
নেপালের সবচেয়ে শান্তিময় শহর মনে হয় পোখারা! স্বাপ্নিক একটা শহর। বিশাল ফেওয়া লেক গভীর মমতায় শহরটাকে জড়িয়ে রেখেছে। কাঠমান্ডু থেকে পোখারায় ঢোকামাত্র মনে হল যেন হাতে আঁকা ছবির ফ্রেমে আমরা ঢুকে পড়েছি। মূল শহরটা বেশী বড় নয়, রাস্তাঘাট ও কম। চিনতে বেশী কষ্ট নেই। বাড়িগুলো সবই দোতালা/একতলা।প্রতিটি বাসার সামনে ফুলের বাগান অথবা বারান্দা ভরা ফুলের টব। পরিষ্কার পথ ঘাট আর রঙিন দোকানের মেলা। পোখারার মোটামোটি সবগুলো হোটেল দেখতে খুবই সুন্দর, আর যেগুলো লেকের পাশে, সেগুলোর তো কথাই নেই! এই বৃষ্টি, এই রোদ। সবসময়ই ফেওয়া লেকের উপর দিয়ে বয়ে আসছে ঠান্ডা নরম হাওয়া! এক কথায় awesome!





হোটেলের একাংশ। এরকম চারটা নিয়ে পুরো হোটেল।

বলতে ভুলে গিয়েছি, পোখারা ঢোকার ১ ঘন্টা আগে আমরা আরেকটা মন্দিরে গিয়েছিলাম, বিন্দুবাসিনী মন্দির। মন্দিরের এমন কিছু বিশেষত্ব নেই, তবে বরফে ঢাকা অন্নপূর্না রেঞ্জের সবচেয়ে সুন্দর চূড়াটা দেখার জন্য চমৎকার জায়গা!!! একদম উপরের ছবিটা ওই মন্দির হতেই তোলা।



সারেংকোট থেকে ফিরে আমরা সকালের নাস্তা সেরে খানিকক্ষন আশে পাশের দোকান গুলো দেখলাম। পাশমিনার বিশাল কালেকশন। এরপর আমরা বেড়িয়ে পড়লাম সাইট সিয়িং এ। সবার প্রথমে গেলাম শহরের মাঝেই শ্বেতী নদী দেখতে। নদী অবশ্য নামেই নদী, উপর থেকে দেখে মনে হলো একটা নালা। কিন্তু ভয়ংকর স্রোতের নালা! শ্বেতী নাম কারন পানি একেবারে দুধের মত সাদা। অনেক উপর থেকে দেখতে হয়, বিপদজনক বলে কাছে যাওয়ার কোন উপায় নেই। তবে এই নদীর পানিই পরিশ্রুত করে পোখারায় সরবরাহ করা হয়।


শ্বেতী রিভারের পাশেই গোরখা মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। গোরখাদের কীর্তিগাথায় পুরো নেপাল ভরা। তাদেরকে সাহস, বীরত্ব আর বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। তবে আমাদের কপাল খারাপ, মিউজিয়ামটা খোলে বেলা ১২টার দিকে, আমরা পৌঁছেছিলাম বেলা ১১টায়। কিন্তু অপেক্ষা করার সময় ছিল না, তাই বাইরে যেসব কামান আর ছবি ছিল সেসব দেখেই আমরা ফের গাড়িয়ে উঠে পরলাম।


এরপর গেলাম ডেভি’স ফলস এ। ঢোকার মুখেই দেখি আবার অন্নপূর্না রেঞ্জ। তবে এবার শিল্পীর ভাস্কর্যে! ফলসে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমন তোড়ে পানি আসছে যে শব্দ শুনেই ভয় করছে। কেউ একবার যদি পড়ে তবে কোনক্রমেই রক্ষা নেই!উপর থেকে তাকিয়ে কোনভাবেই দেখা যায় না যে পানি আসলে কত নীচে পড়ছে, এতই গভীর খাদ। বিপদজনক সীমারেখা দেয়া আছে, তবে বেশী লাফালাফি করা বাঙালির জন্মগত অভ্যাস!









যাই হোক, ৩৭ জনকে একত্রিত করতে করতে লাগলো আরো ১ ঘন্টা!







এরপর মানুষজন গেলো আরেকটা কেভ দেখতে, কিন্তু আমাদের সাত ফ্রেন্ডের মাথায় তখন অন্য চিন্তা! প্যারাগ্লাইডিং।





সাতজন পাইলট আসলো দুইটা গাড়ি নিয়ে। গাড়ি নিয়ে পোখারার উঁচু পাহাড়গুলো মাঝে একটাতে উঠতে হবে, তারপরে দিতে হবে লাফ! পাইলটদের ৬ জনই ইউরোপীয়ান। আমার পাইলট ছিল ইন্ডিয়ান, নাম অজয়। তাদের qualification এর ফিরিস্তি শুনে আমাদের চোখ ছানাবড়া।


যাই হোক, যুদ্ধের সাজ সেজে আল্লাহর নাম দিয়ে দিলাম লাফ।






বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, ওইটা কিন্তু আমি।

আবার আমি! ফটোক্রেডিটঃ আবিদা।

কে যে কোনটা, বাইরের মানুষও আছে।


এবার চৈতী। ফটোক্রেডিটঃ আমি! ঠিক ওর উপরে ছিলাম!









ল্যান্ডিং এর জায়গা, আকাশ থেকে।

ল্যান্ডিং এর কয়েক মূহুর্ত আগে!
প্যারাগ্লাইডিং শেষ করে আমরা শহরে ফিরে দেখি ততক্ষনে আমাদের বাকি দোস্তরাও কেভ দেখে ফিরে এসেছে। সবাই মিলে এরপর গেলাম ফেওয়া লেকে বোটিং করতে। ফেওয়া লেকের ঠিক মাঝে দ্বীপের মত যায়গায় একটা মন্দির আছে। আমরা অবশ্য মন্দিরে নামিনি, নৌকা নিয়ে চক্কর দিলাম কিছুক্ষন, তারপরে নৌকার মাঝে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখলাম সন্ধ্যা মিলানো পর্যন্ত। দূর থেকে মন্দিরের ঢাক আর ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে, মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মন্দির থেকে ফেলে দেয়া ফুল……… এক মূহুর্তের জন্য আমাদের সবারই অবশ্যি মনে হচ্ছিল যে আমরা কি স্বপ্ন দেখছি!






সন্ধ্যা মিলানোর পর থেকে শুরু হলো আমাদের কেনা কাটার পর্ব। কাঠমান্ডুর চেয়ে মনে হয় পোখারাতে শপিং বেশী করেছি। ঠিকভাবে ঘুরলে অনেক কমদামে কেনা সম্ভব। মুখোস, শাল, জাঙ্ক জুয়েলারি আর ব্যাগ!পোখারাতে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ওরা অর্ডার দেখে মনে হয় বাজার করতে পাঠায়, কারন এত এত এএত সময় লাগায় যে বলার না। ওদের মনে হয় তাড়াতাড়ি কিছু সার্ভ করা নিয়ম বিরুদ্ধ। নেপালের বিখ্যাত খাবার মোমো খাবার জন্য আমাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। মোমো আসলে কিছুই না, আমাদের দেশের মাংসের পিঠা। মাংস আর সবজি দুইটাই পাওয়া যায়। তবে সাথে একটা সস দেয়, সেটাই মনে হয় মোমোকে জটিল করে!!


পোখারার একেবারে মোড়ে মোড়ে নাইটক্লাব আর প্রতিটি রেস্টুরেন্টে খুবই শস্তায় হার্ডড্রিঙ্কস পাওয়া যায়। তবে কোনটাই আমাদের কোন কাজের না। একটা নাইটক্লাবে দেখার জন্য ঢুকে খুবই বিরক্ত হতে হলো। স্বল্পবসনা কিছু তরুনী আর একেবারে টাল হওয়া কিছু মানুষ বিরক্তিকর গান শুনে যাচ্ছে। বা হয়ত পশ ক্লাব আছে, আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি, তাও হতে পারে। পোখারার দোকানও সাড়ে ৮টার মাঝে বন্ধ হয়ে যায়, তবে শহর জেগে থাকে। পোখারা যথেষ্টই নিরাপদ মনে হয়েছে, সমস্যা শুধু একটাই। রাত ১১টার পর থেকে ড্রাঙ্ক পাবলিক রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা তাই একটা থেকেই যায়। পোখারা দেখার মাঝ দিয়েই আমাদের নেপাল দেখার সমাপ্তি। যদিও আমাদের ট্যুর তখনো শেষ হয়নি, কারন পোখারা থেকে আমরা ঢাকায় ব্যাক করিনি। আবার বর্ডার পার হয়ে গিয়েছি আরেকটা ছবির মত শহর মিরিকে আর তারপর দার্জিলিং এ। কিন্তু সে অন্য কাহিনি। নেপাল দেখার এইখানেই ইতি।


হিমালয় কন্যা নেপাল - কাঠমান্ডুর পথে (প্রথম পর্ব)
হিমালয় কন্যা নেপাল – কাঠমান্ডু (দ্বিতীয় পর্ব)
হিমালয় কন্যা নেপাল – মনোকামনা ও সারেংকোট (তৃতীয় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪৫