথে সাথে গিলে ফেলা আমার অভ্যাস। একবার পড়লে হয় না, বার বার পড়ি। বাংলা রহস্য কমিক বলতে পশ্চিম বঙ্গের দিকেই চেয়ে থাকতে হতো, সে আক্ষেপ আমার অনেক দিনের। গোয়েন্দা ঝাকানাকা ও জাদুঘরে চুরি রহস্য বইটি এসে আশার আলো দেখাচ্ছে বই কি।
কমিক উপন্যাসে আমার গুরু মনে হয় গোসিনি আর ইউদেরজোকে। কিছু দিক থেকে তাদের আমি হার্জের থেকেও এগিয়ে রাখি। ঝাকানাকার লেখক প্রথম পাতায় অ্যাসটেরিক্স স্টাইলেই পরিচয় দিয়ে শুরু করেছেন। তাহলে আপনাদেরকেও পরিচয় করিয়ে দেই?

গোয়েন্দা ঝাকানাকাঃ
উপমহাদেশের সবচেয়ে নামকরা গোয়েন্দা। তিনি বলেন, প্যাঁদালেই সব ঠিক।সব অভিযানে তাঁর সঙ্গী মেড-ইন-জিঞ্জিরা ষোলোঘরা ইশপিশাল রিভলভার ষোড়শী আর কিংকু চৌধারী।

কিংকু চৌধারীঃ
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দারোগা কিংকর্তব্যবিমূঢ চৌধারি ওরফে কিংকু চৌধারী।বোকাসোকা, মোটাসোটা কিংকু ভালোবাসেন সন্দেহভাজনদের ঠ্যাঙাতে।অবসরে তিনি রেডিও ঝাঞ্জাইল ছেড়ে শোনেন হাল আমলের আরজে দের ভ্যাজর ভ্যাজর আর রোমান্টিক গান।

বদরু খাঁ:
ঝাকানাকের নেমেসিস।সারা পৃথিবী জুড়ে বিদঘুটে সব অপরাধ করে চলেছে সে।ভালোবাসে ফুল, পাখি,গান আর বিটকেলপনা। হাতে তার সবসময়ের সঙ্গী দেখতে-ভয়ানক-শুনতে-ভয়ানক-শুঁকলে-পরে-আরো-ভয়ানক বারো ছররার দোয়াজদাহাম পিস্তল।
ঘটনা সংক্ষেপঃ
স্বপ্নে যখন বদরু খাঁকে ধরে ঝাকানাকা প্যাঁদাতে ব্যস্ত, তখনই বাসায় আসে কিংকু। এবারে বদরু ভয়ানক চাল চেলেছে। বিখ্যাত পন্ডিত ডঃ ইস্পাহানিকে সে কিডন্যাপ করেছে। পুলিশের ধারণা পাশের ফ্লাটের টাকার কুমির মিঃ মুনসীকে ধরতে গিয়ে ভুলে সে ডঃ ইস্পাহানিকে বাইসাইকেল দিয়ে কিডন্যাপ করেছে। কিন্তু ঝাকানাকা এর মাঝে অন্য কিছুর গন্ধ পায়। ডঃ ইস্পাহানির অবসরগ্রহণ করা সত্বেও কেন জাদুঘরে গিয়ে বসে থাকেন, তা জানতে সোজা উপস্থিত হয় জাদুঘরে। কিউরেটর ডঃআক্কাস মৃধা জানায় প্রাচীন পুঁথি রাজ-এ-পেনহাতে আলমাস বা গুপ্ত হীরার রহস্য ভেদ করার জন্য তাদের ইস্পাহানির সাহায্য প্রয়োজন হয়েছিলো। মহিয়সী বাবরের জন্য কেনা এই হীরা তার কাছে পৌঁছানোর আগেই চুরি যায়। এরপর থেকে ইতিহাস নিশ্চুপ। ঝাকানাকা জাদুঘরে থাকতে থাকতেই বের হয় যে পুঁথিটিও হাওয়া হয়েছে। গোঁফ টানতে টানতে সে তদন্ত শুরু করে। সিকিউরিটির হেড বরিশাইল্ল্যা শমশের জংএর সাথে কথা বলে ঝাকানাকা প্রথমেই টের পায়, আস্ত জাদুঘর যে এখনো চুরি যায়নি সে দেশের ভাগ্য। কারণ বিশাল কামানের সামনে তিনজন গার্ড কেন জানতে চাইলে সে বলে, “আগে দুইডা কামান আছেলে, হেইয়ার মইধ্যে বড়োডা চুরি কইরগা লইয়া গেছে ম্যানহোলের ঢাকনা চোরের দলে”। ভল্টে ধূলার রাজ্যে রহস্যজনক ভাবে লেখা থাকে আক্কাস+সুমি। কে এই সুমি? জাদুঘরের বাকি কর্মচারীদের জেরা করার ফাঁকে বের হয় এই সুমি ম্যাডাম আচুক্কা সুন্দোরি এবং মৃধা সাহেবের বড়ই আহলাদের পাত্রী। শেষ পর্যন্ত অসংখ্য আজাইরা তথ্য এবং বেয়াক্কেলে কান্ডকারখানার মাঝখান থেকে গোয়েন্দা ঝাকানাকা বদরু খাঁকে পাকড়াও করেন। তবে এর জন্য তাকে ব্যাপক ইয়া ঢিসুয়েইব আর ভিশুমাইক করতে হয় বইকি!
বইএর দ্বিতীয় পৃষ্ঠাতেই সগর্বে লেখা, ইহা একটি কালাইডোস্কোপ স্টুডিও সৃষ্টি। তাদের সাইটে গিয়ে দেখলাম, তাদের মূল মন্ত্র- আমরা সবাই কালা এই কালার রাজত্বে। এমনকি কঠিনভাবে ধলা ব্যক্তিও সেখানে গিয়ে কালা হইতে বাধ্য। এরপর দেখি ঝাকানাকা আসলে ঝাকানাকা শুরু করে দিয়েছে সেই অনেক আগেই। তাদের গোয়েন্দা ঝাকানাকা পেজটিতে ইতোমধ্যে দেড় হাজার পাবলিক লাইক দিয়ে বসে আছে।
আমার কথাঃ
টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্স এমনকি ফেলুদার কমিক্স পড়তে গিয়ে অনেকবারই মনে হয়েছে, আমাদের দেশের মত চমৎকার বই পড়ার পরিবেশ আর কোথায় আছে? এরপরো প্রিয়তে কেন কোন দেশী কমিক ক্যারেক্টার নেই? সুতরাং গোয়েন্দা ঝাকানাকাকে স্বাগতম। আজকের টিনটিন কিন্তু প্রথমে এমন ছিলো না। সোভিয়েত দেশে টিনটিন, এমনকি আমেরিকায় টিনটিন পড়লেও আপনি দেখবেন যে কতটা পরিবর্তন হয়েছে। সে তুলনায় আমি বলবো ঝাকানাকার আঁকা অনেক ভালো। বিশেষ করে ইমোশনগুলি চমৎকার ভাবে আঁকা। ডায়ালগে সুযোগ মত বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা এসেছে, সেটা পড়লে না হেসে পারা যায় না। তবে রহস্যটিকে আরেকটু ঘোড়েল করা যেতো। কাহিনীর মাঝে আরো ধড়পাকড় আনা যেত। মাত্র ৩৮ পৃষ্ঠা দেখে মন খারাপ হয়েছে। আর হতাশা আর পাইছি তোরে ইমো যতটা ভালো হয়েছে, ইউরেকা বা তদন্তের সময়ের মুখভঙ্গী ততটা আকর্ষনীয় হয়নি। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে, এটি প্রথম প্রকাশ। দিনে দিনে নিশ্চই আরো উন্নতি হবে।
*************************
এক নজরে বইটিঃ
গোয়েন্দা ঝাকানাকা ও জাদুঘরে চুরি রহস্য
ধরনঃ রঙিন রহস্য কমিক
লেখাঃ মাহবুব আজাদ
আঁকাঃ সুজন চৌধুরী
পরিবেশকঃ পাঠসূত্র
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৪০
মূল্যঃ ২০০টাকা
**************************
শেষ কথাঃ চাচা চোধরী, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট, টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্সের সাথে সাথে আমাদের দেশী কমিকসও অবশ্যই মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক। আমরাও গর্বিত হই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১১ রাত ৮:০১