১।
আশ্চর্য ব্যাপার!
মাত্র এক বছর পার হয়েছে, এর মধ্যে আমি ইশরাত আপার পুরো নামটা মনে করতে পারছিলাম না। সারাদিন পর এই বিকেল বেলায় মনে পড়ল।
ইশরাত আখন্দ...! আমি ডাকতাম ইশরাত আপু। তো একদিন বাটলার'স কফিতে দেখা হতে বললেন, "আপু কেন? শুধু ইশরাত।" আমি অবশ্য শেষদিন পর্যন্ত 'আপু'টা জুড়েই গিয়েছি।
কি...? নামটা চিনতে পারছেন না?
না পারারই কথা। কারন ওই 'বিশেষ' দিনটার পর ইশরাত আপুর নাম গনমাধ্যমে এসেছে হাতে গোনা দু'চার বার। ছবি তো নাইই। দেখেন না, আমিই ভুলে যাচ্ছিলাম।
স্মৃতিটাকে একটু নাড়িয়ে দেই, কি বলেন?
মনে পড়ে....?
১লা জুলাই ২০১৬...??
হলি আর্টিজান..???
ব্যস...ব্যস..আর লাগবে না। একেবারেই ঘটনাটা মনে পড়ে গেছে, তাই না। ২০ জনকে জবাই আর গুলি করে মেরে ফেললো অবলীলায় ৫ জন 'ইসলামের সৈনিক' - সাচ্চা মুসল্মান! তার মধ্যে তিনজন ছিল বাংলাদেশি।
এইতো...ফায়াজের নাম মনে পড়ে গেছে আপনার।অবন্তীকেও। তাইনা? আমাদের দুই তরুন আইডল যাদের স্মৃতি কখনই ভোলা যাবে না।
কিন্তু এদের নিয়ে যত লেখা হয়েছে, তার শতাংশও মনে হয় তৃতীয় ব্যক্তিটিকে নিয়ে লেখা হয় নি। এই থার্ড পারসনটিই 'ইশরাত আখন্দ'। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, কয়জনের মনে ছিল একে।
আজকে ইশরাত আপার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আমার সাথে এই 'অদ্ভুত' মানুষটার স্মৃতিগুলো টুকরো টুকরো। হয়ত বেশি না। কিন্তু প্রত্যেকটিই অমূল্য। তারই কিছু কথা বলব।
২।
উচ্ছ্বল, প্রানবন্ত, মজা খোঁজা, সহজে মিশতে পারা, আর্ট পাগল, এবং হয়ত রান্নাও ভালবাসতেন - এই ছিল ইশরাত আপু। মনে আছে রাত ১১টায় একদিন ডাকা হলো ওনাকে গুলশানের 'দ্য বেঞ্চ' নামের রেস্টুরেন্টে। একডাকে আমাদের সাথে আড্ডা দিতে চলে এলেন। সেইদিনই প্রথম পরিচয়। কোনরকম জড়তা নেই। অসাধারন বন্ধু বৎসল। একা থাকতেন। তাই হয়তো আড্ডা পছন্দ করতেন।
আমার থেকে বেশি খাতির ছিল নিভার সাথে। মাঝে মাঝেই টুকটাক গল্প হতো ওদের মধ্যে। চ্যাটিংএ। তখনই জানলাম, খুব লোনলি একজন মানুষ একা লড়ে যাচ্ছেন নিজের ভাললাগা আর ভালবাসার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে।
এরপর কয়েকবারই আড্ডা হয়েছে। ফয়েজ ভাইয়ের জন্মদিনে আমাকে নিয়ে 'ফটোগ্রাফার' হিসেবে অনেক মজা করলেন। আমি বলেছিলাম, একদিন আপনার অনেকগুলো ছবি তুলে দেব। দিয়েওছিলাম। ছবিগুলো আমার ফেসবুকে নেই। ওনাকে ইমেইল করে দিয়েছিলাম। জানি না, উনি পোস্ট করেছিলেন কি না।
একবার আমাদের খেয়াল হলো, MIST তে যাব ছবি তুলতে। ইশরাত আপাকে বলতেই উনি রাজি। পথে গাড়ি থামিয়ে আমাকে পাঠালেন তাঁর সেই সময়ের প্রিয় গানের সিডি কিনতে। আজও যখন আমি গুলশান ২ এর ফাহিম মিউজিক পার হই, আমার গতি স্লথ হয়ে যায়। আজও যখন ওই গানটা শুনি, মনে হয় পিছন থেকে ইশরাত আপুর গলা মেলানো শুনতে পাব।
৩।
ওই বিভৎস রাতটায় আমরা ব্যাংককে ছিলাম। তখনও জানতাম না, জিম্মিদের মধ্যে একজন ইশরাত আপু। পরদিন দুপুর নাগাদ পলাশ ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখে আমরা প্রায় মাথা ঘুরে বসে পড়েছিলাম। আমার মনে আছে, এই ধাক্কা সামলানোর মত মানসিক শক্তি আমার ছিল না। প্রচন্ড বমি লাগছিল। ভয়ে..আতংকে...। কারন তখনও কেউ কনফার্ম করতে পারছিল না। জিম্মি উদ্ধার অভিযান তখনও চলমান।
এরমধ্যে ফেসবুকের কিছু অর্বাচিন ভেতরের ছবিগুলো দিয়ে দিল। এক সেকেন্ডের জন্য তাকিয়েছিলাম। আমরা তখন হোটেলে। এলোমেলো ভাবে ছড়ানো লাশগুলোর মধ্যে ইশরাত আপুকে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। তাও চিনলাম। উফ...!! আজ একবছর পরও সে ছবি চোখে ভাসে। আর কেমন লাগে, সেটা বোঝানোর মত লেখনীর ক্ষমতা আমার নেই। শুধু মনে আছে, সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, আমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছি। কেউ আটকাতে পারছেনা। আমার মনে হচ্ছিল, ইশরাত আপুর মত মানুষ কিভাবে এইরকম নৃশংস হত্যাকান্ডের স্বীকার হতে পারে। আমার প্রচন্ড ভয় করছিল। রুম থেকে বের হতে একবিন্দু সাহস পাচ্ছিলাম না। বরং নিভা আমার থেকে শক্ত ছিল।
ওই সময় আমার একটা কথাই মনে হয়েছেঃ আমি যদি ইশরাত আপুকে একবিন্দুও ভালবেসে থাকি, তাহলে আমার তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া উচিৎ। আমি তাই করেছিলাম। জায়নামাজে বসে যখন ওর স্মৃতিগুলো আর পরিনতির কথা ভাবছি, আমার দু'চোখে তখন পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
এই ছিল ইশরাত আপু। পরিচয় অল্পদিনের। কিন্তু একদম মনের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন।
অনেক পরে জেনেছিলাম, ওর পোষাক নিয়ে সন্ত্রাসীরা বিভ্রান্ত হয়েছিল বিদেশী ভেবে। ওর বাংলা শুনেও বিশ্বাস করেনি। ফলে সুরা পড়তে বলে। চরম লড়াকু আর আত্মসচেতন ইশরাত আপু উলটো তাদের ধমক দিয়েছিলেন কেন তাকে তার নিজ দেশে বসে বাংলাদেশিত্ব প্রমান করতে হবে। 'সাচ্চা মুসলিম' দের এত সময় ছিল না বিতর্কের। সম্ভবত তার মাথায় গুলি করে মেরে ফেলে। আমি আজও অবাক হয়ে ভাবি, প্রাণ কি আত্মসন্মানের চেয়েও তুচ্ছ ছিল ওনার কাছে? সহজেই তো সুরা বলে উনি পার পেয়ে যেতেন। কেন করলেন না? এই জবাব যে দিতে পারত, সেই আজ নেই।
আমরা ফায়াজের বন্ধুত্ব দেখেছি। অবন্তীর সাহস দেখেছি। কিন্তু একটা মানুষের কতটা আত্মসচেতনাবোধ থাকলে সে নিজের প্রাণকেও তুচ্ছ করতে পারে, সেটা কয়জন জানলাম? কোথাও তো এক অক্ষরও লেখা দেখলাম না।
৪।
আর কি লিখব। সেই ছবিগুলো আজও আছে আমার হার্ডডিস্কে। মানুষটা নেই। হাসিমুখের সেই প্রানবন্ত মেয়েটার শরীর এতদিনে মিশে গেছে পঞ্চভূতে।
ইশরাত আপু....আমি কিন্তু ভুলিনি। আমরা তোমাকে ভুলিনি। যেখানেই থাকো, আল্লাহ যেন তোমাকে বেহেশতনসীব করে।
আমার ধর্মবিশ্বাস বলেঃ
"লাকুম দ্বীইনিকুম ওয়ালিয়াদ্বীন - আমার ধর্ম আমার কাছে, তোমার ধর্ম তোমার কাছে" - এই শ্বাশত বাণী যারা অমান্য করে তোমাকে এই নির্মম মৃত্যু দিলো, তারা যেন এর উপযুক্ত প্রতিদান পরকালে পায়।
#স্মৃতিচারনা
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৭ রাত ৮:৫৬