বেশীর ভাগ মানুষকেই দুর্বল করে দেয়া যায় তার পোষা প্রানীটির কথা বলে। আমার এ জাতীয় সৌভাগ্য কখনো হয়নি। ছোট বেলা থেকেই পিঁপড়া থেকে শুরু করে গরু—আশে পাশের কোন প্রানীই আমাকে দেখতে পারে না। আমিও সবাইকে চরম ভয় পাই, তারাও আমাকে ভয় দেখাতে এবং জ্বালাতে ভালু পায়। এক মশা ছাড়া আমার কোন ভালো বন্ধু নেই। মশাকে বন্ধু বলছি এই কারনে যে, গবেষনায় দেখেছি; আমাকে মশা অনেক কম কামড়ায়। যখন অন্য কাউকে পায় না, তখনই শুধু আমার কাছে আসে। নতুবা আমার ধারে কাছে কেউ থাকলে ভুলেও আমার কাছে আসে না। আমার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান ভালোই, তারপরো যে কেন আসে না। মশাদের বন্ধু বানানোর অনেক ফায়দা আছে। হুমায়ূন আহমেদ মশারীর জালে জোৎস্নার ফুল ধরার চেষ্টা করে মশারীকে যতই জাতে তোলার চেষ্টা করুক, আমার কাছে তা কব্বর খানা। হলে যখন সবাই মশারী দিয়ে জড়াজড়ি করে অস্থির, আমি তখন মশারী ছাড়াই আরামে ফ্যান ছেড়ে ঘুমিয়ে আনন্দের সহিত সবার হিংসিত দৃষ্টি উপভোগ করি। তবে নিন্দুকের মতে, আমার রুম সর্বোচ্চ তলার দিকে হওয়ার কারনে মশারা যায় না। তবে আমি একে বন্ধুত্বই বলি। একবার এক থাপ্পড়ে তিনটা মশা মেরে নিজেকে তিনমার পালোয়ান বলে ঘোষনার তালে ছিলাম। ঘটনা ঘটেছে সিলেটে, জানা মতে মশাদের জাতীয় কোন পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল নেই। তারপরো ঢাকার মশারা আমার থেকে দূরেই থাকে।তবে মশা তিনটা মেরে যে ব্যাপক শান্তি পেয়েছি তার তুলনা নেই। মেরেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দিলাম, “এক চড়ে তিনটা মশা মেরেছি। মশা বাহিনী সাবধান! এসে গেছে তোদের নতুন যম”। টুশ টাশ লাইক পড়তে লাগলো। মশার জ্বালায় সবার প্রান ওষ্ঠাগত, মশাদের দুর্ভোগের গল্পে তাই দলমত নির্বিশেষে সবাই খুশী।
মশা নিয়ে অবশ্য আরেকটি কাহিনী আছে। আমার এক বন্ধু তার ছোট ভাইএর জন্য একটা ছোট অ্যাকুয়ারিয়াম কিনেছে। পিচ্চির সখ হয়েছে মাছ পোষার। তবে মাছ তো বেশীদিন বাঁচলো না, কিছুদিনের মাঝেই পটল তুললো। কিন্তু তারা পানি আর সরালো না। এক সকালে বাসার সবার ঘুম ভাংলো পিচ্চির চিল্লা চিল্লিতে, যে পানির মাঝে ছোট ছোট কিসব যেন নড়ছে। আমার বন্ধুটিও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো, দেখে সেও সহমত ব্যক্ত করলো। সবাই অত্যন্ত উত্তেজিত, পানির মাঝে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। নোবেল কমিটিকে খবর দেবে দেবে করছে এমন সময় তাদের এক মাছ বিষেশজ্ঞ বড় ভাই এসে বললো, “কি রে? এতো দেখছি মশার শূটকীট”। নোবেল প্রাইজ দূরের কথা, সিটি কর্পোরেশন শুনলে নির্ঘাত মামলা ঠুকে দিতো। একে দেশ মশার জ্বালায় বাঁচে না, সেখানে বাসার ড্রয়িং রুমে মশা চাষ হচ্ছে। তবে ছোট বেলায় বুঝি অনেকেই মশার চাষ করে। আমার নিজের এরকম কোন বদ খেয়াল কখনো হয়নি (অথবা এখনকার মতই তখনো জ়েনারেল নলেজ মাইনাসের কোঠায় ছিল), তবে আমার এক বন্ধু করতো। কেন কয়েল বা স্প্রে দিয়ে মশা মেরে ফেলা হয় এই প্রতিবাদে সে বাসার বারান্দার টবে বা সামনের ছোট বাগানে পানি ঢেলে ঢেলে পানি জমাতো, এবং সেখানে মশাদের বাড়তে দিতো। এছাড়া সে নিজের রক্তও খেতে দিতো বলে দাবী করেছে, আমার ঠিক বিশ্বাস হয়নি! একবার মাইক্রোবায়লজী ল্যাবে আমরা স্যারের মশা চাষ প্রকল্পের ভান্ড গুলো পেয়ে মহা উত্তেজিত ছিলাম। আমার একবন্ধু কৌশলে আরেকজনকে সেটা খাওয়ানোর ব্যবস্থা প্রায় করে ফেলেছিল, সেই সময়ে স্যার এসে ধমকিয়ে ভান্ড কেড়ে নিলো। অনেক দুঃখ পেয়েছিলুম। দুনিয়ায় কোন বিচার নেই।
মশাদের প্রতি আমার ভালোবাসা নেই সত্য, তবে আমি মশা মারার জন্য বৈদ্যুতিক র্যাকেট ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। এক অশুভ দুপুরে যখন আমি মোবাইলে ফার্মফ্রেঞ্জি খেলতে ব্যস্ত ছিলাম, দেখলাম আমার মা দিগবিজয়ী ভঙ্গিতে হাতে নীল রঙের এক র্যাকেট নিয়ে ঢুকলো। আমি প্রথমে ভাবলাম টেনিস খেলার র্যাকেট নাকি। আমি হা করে খানিকক্ষন চেয়ে বললাম, “এই বয়সে এখন কি টেনিস শুরু করবা নাকি?” আম্মু আমাকে পাত্তা দিলো না, “কি করতেছিস কর, সময় হলেই দেখবি!” আমি আর পাত্তা দিলাম না, ভাবলাম পিছনের বাসার ফাইয়াজের জন্য কিনে এনেছে বোধ হয়। আমাদের বাসার নিয়ম হচ্ছে সন্ধ্যার আগেই সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ করে দেয়া। কারন নেট লাগানো সত্বেও মশাগুলো আরামে ঢুকে ডুগডুগি ছাড়াই নাচে।বন্ধ করে সব রুমে স্প্রে করে ৩০ মিনিট আমাদের সবাইকে খাবার ঘরে বসে থাকতে হয়, আমার মাতা জানের হুকুম। মশার স্প্রে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। যখন আমরা ছোট ছিলাম, তখন কাজ করলেও করতে পারে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে স্প্রেতে কোন মশাকে শহীদ হতে দেখিনি। তাই ৩০ মিনিট পর যখন মশাগুলি মাতাল হয়, তখন আমার কাজ হচ্ছে সেগুলিকে খবরের কাগজ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা। এই কাজ আমি নিজেই বেছে নিয়েছি, তাতে করে সন্ধ্যাবেলায় পড়াশোনার কিছুটা সময় নষ্ট হতো। জন নিরাপত্তা মূলক কাজে বাধা দেয়ার কিছু নাই, তাই আম্মুরো অনুমোদন ছিল। ছোট বেলায় কিছু মশাকে আধমরা অবস্থায় ছেড়ে দিতুম যেন তারা অন্যদের গিয়ে খবর দিতে পারে। কিন্তু শূণ্য ঘিলু নিয়ে এরা কখনোই আমার বার্তাবাহক হয়ে উঠতে পারেনি। যাই হোক, সেদিনও আমি খবরের কাগজ হাতে রেডি কিন্তু আম্মু তো আর স্প্রে করতে আমার রুমে আসে না। কি কাহিনী জানতে গিয়ে তার রুমে গিয়ে দেখি সে বিপুল উৎসাহে বাতাসে র্যাকেট ঘুরিয়ে যাচ্ছে এবং তার মাঝ থেকে ক্যাট ক্যাট পিয়াআআআট চিয়াআআআট জাতীয় সব আওয়াজ বেরুচ্ছে। পুরো ঘরে পোড়া পোড়া এক গন্ধ।
“সর্বনাশ! কি, করতেছো টা কি তুমি?” – আমি আতংকিত হয়ে বললুম।
“সব মশার বংশ শেষ করবো আজকে!”- আম্মু ভিলেনদের মতো অট্টহাসি দিয়ে জানালো।
“মানে?”
“এই যে, র্যাকেট দেখছিস না, এখানে মশা আসলেই পুড়ে মারা যায়। স্প্রে এর দিন শেষ!”
আম্মুর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। এবার আমিও একটু উৎসাহী হলাম।
“দেখি দেখি, ব্যাপারটা কি”।
আমি বরাবরই বিশ্ব আলসি প্রতিযোগীতার প্রধান ক্যান্ডিডেট। আমি মারবো র্যাকেট ঘুরিয়ে মশা? তিন চার বার ঘুরিয়েই হাত ব্যাথা হয়ে গেলো। সবাই নাকি এই র্যাকেটে মশা মেরে অত্যন্ত মানসিক শান্তি অনুভব করে। কিন্তু আমার নাকে লাগলো পোড়া গন্ধ। তখন আমার প্লেসমেন্ট ছিলো বার্ণ ইউনিটে। ভয়ংকরতম স্থান। রোগীদের দেখলে একটি কথাই শুধু মনে ঘোরে,
“কেন আল্লাহ কেন? মানুষ্ কে যদি মারতেই হয়, অন্য উপায়ে মারো। এত কষ্ট কেন তুমি পৃথিবীতে দিলে?”
আমি সাথে সাথে ঘোষনা দিলাম, মশাদের পুড়িয়ে মারা যাবে না। তাদের হাত দিয়ে চ্যাপ্টা বানানো যাবে, স্প্রে দিয়ে মাতাল করে পিটানো যাবে, কিন্তু পোড়ানো যাবে না। তারাও মানুষ বা তারাও মশা। তাদের মৌলিক অধিকার বলে কিছু আছে। আম্মুর সাথে মল্লযুদ্ধ লেগে গেল। শেষ মেশ রফা হলো, আমার সামনে মশা র্যাকেটে মারা যাবে না। মেডিকেলে পড়ার জন্য বাসায় থাকতাম ৬ মাসে ৬ দিন, বাকি সময়ে মশাদের দেখার আর কেউ রইলো না। হয়ত এই কৃতজ্ঞতায় মশা আমার কাছে ঘেঁষে না… হতে পারে!
মাঝখানে এডিস মশা এসে ঢাকা তোলপাড় করেছিল। ডেঙ্গু অবশ্য এখন ডাল-ভাত, তবে একসময়ে তো সে রাজত্ব করেছে- সেতো মিথ্যা নয়। তখন যে মশাই যে মারুক টেনে টুনে সবাই সেটাকে এডিস মশাই বানাবে। আমি নিজেই মশা পেলে সেটিকে সাথে সাথে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসের নীচে দেখে বই এর সাথে মিলাতাম, কোন মিল পাই নাকি। একবার অবশ্য পেয়েছিলাম (হয়ত), আনন্দের আতিশয্যে পাশের রুমে বন্ধুকে দেখাতে গেলাম। “কই কই দেখি” বলে গাধাটা এসে এমন জোরে কথা বললো যে মশার মৃতদেহ তার মুখের বাতাসে উড়ে গেলো। হায় হায় করে আমরা দুইজনেই রুমের মেঝে বিছানা আর পাশের আলনাটাও আতি পাতি করে খুঁজলাম, কিন্তু যে চলে গেছে তারে কি আর পাওয়া যায়?
আমাদের হোস্টেলের সামনে একটা ছোট বাগান ছিলো যাতে আব জাব কিছু ফুল ফুটে থাকতো। থাকার মাঝে ছিল বিশাল বিশাল সব কৃষ্ণচূড়ার গাছ। বৃষ্টি আমার অতি প্রিয় বিষয়, গত বছরের আগ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে অথচ আমি ভিজিনি, এমন রেকর্ড নেই। সাথে ঝড় হলে তো কথাই নেই। ভিজে ভিজে কৃষ্ণচূড়ার ডাল এনে এনে বালতি ভর্তি করে ফেলতাম। তারপরে রুমের মাঝে রেখে দিতাম। আর লম্বা রেনূ সহ জিনিস টা দিয়ে (কি বলে এগুলোকে? বোটানি খেয়ে ফেলেছি) মোরগ ফাইট খেলতাম। কুকুর বিড়াল বৃষ্টি দেখলেই আমার মাথা যেত নষ্ট হয়ে । একবারের কথা বলি। একবার আমি ফার্মাকোলজী টিউটোরিয়াল ক্লাসে আইটেম দেয়ার জন্য বসে আছি, হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখলাম আকাশ কালো হচ্ছে। দেখা মাত্র মনে হলো, কুকুর বিড়াল শুরু হবে। দৌড়ে গিয়ে ম্যামের সামনে বসলাম আগে আইটেম পরীক্ষা দিবো, কারন সেটাই শেষ ক্লাস ছিলো। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্য পাজি শাহনূরের কাছে হেরে গেলাম। সে ধাপ করে বসে পড়লো, সে আগে দিবে। আমি বিরস বদনে আবার গিয়ে বেঞ্চিতে বসলাম। সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হলো। আমি দেখলাম, মেঘের অবস্থা ভালো না, বৃষ্টি ৩০ মিনিট থাকবে কি থাকবে না, কারন আকাশ তেমন কালো আর দেখাচ্ছেনা। এদিকে এই ব্যাচের আইটেম শেষ হতেই লাগবে মিনিমাম ২০ মিনিট। খাতা পত্র নিয়ে কাউকে কিছু না বলে ক্লাস থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেলাম। পিছে ম্যামের গলা শুনতে পেলাম, “অ্যাই, ও দৌড়ায় কেন?” আমি কি আর থামি? আইটেম পেন্ডিং হলে পরে দেয়া যাবে, এমন বৃষ্টি যদি আর না পাই? এক দৌড়ে হলে বই ছুড়ে ফেলেই ছাদে। ছাদে গিয়ে দেখি আমার দুই ফ্রেন্ড আগে থেকেই উপস্থিত, পানিও জমে গেছে বেশ। টানা আধঘন্টা খেললাম জমা পানিতে, কে কত উপরে লাফিয়ে পানি উঠাতে পারে। পরে দেখলাম ডায়াগনসিস কারেক্ট ছিল, ৩০/৪০ মিনিট পরই বৃষ্টি ধরে গেলো। এখন আর কোন গাছ নেই, বৃষ্টি ভেজাও নেই। নগরায়নের ফাঁদে পড়ে কৃষ্ণচূড়াকে বিদায় জানিয়েছি, যেদিন গাছগুলি কাটা পড়লো, চোখের পানি আটকাতে পারিনি। আমাদের শহরে কৃষ্ণচূড়া ছিল, আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করেছি, বলতে চাচ্ছিলাম মশার কথা। তো সেই বাগানে আর কিছু থাকুক না থাকুক লম্বা লম্বা ঘাসের সাথে ছিল বিষাক্ত সব জংলী মশা। আমি বলতাম আফ্রিকান মশা। কালোর উপর সাদা ডোরাকাটা। মশা জগতে হয়ত তারা মডেলিং করে, কারন তাদের ফিগার অত্যন্ত সরু। কিন্ত আমাদের জগতে ত্রাস ছিলো। বাগানে ভুলেও সন্ধ্যার পর পা রাখলে নিস্তার নেই। কামড়ে দেবেই। আর কামড়ে দিলে ভয়ংকর জ্বালার সাথে জায়গাটা ফুলে যায়, ফোলা থাকে প্রায় কয়েক ঘন্টা। তার মাঝে আবার কামড়ের ফুটাও দেখা যায়। এদের সাথে মশা জগতের মনে হয় মিল মহব্বত নেই, কারন এরা আমাকে মোটেও খাতির করতো না। কৃষ্ণচূড়ার লোভে পড়ে এদের অনেক কামড় খেয়েছি। অবশ্য বাগান ধ্বংসের সাথে সাথে এদেরো সমূলে উৎপাটন করা হয়। এরপরো এত দিন পর, এই লিখা লিখতে গিয়ে ওদের বড় মিস করছি। হায়, ওরা থাকলে হয়ত কৃষ্ণচূড়া গাছগুলিও থাকতো।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১১ রাত ১:৩৭