আমরা কজন দুনিয়াটাকে দেখেছি? বা দেখার ইচ্ছে পোষণ করি? দুনিয়া দেখার কথা বললেই মধ্যবিত্তের একমাত্র অস্ত্র প্রয়োগ করতে উঠে পড়ে লেগে যাই- 'টাকা পাবো কোত্থেকে?টাকা কামাতেই দিন যায়, দুনিয়া দেখার সময় কই?'
দুনিয়া কেন দেখবো? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আরেকটা প্রশ্ন করা যাক- 'কেন দেখবো না?' কয়েকদিনের জন্য এসেছি সবাই। মরে গেলে পচে যাবো। পচে গেলে মিশে যাবো। একবার সাত হাত মাটির নিচে চলে গেলে সাত দিনের বেশি শোক পালন কেউ করবে না। সুতরাং- দেখে নেই, দেখে নিন। মধ্যবিত্তের খোঁড়া অজুহাতটা একটু কম দেই? কি বলেন? হ্যা জানি- বিদেশ ঘুরতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লাগে। আর ছা-পোষা চাকুরীজীবী আর কামলাদের জন্য সেটা অসাধ্য সাধনের মতই।
দুমুখী কথা বলে ফেললাম?
আরে বাবা! দুনিয়াটাকে খুনের মামলার প্রত্যক্ষদর্শীর মত করে সরাসরি দেখা কেন লাগবে? কে বলেছে? দেখার চোখ থাকলে দেখা যাবেই। আল্লাহর দেয়া দুটা চোখ(চশমাধারীদের জন্য চারটা প্রযোজ্য) ছাড়াও তো মনের চোখটা তো আছে। সেটার তো আর মাইয়োপিয়া-হাইপারোপিয়া হওয়ার সুযোগ নেই যে দূরের জিনিস দেখা যাবে না। বরং এই চোখের ক্ষমতা ঘষে মেজে সুপারম্যানের মত করে নেয়া যায় চাইলে।
কিভাবে? আসুন দেখি রসের ভান্ডার, উইটকিং সৈয়দ মুজতবা আলী কি বলেছিলেন তার 'বই কেনা' প্রবন্ধে- ‘চোখ বাড়াবার পন্থাটা কি? প্রথমত- বই পড়া, এবং তার জন্য দরকার বই কেনার প্রবৃত্তি।
কি বুঝলেন? হাজার হাজার মাইল ভ্রমন করার হ্যাপা পোহাতে না চাইলে দুইমলাটে আবদ্ধ একটা পান্ডুলিপি কিনে ফেলুন। যেরকম দুনিয়াতে ভ্রমন করতে চান। ইতিহাসে ফেরত যেতে চান? হাত বাড়ালেই পাবেন ইসলামের ইতিহাস, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মের ইতিহাস নিয়ে লেখা হাজার হাজার বই; খালি ধর্মের ইতিহাস ভালো না লাগলে জানুন মিশরের ফারাওদের ইতিহাস, নিজের দেশের ইতিহাস, প্রতিবেশী দেশের ইতিহাস, ঘটে যাওয়া যুদ্ধের ইতিহাস। বনজঙ্গলে বাঘ ভাল্লুক মারতে চান কিন্তু বন্দুক নেই আবার সাহসটাও বড্ডো কম? তাতেও সমস্যা নেই। জিম করবেট-কেনেথ অ্যান্ডারসনরা লিখে গেছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা। যুদ্ধ ভালবাসলে লাইব্রেরিতে ঢুঁ মেরে দেখুন কত গোলাগুলি-বোমাবাজি-হানাহানি আটকে আছে অই দুই মলাটের ভেতর। সাহিত্যে ডুবতে চাইলে আগে শুরু করুন দেশী সাহিত্যিকদের দিয়েই। আগেই বিদেশ পাড়ি না জমানোটা ভালো। দেশের সাহিত্যকে চিনুন-ভালোবাসুন; নাক উঁচু হবে। দেশী সাহিত্যকে পাত্তা না দেয়ায় মধুসূদনের কি হয়েছিল তাও জানতে পারবেন বই পড়লে।
আরেকটু দেখি মুজতবা সাহেব কি লিখেছিলেন- মনের চোখ ফোটানোর আরো একটা প্রয়োজন আছে। বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন- সংসারে জ্বালা-যন্ত্রনা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রনা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়’
এটা মনে হয় শান্তিকামী লোকজনের জন্য মোক্ষম অজুহাতের উপায়। সাংসারিক ঝামেলা-অর্থনৈতিক টানাটানি-রাস্তার হাঙ্গামা হুজ্জত-বসের ঝাড়ি; ঝামেলার শেষ নেই। পুরোই পালাবি কোথায়- সিচুয়েশন। প্রবলেম নেই। বইটা খুলুন আর ঢুকে যান ভেতরে। নার্নিয়ার ওয়ারড্রোবের দরজার মত করে বইয়ের মলাট খুলে। জিজ্ঞেস করতে পারেন- নার্নিয়া? খায় না মাথায় দেয়? উত্তর হবে এইটাও বই। বই একধরনের এস্কেপ রুট হিসেবে কাজ করতে পারেন অশান্তির সময়। তবে তার মানে এই না যে, ঝামেলা হলেই মুখ লুকাবেন বইয়ের পাতায়। বই পড়বেন কমন সেন্স বাড়ানোর জন্য। যে কোন সমস্যা সমাধানে কমন সেন্সই হচ্ছে প্রধান হাতিয়ার। আর কমন সেন্স বাড়ানোর প্রথম রাস্তা হলো সাধারন জ্ঞান বাড়ানো। বই ছাড়া সাধারন জ্ঞান নিজে নিজে কিভাবে বাড়াবেন বলুন? আপনি তো মুখচোরা।
ওহ আসল কথার উত্তর দিতেই তো ভুলে গেছি। ‘টাকা!’ মুজতবা সাহেব মোক্ষম একটা কথা বলে গিয়েছিলেন এ প্রসঙ্গে- ‘বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না।
বই তো আর ফ্রি ফ্রি দেবে না কেউ। তাহলে এত কচকচানির দরকারটা কি ছিলো? বই কিনবে কারা? উত্তরটা ‘বই পড়া’ প্রবন্ধটা পড়লেই পেয়ে যাবেন। অলসদের জন্য তুলে দিচ্ছি- ‘ভেবে-চিন্তে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে বই কেনে সংসারী লোক। পাঁড় পাঠক বই কেনে প্রথমটায় দাঁতমুখ খিচিয়ে, তারপর চেখে চেখে সুখ করে করে, এবং সর্বশেষে সে কেনে ক্ষ্যাপার মত, এবং চুর হয়ে থাকে তার মধ্যিখানে'
আপনার টাকা নেই, বাজার করতে গিয়ে, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিতে গিয়ে, বুয়ার-টিউটরের বেতন দিতে গিয়ে টাকা মেলাতে হিমশিম খান? তো সমস্যা কি? লাইব্রেরি আছে কি করতে? হাজারে বিজারে লাইব্রেরি-বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তো আছেই আপনার জন্য। সদস্য হয়ে শুরু করুন। সদস্য হওয়ার জন্য যেই ফী লাগবে সেটা রিকশায় না গিয়ে একদিন হেঁটে চলাচল করলেই হয়ে যাবে। অজুহাত দেবেন না। ইচ্ছে থাকলে উপায় করে নেয়াই যাই। জ্যামে পড়ে থাকলে গাড়িতে হেডফোন কানে না দিয়ে দশপাতা পড়ে ফেলুন। কাকরাইল কিংবা কাকলী মোড়ের জ্যাম কখন ছুটে গেছে খেয়ালই করতে পারবেন না।
বই পড়ার অভ্যাস না থাকলে কিংবা রিডার্স ব্লকে থাকলে অথবা মরচে পড়ে যাওয়া অভ্যাস হলে অল্প অল্প করে পড়ুন। দরকার হলে একপাতা একপাতা করে। একদিনেই কেউ লর্ড অফ দ্যা রিংস-ওডিসি-মহাভারত কিংবা দূরবীন-সাতকাহন-গীতাঞ্জলি শেষ করতে বলছে না। অধৈর্য্য হবেন না
পড়ুন। পড়তে উৎসাহ দিন। আর উৎসাহ না দিলেও নিরুৎসাহিত করবেন না।
আমার নিজের কথা একটু বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
ছোট বেলায় বই পড়ার হাতে খড়ি হয় চুরি করে তিন গোয়েন্দা দিয়ে। তারপর দেশীয় উপন্যাস গুলোতে হাত পড়ে। বিদেশী লেখকদের সাহিত্য কমই পড়া হয়েছে। নির্দিষ্ট কোন লেখকের বই ধরে ধরে পড়া হয়নি। যখন যারটা পেয়েছি কিংবা চুরি করেছি অথবা ধার করেছি(কারো বই গাপ করে দিইনাই এই পর্যন্ত)- হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, লিও টলস্টয়, চার্লস ডিকেন্স, এডগার রাইজ বারোজ, এডগার এলান পো, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, এরিক মারিয়া রেমার্ক, মারিও পুজো, পাওলো কোয়েলহো, জুল ভার্ন, ড্যান ব্রাউন কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, বিভুতিভুষণ বন্দোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ুন আহমেদ, রকিব হাসান, কাজী আনোয়ার হোসেন, জাহানারা ইমাম - নাম নিতে নিতে ভুলে যাচ্ছি। একটা সময় বই পড়তে পড়তে নেশা এমন হয়ে গিয়েছিলো যে পড়ার কিছু না পেলে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের রচনা অংশটাই পড়তাম। যাই হোক- গত চার পাঁচ বছরে বই পড়ার অভ্যাসটা বলতে গেলে ‘নাই’ হয়ে গিয়েছিলো ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম-মেসেঞ্জার-সিনেমা আর টিভি সিরিজের চাপে। ইদানিং নষ্ট হয়ে যাওয়া সময় গুলোর কথা মনে করে অনুতপ্ত হচ্ছি আর মনের বদ্ধ দুনিয়া খোলার চেষ্টা করছি এক গাদা বই কিনে। জমানো টাকার মোটামুটি সিংহভাগ শেষ এগুলোর পেছনে কিন্তু আফসোস নেই। আফসোস হচ্ছে এতদিন বই থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার জন্য আর বই কেনার মত পর্যাপ্ত টাকা না থাকার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৭ ভোর ৪:০৯