''ব্যস্ত শহরে, ঠাস বুনোটের ভিড়ে,
আজো কিছু মানুষ, স্বপ্ন খুজে ফেরে...
ক্লান্ত শরীরে, মান অভিমানে,
থমকে থাকা এ মন।।
বেঁচে থাকার আদিম সুখে, স্বপ্ন যোগায়,
এ বন্ধন, এ বন্ধন, এ বন্ধন, এ বন্ধন...!!!''
বনানী যেতে যেতে গাড়িতে রেডিও শুনছিলাম। শুনছিলাম না ঠিক, ড্রাইভার নিজেই রেডিও চালু করে গাড়ি চালাচ্ছিলো। রেডিও শোনা হয় না এমনিতেই। তরুনী আরজের কৃত্রিমতায় ভরা কন্ঠস্বর শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে কান সরিয়ে নিলাম। জ্যামে বসে থেকে থেকে কিছু করার পাচ্ছিলাম না, অগত্যা কান নিজে থেকেই যেন চলে গেলো আরজের কথায়।
চিঠি- চিঠি নিয়ে কি যেন বলছিলো। শুনে আগ্রহ জাগলো বাকিটুকু শোনার জন্য। আরজে কি বললো তা হুবহু মনে নেই, মনে রাখিওনি। কিন্তু একটা কথা মাথায় ঘুরছিলো- চিঠির মধ্যে আপন আপন একটা ব্যাপার আছে, লাইনে লাইনে যেন মমতা মিশে আছে কারোর জন্য।
১৬০ অক্ষরের এসএমএস থেকে মেসেঞ্জার-হোয়াটসএপ-ভাইবার এসে চিঠি লেখাকে গলা চেপে মেরেই ফেলেছে বলাই যায়। পোস্টকার্ড তো জাদুঘরে বিকোবে দিন দুয়েক পরে। আঙ্গুলের চাপে হলদে রঙের হাজারো ইমোটিকন প্রতিনিধিত্ব করতে পারে হাজারো আবেগের কথার। আসলেই কি পারে? এক ইমোটিকন তো পাঠানো যায় দশ-বিশ জনকে মুঠোর চাপেই, আঙ্গুলের ইশারাতেই কিন্তু বুকের খাঁচায় দাপড়ে বেড়ানো অনুভূতি গুলোকে দশজনকে পাঠালে তার মূল্য কতটুকু থাকে? যান্ত্রিকতার দিনে যন্ত্রগুলো আমাদের এসব ভাবনা ভাববার সুযোগই দেয় না, আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখে দিয়েছে অবচেতন মনের গভীরেই।
শিশু থাকতে ভাই-বোনদের সাথে ঝগড়া হলেই কথা বন্ধ মুহূর্তেই। কিন্তু কতক্ষন? গোটা গোটা অক্ষরে, ভুল বানানে চিঠি লিখে সন্ধিপত্র পাঠানো হতো কনিষ্ঠজনকে দিয়ে।
অনেক দিন দেখা হয় না সমবয়সী চাচাতো-খালাতো-মামাতো ভাই বোনদের সাথে। কত কথা বলতে ইচ্ছে করে, কত কিছু জানাতে ইচ্ছে করে। কার মুরগীছানা কত বড় হয়েছে, বাবা-মা ঈদে এবার কত সালামী দিলো, দাদু কোন বোতলে কোন আচারটা বানিয়ে রেখে দিয়েছে- কত গুরুত্বপূর্ণ কথা! আর চিঠির শেষে আঁকি-বুকি তো করতেই হবে। সৌন্দর্য্যের একটা ব্যাপার আছে না? কাঁচা হাতে পেন্সিলে আঁকা এবড়ো-খেবড়ো ড্রইং আর ফুল-লতা-পাতার সমাহার।
কৈশোর এখন যার, চিঠি লেখার তার শ্রেষ্ঠ সময়- হেলাল হাফিজের কবিতার ঢঙ্গেই বলি। কৈশোরে কোন ছেলে বেণী বাঁধা কোন কিশোরীর জন্য চিঠি লিখেনি- এমনটা হতেই পারে না। চিঠি লিখতে গিয়ে কত গানের কলি মুখস্ত করতে হয়েছে, কতবার হাস্যকর ছন্দ মেলাতে গিয়ে মাথা চুলকাতে হয়েছে, আর কতবার কাটাকুটি করতে হয়েছে সেটার ইতিহাস কেবল ছেলেটাই জানে। লেখা তো হলো- কিন্তু ‘তার’ হাতে পৌঁছানো তো সাত সমুদ্র-তেরো নদী পার করার চাইতেও কঠিন। লোহার গরাদ দেয়া গেট অথবা মেয়েটার বাঁধাধরা রুটিন, শকুনি চক্ষুসম মা, গুন্ডা সদৃশ বড় ভাই কিংবা বাবার হুংকার বা নিজের দুরু দুরু কম্পমান বুক সামলিয়ে ঠিক ঠিক ঠিকানায় চিঠি ফেলে আসা যুদ্ধজয়ের চাইতেও কঠিন।
চিঠি- কত কালের সাক্ষী। পুরনো চিঠির ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা স্মৃতি আর শুকিয়ে যাওয়া লাল গোলাপের পাপড়ির সামনে বড্ড বেশি কৃত্রিম মুঠোফোনের জগতটা। আত্নার বন্ধন গুলো কেমন যেনো ঢিলে হয়ে গেছে। দায়সারা হয়ে গেছি সবকিছুতেই। দোষ আসলে কার- যান্ত্রিকতা-রুটিনে বাঁধা জীবনের নাকি আমাদের নিজেদেরই।
জানি না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:১৪