ইদানিং পেশাগত কারণে মিডিয়ার বিভিন্ন সেক্টরের মানুষজনের সাথে নানা বিষয়ে আলাপ হয়। গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, পরিচালক নানান শ্রেণী পেশার। তো কিছুদিন আগে এ আড্ডায় এক গায়ক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। সেই গায়ক বন্ধু জনপ্রিয় এক গীতিকারের কাছে গিয়েছিলেন। গীতিকার সাহেব আবার একজন বিনোদন সাংবাদিক। তিনি ছেলেটিকে বললেন:
- জানেনই তো আমার গান যে গেয়েছে সে-ই হিট। কাজেই আমার নামের উপরই সব চলবে। আপনি আমাকে ২০ হাজার টাকা দিবেন গানের জন্য।
বন্ধুটি থতমত খেয়ে বলল: – ভাই আসলে আমার তো অত বাজেট নাই! যদি এটা বিবেচনায় নিতেন!
- আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি আমাকে গানের কপিরাইটস দিয়ে দেন, তাহলে ১০ হাজারেই হবে। নতুবা ২০ হাজারই সই। তা গানটি কাকে দিয়ে সুর-কম্পোজ করাবেন!
- জ্বি, আমার এক বন্ধু আছেন, অমুক নাম। তিনি করবেন। খুব ভাল কাজ করেন।
- কি বলেন! আমার গান একজন অচেনা-অজানা লোক ডিজাইন করবে! না না তা হয় না। এক কাজ করেন আপনি অমুকের (নবীন তরুণ এক কম্পোজার) কাছে যান। সে তো সব হিট গান দিচ্ছে এখন। টাকাটা বেশী নেয় যদিও। আমি বলে দেবো, কম নেবে। আরে তখন তো তার খবরেই আপনার খবর হয়ে যাবে। আর তা না হলে আমাকে ২০-ই দিতে হবে। আর জানেন-ই তো! আমরা সব বিনোদন সাংবাদিক (মূলত গান লেখা সাংবাদিক) কিন্তু একটা সিন্ডিকেট মেনটেইন করে চলি। কাজেই আমার এক কলে একদিনেই বাংলাদেশের সব পত্রিকাতে আপনি কাভারেজ পেয়ে যাবেন।
আমার সেই বন্ধুটি তার গান নেননি। কথা সত্য, সে কোন কাভারেজও পায়নি। তবে তার গান এবং মিউজিক ভিডিও দর্শকরা গ্রহণ করেছিল। উপরের গল্পটা নিছক গল্প হলে খারাপ ছিল না। কিন্তু ঘটনাটা সত্য। আর প্রকৃত সত্য আরো বেশী ভয়ঙ্কর। বর্তমানে অনেক গীতিকার জীবনযাপনের তাগিদে গান লেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। আবার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বিনোদন বিভাগে কাজ করা সাংবাদিকদের অনেকে নিজের সৃজনশীলতা, গান লেখার দক্ষতা কিংবা সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে একটু বাড়তি আয়ের জন্য গান লিখছেন। এই পর্যন্ত ব্যপারটা খুবই কাব্যময়। কিন্তু এর পরের, মানে বর্তমান দৃশ্যটা খুবই নোংরা এবং কলঙ্কিত।
ভয়াবহ এক আতঙ্কে বর্তমানে দিন কাটাচ্ছেন আমাদের নবীন গায়ক-গায়িকারা। বিভিন্ন পত্রিকার বিনোদন সাংবাদিকদের গান না নিলে তাদের কোন কাভারেজ দেয়া হবে না বলে সরাসরি থ্রেড দেয়া হচ্ছে বলেও শোনা যায়। এমন কিছু নাম আছে, গত বছর ২/১ এর বেশীরভাগ গানের এ্যলবামে এই নামগুলো গীতিকার হিসেবে থাকছেই। অথচ বেশীরভাগের একটা গানও পাওয়া যাবে না, যেগুলো মানুষের মনকে স্পর্শ করেছে। অথচ নবীনেরা এসব নিয়ে কোন প্রতিবাদ না করে বরং অনেক অনেক টাকা দিয়ে তাদের কাছ থেকে গান নিতে বাধ্য হচ্ছে। তার উপর এখনকার আরেক নষ্টামীর নাম, কন্ঠে সফটওয়্যারের ব্যবহার। আর এসব দুষ্টুমি করা কম্পোজারদের কাছেও অনেক ক্ষেত্রে নবীনেরা যেতে বাধ্য হচ্ছে সেই সব অসুস্থ সাংবাদিকদের জন্য। কারণ বিনোদন সাংবাদিকদের এই অসুস্থ অংশটুকু সেই সব কম্পোজারদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পান বলেই ধারণা করা যায়।
কিছুদিন আগে নামকরা এক সিডি-ডিভিডি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সাথে এক আড্ডায় শুনলাম, এইসব নষ্টরা নাকি তাদের ৮/১০ টি গান নিয়ে গিয়ে তাদেরকেও অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য করেন এইসব গান কোন নবীন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়াতে। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকেও সরাসরি বলে বসেন যে, তাদের গান না নিলে কোন পত্রিকায় কোন কাভারেজ দেয়া হবে না। উনাকে জানালাম যে, এসব নিয়ে আমি লিখতে চাচ্ছি। আপনাদের সহযোগীতা লাগবে। তিনি হেসে বললেন, কিন্তু ছাপাবে কে! যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা কি এটা ছাপতে দেবে!
আরেকটা ঘটনা জানাই। কিছুদিন আগে এক নবীন গায়ক, যার ২/৩ টা গানের এ্যলবাম বের হয়েছে, তিনি এক সাংবাদিককে ফোন করে গান চাইলো। সাংবাদিক বিনয়ের সাথে জানালো, ভাই আমি তো কবিতা লিখি! গান লিখি না, আর লেখার কোন ইচ্ছেও নাই। তখন সে গায়ক তাকে খুব অনুরোধ করে বলেন যে, ভাই আমার জন্য না হয় লিখলেন! পাঠক খেয়াল করবেন, পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ যে, শিল্পী নিজেও কাভারেজ আতঙ্ক কাটাতে বিনোদন সাংবাদিক পেয়ে নিজেই বলে বসছে গান নিতে চায়! অথচ জানারই দরকার নেই যে, সে গান লেখে কি না! কিছুদিন আগে দেখলাম, একজন নবীন সাংবাদিক এবং গীতিকারের একটি মিক্সড এ্যলবামের কৃতজ্ঞতায় প্রায় ১৫/২০ জন বিনোদন সাংবাদিকের পত্রিকা সহ নাম। কিন্তু কেন! জবাই চাইনি, জানি পাবো না।
পেশাগত কারণে বর্তমানে কিছু গায়ক-গায়িকা-কম্পোজার-সুরকার বন্ধু জুটেছে। কিছুদিন আগে একজন গায়ক বন্ধু আমার লেখা একটা গান নিলো। আমার জীবনে প্রথম কেউ গান নিলো। এটা শোনার পর, আমার সেই বন্ধুদের কেউ কেউ সরাসরি না হলেও ইঙ্গিতে বলে বসলো যে, এ জন্যই কি সেদিন তার গানের প্রশংসা করেছিলেন! আমি লজ্জিত! আমি স্তম্ভিত! আমি শিক্ষাগত দিক থেকে একজন প্রকৌশলী হলেও ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলাম। ছাত্রজীবনে থাকতেই দেশসেরা দৈনিক-সাপ্তাহিক নানান পত্রিকাতেই গল্প-কবিতা-মতামত-চিঠি ছাপা হয়েছিল। নাটক লিখতাম, পরিচালনা করতাম, গাইতাম, আবৃত্তি করতাম, অভিনয় করতাম। ফলে প্রকৌশল বিদ্যাটা ঠিক সেভাবে আমাতে রপ্ত না হয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত এক সৃষ্টিশীলতায় আমাকে পেয়ে বসলো। সবচেয়ে বড় ব্যপার, মিডিয়ায় কাজ করলে আমি তীব্রকন্ঠে প্রতিবাদ করতে পারবো। প্রতিবাদ করে লিখতে পারবো। তাই অনেক অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে একদিন মিডিয়াধারকদের বোঝাতে সক্ষম হই যে, আমি কাগজ-কলমে প্রকৌশলী, কিন্তু মজ্জাগত একজন শিল্পী। আমার দীর্ঘ ১৬ বছরে কখনই কাউকে আমার গান দেখাইনি। বলিওনি যে, আমি লিখছি। ইচ্ছে ছিল কোনদিন সামর্থ হলে নিজেই গাইবো। কিন্তু হঠাৎ একদিন একজন দেখে, সেখান থেকে কিছু গান নিয়ে যায়। ফলে, আমার বন্ধুদের মন্তব্যে আমি লজ্জায় পড়ে যাই। কিছু সংখ্যক ব্ল্যাকমেইলার, দুষ্টুচক্রের বাসিন্দা এবং নষ্ট বিনোদন সাংবাদিকের জন্য অন্যরা হচ্ছেন অপমানীত! লজ্জিত!
বর্তমানে দৈর্ঘ-প্রস্থে সবচেয়ে বড় দৈনিকের চুপ বোঝানো প্রোফাইল ছবিধারী, কিংবা ট্যাবলয়েড হিসেবে বাজারে আসা একটি দৈনিকের ২/১ জন, মহান একজন ব্যক্তি, যার নামে দেশের রাজা-বাদশাহদের আড্ডাস্থলের সামনের রাস্তার নামকরণ হয়েছে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার চিহ্নিত একজন, কিংবা পুরো পাতাজুড়ে মোমবাতির ছবি দেয়া পত্রিকার সাবেক এক কর্মী এই সিন্ডিকেটটির অন্যতম বলেই শুনেছি। অন্যদিকে খুব সিনিয়র একজন সাংবাদিক, অন্যতম দেশ সেরা ইংরেজী দৈনিকের একজন, যিনি গীতিকার হিসেবেও সম্মানীত এমন একজন সিনিয়র আইকনও নাকি বর্তমানে এই সিন্ডিকেটের ফাঁেদ নিজেকে জড়িয়েছেন। আবার কিছু বড় পত্রিকার বিনোদন সাংবাদিক নাকি এসব হোতাদের এজেন্টের ভূমিকায় থেকে তাদের তাদের সফলকাম করতে কাজ করেন।
একজন মানুষ গান লিখতেই পারেন, নিজ যোগ্যতায়। একজন গীতিকার সাংবাদিক হতেই পারেন! একজন সাংবাদিক গীতিকার হতেই পারেন। কিন্তু একজন লোক তার কর্মস্থল থেকে প্রাপ্য ক্ষমতার অপ-ব্যবহার করে যখন জিম্মি করে নিজেকে গীতিকার বানাতে চায়, তখন কলঙ্কিত হয় আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাস। তখন নিরবে কাঁদে সাংবাদিকতার মূল্যবোধ। তারা সাংবাদিক না হয়ে সরকারী চাকরীতে গিয়ে লালফিতার কারসাজি দেখানোর কথা। ভুল করে সাংবাদিক হয়ে গেছেন। কিন্তু তাই বলে কি, তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিরাও ভুল করে সাংবাদিক!
(চলবে)
বি.দ্র.: লেখাটার জন্য কেউ যদি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চান! সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যপার। আমি গ্রহণ করবো। কিন্তু প্রমাণ করতে পারবো না। কারণ আমার সেই শিল্পী বন্ধুরা, কিংবা প্রয়োজনা প্রতিষ্ঠানের সেই বন্ধুরা আপনাদের আতঙ্কে দিনযাপন করেন। ফলে সবাই এর ভুক্তভোগী হলেও মুখ খুলবে না কেউ। সন্ত্রাসীর ভয়ে মুখ খুলতো না এতদিন। আপনাদের জন্য আজ সাংবাদিকতাও সেই কাতারে পড়লো। ভয়ে কেউ মুখ খুলবে না।
তির্থক আহসান রুবেল
লেখক: মিডিয়া কর্মী
মূল পোস্ট এখানে