আপনার বেতন কত? আপনার সন্তান নিশ্চয়ই সে ধারণাটা রাখে। বাংলাদেশে সরকারী স্কেলে বেতন সর্বোচ্চ কত হতে পারে, সে ধারণাটা কম বেশী ধারণা আপনার সন্তান রাখে। আপনার দামী ফ্ল্যাট, দামী গাড়ি, বিলাসবহুল জীবনযাপন, দামী স্কুল বা কলেজে মোটা মাইনে দিয়ে সন্তানকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। সন্তান হয়ত কখনো ভেবেও দেখে না, প্রতি মাসে এত টাকার যোগান কিভাবে হচ্ছে। আপনার বাড়ির পার্টিতে যারা অংশ নিচ্ছেন, তাদের বেশীরভাগই ক্ষমতায় বিশাল। কিন্তু সামাজিকভাবে কতটা সম্মানীত? আপনার সন্তান দেখছে দেশের বড় বড় দূর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপী, ঘুষখোর সহ নানা অনিয়মের হোতারা আপনার বন্ধুবান্ধব। আপনার কিশোর সন্তান না চাইতেই হাতে পাচ্ছে দামী মোবাইল, দামী ল্যাপটপ। দামী গাড়িতে সবার চলাফেরা। কখনো কি ভেবেছেন সন্তানকে কি শেখাচ্ছেন! আপনি মানুষের প্রয়োজনকে জিম্মি করে দেদার টাকা কামাচ্ছেন। গুদামজাত ব্যবসা করে মানুষকে বাধ্য করছেন আপনাকে অধিক মুনাফা দিতে। আপনার সন্তান টাকার অভাব দেখছে না আর জীবনবোধের দীক্ষা তো না হলেও চলবে তার।
ঐশী কেন মাদকে জড়ালো! নিশ্চয়ই তার বাবা না হলেও চাচারা কমিশনের ভাগবাটোয়ারায় মাদককে সহজলভ্য করেছিল বলে। আইন যাই বলুক না কেন, প্রশাসনের সহযোগীতা ছাড়া এদেশে কোন অপকর্ম হয় বলে বিশ্বাস করবে কি কেউ? পুলিশ প্রশাসন যদি তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতো, কিংবা বলা যায় পুলিশকে যদি তার নিয়ম অনুযায়ী চলতে দেয়া হতো, তাহলে কি আজকের ঐশীর জন্ম হতো?
আপনারা নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত করতে, অসভ্যের মতো কেড়ে নিয়েছেন বাচ্চাদের খেলার মাঠ, নদী-খাল-বিল। বাচ্চাদের বিনোদনের প্রতিটা জায়গাতেই আপনারা অসভ্য কালো থাবা বসিয়েছেন। আজকের বাচ্চারা কি পারছে একটু মন খুলে বিনোদন করতে। বাচ্চাদের জন্য কোন সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই, নেই খেলার জায়গা, নেই বেড়ানোর জায়গা। বাচ্চারা বই পড়ে না। তার উপর আছে, অভিভাবকদের কাকের ময়ূর হবার স্বপ্নের মতো সন্তানদের ভিনদেশী সংস্কৃতিতে বড় করার নির্লজ্জ বাসনা। কখনো কি ভেবেছেন, আপনাদের তৈরি করা অসভ্য আর অসুস্থ্য রাজনীতি আমাদের বাচ্চাদের কি শেখাচ্ছে? আমাদের প্রতিদিনের ব্যস্ততা, বেঁচে থাকার লড়াই, জীবনযাপনের খরচের দায় মেটাতে যুদ্ধ, এসবের মাঝে আমরা কতটা সময় দিচ্ছি আমাদের সন্তানদের, আমাদের পরিবারকে? অসুস্থ এবং অসভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের বেঁচে থাকার মূল্য এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যে, দূর্নীতি ছাড়া কোন সেক্টরটি আছে? আমাদের মূলবোধের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না, আমাদের বিবেককে দিনের পর দিন অকেজো করে দেয়া হচ্ছে। আমরা নিজেদের ছাড়া আর একটা অতিরিক্ত লোকের কথা ভাবি না। সমাজ আর রাষ্ট্র জাহান্নামে যাক, তাতে কার কি আসে যায়! সবাই শুধু নিজের মতো অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত। সেটা হালাল হোক কিংবা হারাম। তবে প্রচলিত আছে, হারামেই আরাম।
আমাদের এখন আর নৈতিকতা দিয়ে বিচার করার মানদন্ড নেই। বিবেকহীন, মূল্যবোধহীন রাজনৈতিক শিষ্টাচারহীন রাজনৈতিক বিচেনায় আমরা আজ মানদন্ড দিয়ে থাকি। দেশের অগণিত কিশোর-কিশোরীকে আমরা স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-খেলাধুলা, মূল্যবোধ এসব থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। বাচ্চাদের কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনে দেয়ার চেয়ে সকাল-বিকাল ক্লাসের পর অতিরিক্ত কোচিং আর প্রাইভেট পড়নোতেই ব্যস্ত রাখি। আর আমাদের সন্তানদের মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার সবগুলো স্তরকে নষ্ট করেছে যারা, তারা তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে দেন বিদেশে।
ঐশীর হাতে এত সহজে ইয়াবা বা অন্য কোন মাদক কিভাবে আসলো? কারা দিল? কিভাবে দিল? ৪২ বছরের সামাজিক আর রাজনৈতিক অবক্ষয়ই এর কারণ। কোথায় আছে মূল্যবোধ! একজন ঐশীর ঘটনায় আমরা তার মু-ুপাত করছি। তবে পত্রিকা আর অনলাইন নিউজগুলোর হেডলাইনের ভাষা দেখে ইদানিং একটা ভাবনা মাথায় আসছে। বাংলাদেশের সরকার আমার এই প্রস্তাবটা লুফে নিয়ে দেশের কোটি কোটি টাকা আর অনেক অনেক সময় বাঁচিয়ে দিতে পারে। আর তা হচ্ছে, বিচারের জন্য আদালতের প্রয়োজন নেই। কারণ যেখানে আদালত আছে, সেখানে একজন রিপোর্টার যখন সাংবাদিকতার মন্ত্রকে ভুলে সরাসরি একজনকে আসামী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সকল প্রকার তথ্য উপাত্ত রেফারেন্স ছাড়াও শতভাগ নিশ্চয়তা সহ দিচ্ছে! তখন শুধু শুধু কোর্টের মূল্যবান সময় নষ্ট করার দরকার কি! পত্রিকাওলারাই তো আসামী প্রমাণ করেই দিচ্ছে। তবে তার চেয়েও অসভ্য লেগেছে, যখন সংবাদমাধ্যমগুলোর বেশীরভাগের প্রচারণায় যতটা না অনুসন্ধান, তার চেয়েও বেশী প্রচারণায় ছিল, একটা মেয়ের বিভিন্ন রকমের প্রাইভেসীর প্রচারণা। মেয়েটার কতটি বয়ফ্রেন্ড, তার যৌনজীবনযাপন কেমন, সে কোন কোন ধরনের সুরসুরিমূলক কর্মকান্ডে জড়িত, এ জাতীয় কথাগুলোই বেশী প্রচার হচ্ছে (বিশেষ করে ভুইফোঁড় অনলাইন পত্রিকাতে)। সেই সাথে প্রচার হচ্ছে, মেয়েটা কতটা বিকৃতভাবে ঘটনাটা ঘটিয়েছে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসুস্থ চেহারাটাই বারবার প্রকাশ করছে তারা।
আরেকটি ঘটনা এখানে তুলতেই হবে। আদালত যখন রিমান্ড দিয়েছে, তখন পর্যন্ত ঐশীর বয়স ১৭ আর কাজের মেয়ের বয়স ১৫। আর রিমান্ডের পর মেডিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী মেয়েটি ১৯ এর কোঠা পেরোনো। বয়স নিশ্চিত হবার আগে আদালত কিভাবে রিমান্ড দেয়! এত সস্তা কিভাবে হয় দৃষ্টিভঙ্গি! যেখানে ঐশীর জন্য তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ছিল একজন মানসিক ডাক্তার আর অবশ্যই অবশ্যই ইয়াবা (কারণ তাকে মাদকাসক্ত বলা হয়েছে)। আর কাজের মেয়েটি তো আরো ছোট। তার জন্যও তো দরকার ছিল একজন বিবেকবান, বোধসম্পন্ন মানসিক ডাক্তার। অথচ এগুলোর কিছুই হয়নি। প্রশ্নটা আসতেই পারে যে, শুধু কি ঐশীর জন্যই মানসিক ডাক্তার দরকার! দায়িত্বশীল বড়দের জন্য নয়!
একজন ঐশী আমাদের প্রচলিত সমাজ আর রাষ্ট্রব্যবস্থার মুখে জুতোপেটা করেছে। সে দেখিয়েছে আমাদের বড়দের পাপ বড় হতে হতে আজ এতটাই বড় হয়েছে যে, একজন সন্তান তার সবচাইতে আপনজনকেও এভাবে হত্যা করতে পারে (পত্রিকার পাতায় জানা গেছে, সে হত্যার সাথে জড়িত)। আর আমাদের সাংবাদিকরা (বিশেষত অনলাইনের ভুইফোঁড় পত্রিকার) দেখিয়েছে, এই পেশায় কত সস্তা লোকে ভরে গেছে। আদালত দেখিয়েছে, .......... (কখন আবার অবমাননার তীর ছুটে আসে!)। একজন ঐশীতে সব শুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে না। হাজার হাজার ঐশী’র মুখ দেখা এখনো বাকি। এগুলো চলতেই থাকবে যতদিন না রাষ্ট্র আর সমাজ মূল্যবোধের দীক্ষায় ফিরে না আসবে।
##