স্বপ্ন সত্যি হবার এক বছর।
আগস্ট ২০২২,
গতবছরের এই অগস্ট মাস ছিলো জীবনের কঠিনতম মাস গুলির একটা।
কতটা বিষণ্ণা, মর্মান্তিক, কঠিন ছিলো এই মাস এটা আমি জানি। জুলাই মাসে মা চলে গেলেন,
সপ্তাহ দুয়েক বাড়িতে থাকার পরে চলে এলাম ঢাকায়।
আমি আর আমার সহধর্মিণী। আমাদের বাসায়।
দুজনই পুরোপুরিভাবে বিপর্যস্ত।
কি খাই, কি রান্না করি, কি করি আর না করি কিছুই ঠিক নাই।
ভিসা ইনটারভিউ জুনের ১৭ তারিখ, সবাই ২৫-৩০ দিনে ভিসা পায়। আমার ২ মাসেও কোন খোজখবর নাই।
এমন একটা ভয়ানক পরিস্থিতি, একদিকে হাটি আর একদিকে চলে যাই। অফিসে থেকে বাসায় হেটে আসতে ২০ মিনিট লাগতো, তবে ঐ দিনগুলিতে পথ যেন ফুরাতে চাইতো না।
রাতের পর রাত জেগে থাকি, ঘুম আসে না।
মায়ের কথা মনে পড়ে, ফুফড়ে ফুফড়ে কাঁদি আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই।
চাকরিবাকরির বেহাল দশা।
অফিস যাই, বসে থেকে চলে আসি। একটা ফাইল চেক করতে গেলে চোদ্দবার ভুল করি। একটা অফিসিয়াল লেটার করতে যেখানে আমার ১০ মিনিটের বেশী লাগে না সেখানে আমি সারাদিনে একটা লেটার করতে পারি না। অফিসের বস ছিলেন এক জঘন্য, নিকৃষ্ট মহিলা, যে কিনা কাজের বেডি হবারও যোগ্যতা রাখেন কি না আমার সন্দেহ। আমি একটা মেন্টাল ট্রমা পার করছি, কাজে মন নেই, চাইলেও পারছি না, তবুও মুখের উপরে জঘন্য ভাবে অপমান অপদস্থ করতো। আমার অবশ্য অপমান গায়েই লাগতো না, কারন তখন আমার কোন ফিলই কাজ করতো না। যা বলতো চুপ করে সইতাম। কারন বোবার কোন শত্রু নেই, আর আল্লাহরর কাছে ধৈর্য্য ধরার সামর্থ্য চাইতাম। অপেক্ষা করতাম, এক অনিন্দ্য মুক্তির।
জার্মান এম্বাসিতে জুন মাসে যারা একসাথে ইনটারভিউ দিয়েছিলাম, সবাই ভিসা পেয়েছে, কেউ জার্মানী চলেও এসেছে, ভার্সিটিতে এসে ছবি আপলোড দিচ্ছে, আর আমি তখন শেওড়া পাড়ার রাস্তায় একাএকা হেঁটে বেড়াই। হতাশা কাকে বলে, কত প্রকার কি কি বুঝে গেছি। বুঝে গেছি ডিপ্রেশন কাকে বলে, চিনে গেছি, বিপদে মানুষের আসল চেহারা, পর কিংবা আপন কারা।
জীবনে এত নির্মম দিন কখনই আসেনি। দাঁতে দাঁত চেপে দিন পার করেছি, ধৈর্য্য ধরেছি, যাকে বলে এক্সট্রিম, আল্টিমেল লেভেলের ধৈর্য্য, কারন, আমি জানি, এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, " ইন্নাল্লাহা মা'আস সবেরিন।"
অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
অবস্থাটা এমন, কিছুই হচ্ছে না, একটা অবস্থায় আছি,
তবুও হাল ছাড়িনি, আশায় ছিলাম, ভাল কিছুই হবে।
আমি ভিসা পাবো, এই আশা আমার পরিবারের লোকজন ছেড়েই দিয়েছিলো। আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন লাগতো, যদি কেউ জিগ্যেস করতো, "কি রে জার্মানী কবে যাবি?"
আমি উপরে কনফিডেন্স, আর ভিতরে ফ্রাস্টেশন নিয়ে বলতাম- আল্লাহ রিজিক যেদিন রাখছে, ঠিক সেদিন যাবো।"
এমনই এতদিন, ২৫শ আগস্ট, অফিসে গেছি, সকাল ১০:১০
সিনিয়র কলিগ লুৎফর ভাই জিগ্যেস করলো, শুনছিলাম, তমাল তুমি না জার্মানীর জন্য চেষ্টা করছিলা, খবর কি?
এই প্রশ্নটা আমার কাছে খু্বইভয়ংকর রকমের ভারি মনেহচ্ছিলো সেদিন, তবুও প্রচন্ড ব্যর্থা, হতাশা, কষ্ট, আর তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে বললাম ভাই, ইনশাল্লাহ প্রায় সবই কমপ্লিট, এখন শুধু সুসংবাদের অপেক্ষায়। ফুল ফুটলে সুবাস এমনিতেই পাবেন।
ঠিক ১৫ মিনিট পরে,
একটা টেলিফোন নম্বর থেকে কল আসছে,
বললো, আমি জার্মান এম্বাসি থেকে বলছি,
মোল্লা মোহাম্মাদ তমাল বলছেন?
আমি বললাম জ্বি।
বললো, আপনার পাসপোর্টটা রেডি নিয়ে যান।
আমি প্রচন্ড রকমের ভয়, হতাশা, ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ নিয়ে কাপাকাপা গলায় বললাম, আমাকে কি রিজেক্ট করা হইছে?
তিনি বললেন কেন? কেন? রিজেক্ট করা হবে কেন?
আমি বললাম, প্রায় আড়াইমাস হয়ে গেলে ইনটারভিউয়ের, কোন খোঁজখবর নাই, তাই বললাম।
তিনি বললেন, আপনার ভিসা হইছে।
আলহামদুলিল্লাহ্ বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
ছ্বলছল করে চোখ দিয়ে অনাবরত পানি ঝরছিলো।
মনেহচ্ছিলো এতদিনে বুকে চেপে রাখা পাহাড় সমান এক যন্ত্রনার পাহাড় নেমে গেলো। শেষ হলো অপেক্ষার, শেষ হলো প্রশ্নের,
শেষ হলো চরম অনিশ্চয়তার, চিন্তা, হতাশা, অপেক্ষা, ধৈর্য্য ধরতে ধরতে বিরক্ত হয়ে যাবার দিনগুলি।
সে দিন ছিলো শুধুই আনন্দের।
তারপরের গল্পটা সবারই জানা,
চলছি এভাবে, চলছে জীবন স্বভাবে,
আমার পৃথিবীর প্রান্তরে।
জীবন থেকে আমার সবচেয়ে বড় শিক্ষা এখান থেকেই হয়েছে,
বুঝেছি অপেক্ষা কাকে বলে, শিখেছি ধৈর্য্য কিভাবে ধরতে হয়,
কিভাবে কঠিন সময় গুলো পার করতে হয়, কিভাবে আল্লাহর কাছে চাইতে হয়।
বিশ্বাস করেন, আপনি যদি আল্লাহর কাছে মন থেকে কিছু চান, আপনি তা পাবেনই, আল্লাহ আপনাকে দিবেই। এটা মনেপ্রাণে ধারন করুন, আপনার সবচেয়ে খারাপ অবস্থার পরেই আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আপনাকে সবচেয়ে সেরা উপহার দেন।
শুধুই অপেক্ষা করেন, কারন নিশ্চিয়ই আমাদের প্রতিপালক আমাদের সৎকর্ম গুলোকে বিফল করেন না।
ইনশাল্লাহ লেগে থাকুন, ভাল কিছু হবে।
হতেই হবে, আপনি পারবেন, আপনাকে দিয়েও হবে।
আমার জন্য দোয়া করবেন।
---মোহাম্মাদ তমাল
ফ্র্যাঙ্কফূ্র্ট, জার্মানি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ১:০৯