আধ ঘন্টা ধরে একা একা বসে আছি। সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টিটা এবেলা বেশ ধরে আসলেও আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোন সময় হুড়মুড় করে নামতে পারে। অসময়ের বৃষ্টিতে শীত ভাল নামবে আজ। হলরুমের ভেতরটা বেশ অন্ধকার। লোডশেডিং। জেনারেটর চালানো হয়নি। কেবল একজন মানুষের জন্য জেনারেটর চালানো হবে এটা আশা করাটা বাড়াবাড়ি। উশখুশ করছি। গালের দাঁড়িটা বেশ ভোগাচ্ছে আজ। এখানে আসার কথা ছিল না আমার। যদি থাকত তাহলে মনটা থিয়েটারের জন্য এত উতলা হত না।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আসছেন ঢাকা থেকে। হঠাৎ করে অনুষ্ঠানটা আয়োজন করায় ব্যানার নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে আয়োজকদের। পৈত্রিক সূত্রে ছোট-খাট প্রেসের মালিক আমি। এ ধরনের অনুষ্ঠানের ব্যানারগুলো আমিই স্লাপাই দিয়ে থাকি। আবার শখে থিয়েটারে একটু পার্টও করি। বাবা, চাকর, পুলিশ, মন্ত্রী- এই এমন সব চরিত্র করাটা আমার জন্য ডাল-ভাত। তবে আজকের শোতে আমার চরিত্রটা গূরুত্বপূর্ন। আজ করছি কবর। মুনির চৌধুরীর কবর। নেতার পার্টটা পেয়েছি। পেয়েছি কথাটায় একটু ভুল আছে। শফিক বরাবর নেতার এ পার্টটুকু কওে থাকে। কিন্তু বেচারা জরুরী কাজে ঢাকায় গিয়ে আটকে পড়েছে। আর কাউকে হাতের কাছে না পেয়ে মামুন ভাই অবশেষে আমাকেই সিলেক্ট করলেন। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়ল বটে কিন্তু কেবল শখ-আহলাদ নিয়ে মেতে থাকলে তো চলে না। পেট পূজোও করতে হয়। হলরুমটা আমার থিয়েটারের কাছেই। আসার সময় একবার ঘুরে গেছি। জনমানিষ্যের চিহ্ন নাই। ব্যানারটা নিয়ে আবার এসেছি রহমান স্যারের জন্য। তিনি আসলে বুঝিয়ে দিয়ে মুক্তি। ব্যাক টু থিয়েটার।
চোখ বন্ধ করে নেতার সংলাপগুলো মনে মনে ঝালাই করে নিতে গিয়ে একটু ঝিমুনীভাব চলে এসেছিল। তাই শহীদুল আর আব্বাস স্যার যে কখন হলরুমে এসেছে তা দেখতে পারিনি। পেছনের অন্ধকার জায়গায় বসে আছি বলে উনারাও খেয়াল করেন নাই। জেনারেটর চালু হয়েছে। ডায়াস আর সামনের সারির অন্ধকার কাটলেও পেছনের অংশটুকু জেনারেটরের দুর্বল আলোয় আবছা অন্ধকার। যাক অবশেষে মুক্তি। রহমান স্যার না আসলেও উনাদের যে কারও হাতে ব্যানারটা ধরিয়ে দেওয়া যাবে। উঠতে গিয়েও উঠলাম না। বাইরে জোর বৃষ্টি নেমেছ। এ বাদলায় আপাতত বের হওয়া যাবে না। হলরুমে আমরা তিনটে প্রানী। শহীদুল স্যার আর আব্বাস স্যার আলাপে মগ্ন। পরনিন্দা চলছে। পরনিন্দা শুনতে মন্দ লাগে না। শুনিই না কি বলে।
এ মূহুর্তে আব্বাস স্যারের গলাটা বেশ চড়েছে। আরে প্রশাসনের পরিচালক তো একটা কলা গাছ। হেদায়েতরা তো কলাগাছই বসাবে ওসব জায়গায়। ওকে বসতে বললে বসবে। উঠতে বললে উঠবে। ক্ষমতা তো সব হেদায়েতদের হাতে। পরিচালকররা সারাজীবন এখানে ওখানে চাকুরি করে শেষ ক’টা দিন ঢাকায় যায়। দরজা-জানালা দেখতে দেখতেই চাকুরি শেষ। হেদায়েতদেরকে কব্জা করার শক্তি বা সময় কোনটাই তো ওদের নাই। নইলে তোমার বদলীর জন্য হেদায়েত ধরতে হবে কেন?
ঠিক বলছেন স্যার। হেদায়েত স্যারও পারেও বটে। কিছু বেয়াদব অফিসার পকেটে পুষে রাখে সব সময়। কিছু হলেই ওদের লেলিয়ে দেয়। জুনিয়দের হাতে অপমান হবার ভয়ে আমাদের সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। দেখেন না আমার অফিসে আছে একটা ।
কে? কার কথা বলছ?
কার আবার জহিরের কথা বলছি। এক নম্বরের একটা বেয়াদব। কোন আদব লেহাজ নাই। দেখলে সালাম দেয় না ঠিক মত। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় না পর্যন্ত। ডাকলে ঠিক মত আসে না। খালি কাজ দেখায়। এইগুলো হল হেদায়তের মাল।
এসব করে? তুমি তো তাও সহ্য করতাছ। আমি হলে কষে একটা দিতাম গালে। যা হবার হত।
কথা শুনতে শুনতে কান লাল হয়ে আসে। দু’জনের কথা না শুনলে জানাই যেত না জহিরের এত দোষ। অথচ. . . । আরও কিছু ভাবার আগেই শুনি শহীদুল স্যার মুখ খুলেছেন।
তা কি আর করা যায় স্যার। সহ্য করতাছি কোন রকমে। সেদিন কি করছে জানেন স্যার, পিয়নটাকে টাকা আর ব্যাংকের জমা বই দিয়ে বললাম টাকা জমা দিয়ে আস। আধা ঘন্টা পরে দেখি ব্যাটা ঘুরতাছে । ব্যাংকে যাও নাই জিজ্ঞেস করলে বলে স্যার একেবারে যাব। আরও কাজ আছে ওইদিকে। চিন্তা করেন স্যার কি স্পর্ধা। জহিরের লাই পেয়ে ব্যাটারা মাথায় উঠছে।
নাহ। ডিপার্টমেন্টটা ধ্বংস হয়ে গেল। সামনে যে কি আসবে কি জানে।
আপনাদের আর কি স্যার। আপনাদের দিন তো শেষ হয়ে আসছে। আমরা থাকব আর এইসব বেয়াদবদের নিয়ে অফিস করব। রাজনীতি সব শেষ করল। দুইদিন হল না চাকুরিতে ঢুকছে কিন্তু মাঠের কাজ ভাল করে না শিখতেই এগুলোকে এনে এনে ভাল ভাল জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছে হেদায়েত স্যাররা। না শিখতাছে কাজ, না প্রোটকল।
আব্বাস স্যার কথা পাল্টায়। এই প্রোগ্রামে খাওয়া-দাওয়া কিছু আছে?
জানি না। থাকার তো কথা। পরিচালকের তো ব্যবস্থা করছে জানি। আপনাকে কিছু বলে নাই?
না তো!
দেখেন স্যার অবস্থা। খাওয়ার ব্যবস্থা পরিচালকের অথচ সেইখানে পরিবেশনের নাম করে জহিরের মত চ্যাংড়া পোলাদের রাখা হয় । আমি-আপনি জানিই না। অন্তত আপনাকে তো রাখতে পারত।
দুপুরের খাবারের কথা কে বলছে তোমাকে?
জহির বলছে।
পেছন থেকে দেখা যায় না কিন্তু তারপরও অনুমান করি আব্বাস স্যারের কালো মুখটা যেন আরও কালো হয়ে আসে। মেন্যু কি ছিল?
রুপচাঁদা মাছ। দেশী মুরগী। খাসী। মুগডাল। চাইনিজ সবজী। তিন-চার রকম ভর্তা। দই।
দেখছ অবস্থা। মাছ কেবল একটা। আরে ব্যাটা চিংড়ী কই। পরিচালক আসছে আর তারে চিংড়ী দিল না।
খাবারের কথা আলোচনা হচ্ছে দেখেই কিনা কে জানে আব্বাস স্যার হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। সামনের টেবিল থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা খুলে ঢক-ঢক করে পানি খেয়ে শূন্য বোতলটা যথাস্থানে রেখে দিতে গিয়েই যেন পেছনের আবছা আলোর ভেতর থেকে আমাকে আবিষ্কার করলেন। কে ? কে ওখানে ?
সালাম স্যার। ব্যানারটা এনেছিলাম।
দূরে কোথাও বাজ পড়ল। মাঘ মাসের বৃষ্টিতে আবার বাজও পড়ে। এক নতুন অভিজ্ঞতা। ঘরের কাাঁচের জানালাগুলো কেঁপে উঠে। আমার কথার আওয়াজ বাজের আওয়াজে খানিকটা চাপা পড়ে।
ও। রেখে যান। রহমানকে বলব। আপনাকে কে পাঠিয়েছে?
মুখ খুলতে গিয়ে নজরটা দেয়াল ঘড়িটার দিকে আটকে যায়। সর্ব্বনাশ। আর মাত্র আধ ঘন্টা পরই শো শুরু হবে। কথা না বাড়িয়ে ছুটতে লাগলাম। স্টেজ এক্টর হিসেবে পাওয়া রেপুটেশন বাঁচাতেই হবে। না বাঁচালে চরিত্রাভেনতাও আর পাওয়া যাবে না।
দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে থাকি। রহমান স্যারের সাথে সিঁড়িতে প্রায় লেগেই গিয়েছিল। স্যার আমার দিকে একবার তাকিয়েই নজরটা সরিয়ে নিলেন। রাস্তায় নেমে দু’দুটো রিক্সা পার হবার পর তৃতীয়জন রাজী হল। জোরে চালাও। শিল্পকলা একাডেমী। আধ ঘন্টা শেষ হবার পাঁচ মিনিট আগে গ্রিন রুমে ঢুকে বুঝলাম এত তাড়াহুড়ো না করলেও চলত। শো শুরু হতে কিঞ্চিৎ দেরী হবে। কারন লোডশেডিং। মামুন ভাইয়ের বকাটা অবশ্য এড়ানো গেল না। আমাকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলতে লাগলেন, তোর আক্কেল কবে হবে? বৃষ্টিতে এভাবে মেকআপের বারোটা বাজালি? এই সীমা, জহিরকে আবার মেকআপ করিয়ে দে।