আল কুরআনের বিপরিতে নিরপেক্ষ রেফারেন্স ?
গেল সপ্তাহে ‘রামাদ্বান: প্রত্যাশা পূরনে প্রচেষ্টা প্রয়োজন’ শীর্ষক একটা লেখায় প্রিয় রাসুল সা: কর্তৃক আল্লাহর নির্দেশে চাঁদ দ্বিখন্ডিত করে দেখানোর কথা লিখেছিলাম। লিখেছিলাম সেই ঘটনা নিয়ে একজন ব্রিটিশ অমুসলিম এর ইসলাম গ্রহনের মাধ্যমে দাউদ মুসা’তে রুপান্তরিত হবার কথা। আর সেই সাথে বিবিসি টিভিতে প্রচারিত ডকুমেন্টারির উল্লেখও ছিল উক্ত লেখায়। লেখাটা পড়ে ‘নাজমুস’ নামক জনৈক পাঠক কাম ব্লগার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছেন। তিনি আল কুরআন আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে একটি মন্তব্যও জুড়ে দিয়েছেন ঐ একই ব্লগে। তার উক্ত মন্তব্যটি সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে দিলাম। পাঠকের মন্তব্যটা সরাসরি আল কুরআন আর সামগ্রিকভাবে মুসলমান এর বিরুদ্ধে নিখাঁদ বিষোদ্গার ছাড়া আর কিছুই নয়্। এর একটা জবাব দেয়া দরকার। দরকার এই কারনে যে, ‘আল কুরআন, আর আল কুরআনের কারণেই মুসলমানদের পশ্চাৎপরতা’ এ রকম অভিযোগ নিয়ে বিষোদ্গার সহ্য করাটা একটা পাপ। আল কুরআনের অবমাননা। এটা কারো পক্ষেই, কোন মুসলমান এর পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়, উচিৎও নয়।
আমার নিবন্ধটা পড়ে মুসলিম নামধারী পাঠক জনাব ‘নাজমুস’ তার মন্তব্যে লিখেছেন ‘চাঁদের ব্য্যপারটা ভিত্তিহিন। আপনি কোন রেফারেন্স (নিরপেক্ষ) দেখাতে পারবেন না। আর কুÍআন বুঝে বা না বুঝে যে ভাবেই পড়া হোকনা কেন, মুসলমান জাতি কখনই উন্নতি লাভ করতে পারবেনা, কেননা অন্ধত্ব কখনই আলো আনতে পারেনা। মুসলমানরা শুধু চিন্তা করে কুরআনে কি আছে না আছে, কোথাও ধর্ম আঘাত প্রাপ্ত হলো না হলো। আর নাসারারা কিছু আবিস্কার করলে মুসলমানরা সেটা কুরআনে খুজে পায়, আগে নয়। আপনার ধর্মানূভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকলে দু:খিত।’
এই হলো সেই পাঠকের মন্তব্য। এই মন্তব্যের শেষের বক্তব্য, ‘ আর নাসারারা কিছু আবিস্কার করলে মুসলমানরা সেটা কুরআনে খুজে পায়, আগে নয়।’ এইটুকুর সাথে আমি একমত। অন্তত আজকের বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে মুসলমানদের সামগ্রিক পশ্চাৎপরতা আর ইসলামের প্রতি মুসলমানদের অমার্জনীয় উদাসীনতা বিবেচনায় বক্তব্যের ঐ অংশটুকুর সাথে একমত না হয়ে কোন পথ নেই, তাই আমি একমত। কিন্তু তার বক্তব্যের প্রথম অংশটুকু নিরেট কুরআন আার মুসলিম বিদ্বেষপ্রসূত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যদি উক্ত বক্তব্যের প্রতিটি ছত্র ইতিহাস থেকে তথ্য উপাত্ত আর বিজ্ঞান এর গবেষনালব্ধ জ্ঞানের আলোকে বিবেচনা করে দেখি, তবে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হবে।
কিন্তু তাতেওতো কোন লাভ হবেনা। কারণ, আল কুরআন এ বর্ণিত বানী নিয়ে যারা কোন গবেষনা করেনা কিন্তু তার ভূল ধরতে উঠে পড়ে লাগে, এর মধ্যে কোন সত্য খোঁজেনা, খোঁজে কোথায় কোন ভূল (!) আছে, খোঁজে কোন আয়াতের কোন বিকৃত অর্থ করা যাবে এবং সেই বিকৃত অর্থ দিয়েই কুরআন কিংবা হাদিসের মধ্যে ভূল (!) ধরে দেয়া যাবে, যাবে মুসলমানদের এক হাত নেয়া, তাদেরকে করা যাবে হেয়, দেখানো যাবে, তারা কতটা মুর্খ! আর নিজেরা কতটা প্রগতীবাদী, কতটা বিজ্ঞ আঁতেল! তাদের অন্ধত্ব ঘুঁচবেনা বরং বাড়বে, এটাই আল্লাহর ফয়সালা।
যাদের প্রয়োজন প্রমান, তাঁরা একবার কেবল কুরআনের পাতা খুলেই দেখে নেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কি বলেছেন, সেটা জানার জন্য্। কারণ আল্লাহর চেয়ে সত্যবাদী আর কে হতে পারেন? আল কুরআনে যখন কোন বিষয়ে সমাধান না পাওয়া যায়, তখন তাঁরা তার উত্তর খোঁজ করেন প্রিয় রাসুল সা: এর হাদিসে, সেখানেই তারা প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। রাসুল সা: এর জীবন, তাঁর বানী, আর তাঁর পবিত্র সাহাবী রা: গনের জীবন, কর্ম পদ্ধতি থেকেই উত্তর পাওয়া যায়্। আর সেখানেও যদি কোন উত্তর না পেয়ে থাকেন, তবে তাঁরা এর উত্তর খোঁজেন উম্মাহর ইজমায়। বিশ্বে এগুলোই হলো সবচেয় বড়, অকাট্য, ও সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স।
কিন্তু তার পরেও সমস্যা আছে। আজ কাল মুসলমান ছেলে মেয়েরা, বিশেষ করে নব প্রজন্ম, প্রতিটি ক্ষেত্রেই রেফারেন্স চায়, এমন কি আল কুরআনের বিপরিতেও। প্রমান চায় কুরআন হাদিসের বানীর সত্যতা নিয়ে! সংশয়বাদীতার কবলে অক্টোপাশের মত করে সবাই যেন বাঁধা পড়ে আছে। যদি রেফারন্স দেনও, তবে তা আবার নিরপেক্ষ কিনা, সে প্রশ্নও উঠবে যথাসময়ে এবং খুবই কৌশলে। কে নিরপেক্ষ, আর কে নিরপেক্ষ নয়, সেটা আবার কে নির্ধারণ করে দেবে? আমার কাছে যে নিরপেক্ষ বলে প্রতিয়মান হবে, সেই একই সোর্স আর একজনের কাছে নিরপেক্ষ বলে বিবেচিত নাও হতে পারে এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। এরকম একটা খপ্পরে পড়ে পুরো মুসলমান জনগোষ্ঠির তরুণ প্রজন্ম আজ দিশেহারা হয়ে আছে। তবে কর্মহীন বসে নেই। তারা খুবই কর্মতৎপরতার সাথে নিজেদের সগোত্রীয় মুসলিম তরুণ যুবকদের একইভাবে ধর্মের প্রতি, আল কুরআন আর ইসলামের প্রতি সন্দিহান করে তুলছে।
যাহোক, জনাব নাজমুস রেফারেন্স এর কথা বলেছেন, তিনি ‘নিরপেক্ষ রেফারেন্স’ চেয়েছেন। বোধ করি নিরপেক্ষ বলতে তিনি ইসলামের সম্পর্ক নেই, এমন কোন রেফারেন্স চেয়েছেন। এমন কোন রেফারেন্স চেয়েছেন যেখানে আল কুরআন এবং হাদিসের কোন সম্পর্ক নেই। কারণ আল কুরআন আর হাদীস, এগুলো এখনকার প্রগতীবাদী মুসলমান (?) দের দৃষ্টিতে আর নিরপেক্ষ নেই! অতএব আল কুরআন বা রাসুল সা: এর হাদিস থেকে কোন রেফারেন্স দেবনা। সেদিকেও যাবনা কারণ আমাদের এই সব নব প্রজন্ম কুরআন এর কথা শুনলেই জ্বলে উঠে তেলে বেগুনে। অতএক্ষ সেদিকে গিয়েও কোন লাভ হবেনা। আমরা বরং নিরপেক্ষ(?) সোর্স থেকেই রেফারেন্স দেব।
সবচেয়ে সহজ সোর্সগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নাসা’র ওয়েব সাইট, গুগল সার্চ এ ‘রকি বেল্ট অন দ্যা মুন ’ লিখে সার্চ দিলেই ছবি সহ চলে আসবে বিরাট বিরাট সব প্রবন্ধ, গবেষনা ফলাফল, প্রশ্ন, নিবন্ধ, আর আর্টিকেল। বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীদের মতামত, সর্বশেষ গবেষনার তথ্য, উপাত্ত ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে বিবিসি’র ওয়েবসাইটে পুরোনো দিনের সব ডকুমেন্টারির ভান্ডার, আজও তাদের আর্কাইভে আজও রক্ষিত আছে সেই সব টি ভি প্রোগ্রামের তথ্য, আলোচনা আর ডকুমেন্টারিগুলো।
চাঁদ যে দ্বিখন্ডিত হয়েছিল তা’র সাহিত্যিক ও সামাজিক ইতিহাসও রয়েছে প্রাচীন আরবীয় সাহিতের পাতায়। সে সময়ে যাঁরা জীবিত ছিলেন এবং যাঁরা তা নিজ চোখে দেখেছেন তাদের জবানীতেই সে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। হয়ত বলবেন, সেটা ইসলামের ইতিহাস। অতএব সেটা নিরপেক্ষ নয়। তাই নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক রেফারেন্স চাই।
ঐতিহাসিক, নিরপেক্ষ হিসেবে আরও একটা সোর্স দেই, দেখুন। দক্ষিন ভারতের রাজা চেরুমল আর তার ভাই পেরুমল. দাক্ষিনাত্যের দুই রাজা, দুই সহোদর ভাই প্রিয় রাসুল সা: কর্তৃক চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার রাতে সভাসদ পরিবেষ্ঠিতাবস্থায় রাজপ্রাসাদের ছাদে বসে অবাক বিষ্ময়ে নিজেদের চোখেই দেখেছিলেন, বিষ্মিত হয়ে রাজজোতীষ্যের শরণাপন্ন হয়েছিলেন, রাজকীয় জোতীষিসহ হিন্দু ধর্মীয় যাজকরা বেদ, ত্রিপিটক থেকে উ্দ্ধৃতি দিয়ে দুই রাজাকে জানিয়েছিলেন, আরবের মরুভূমীতে নিশ্চয়ই সেই শেষ নবী, অবতার আগমন করেছেন, তিনিই এমনটা করবেন, সেটা আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে আগেই বর্ণিত হয়েছে! জোতীষ্যি এবং ধর্মগুরুর মুখে একথা শুনে এবং স্বয়ং নিজেদের চোখে চাঁদ দিখন্ডিত হতে দেখে রাজা চেরুমল তার সহোদর ভাই পেরুমলকে রাজ্যের দেখাশোনা করার ভার দিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন ম্ক্কার উদ্দেশ্যে, আরবের সেই নবী’র দেখা পাবার জন্য। তিনি স্বশরীরে প্রিয় নবীজি সা:’র সাথে দেখা করে তাঁর প্রতি ঈমান এনে মুসলমান হয়ে সেখানে প্রায় তিন বৎসর বসবাস করেন। এর পরে নিজে দেশে ফেরত এসে তারই ভাই পেরুমলকেও আবার সেই নবীর কাছেই পাঠান। গবেষকদের গবেষনায় তা বেরিয়ে পড়েছে দাক্ষিনাত্যের প্রাচীন সাহিতের পাতা থেকে। যাদের প্রয়োজন, তারা একটু সময় ব্যয় করে, পরিশ্রম করে বিষয়গুলো দেখে নিতে পারেন।
আমরা যারা মুসলমান তাদের অবশ্য কোন রেফারেন্স দরকার নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় রেফান্সে হিসেবে আমরা মেনেই নিয়েছি আল কুরআনের সুরা ক্বামার এর প্রথম আয়াত, যেখানে বলা হচ্ছে ‘কেয়ামতের সময় ঘনিয়ে এসেছে এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে’ (সুরা ক্বামার আয়াত-১)। আমরা মেনে নিয়েছি বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ সহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত ডজন ডজন হাদিস, যেখানে রাসুল সা: এর এই মোজেজা নিয়ে ব্যাপক বর্ণনা এসেছে। একেবারে সুষ্পষ্ট বর্ণনা। এত কিছুর পরেও যখন কোন মুসলমান কুরআনের বানীর বিপরিতে নিরপেক্ষ কোন রেফারেন্স খোঁজেন, তখন তাদের ঈমান(?) নিয়ে আর কোন সংশয় থাকেনা। আবারও বলছি, আমাদের কোন রেফারেন্স এর দরকার নেই কুরআনের বিপরিতে। বিশ্বের কোন মুসলমানই আল কুরআন আর হাদীসের বিপরিতে রেফারেন্স চাইতে পারেন না। এমনটা চাইলে তিনি আর মুসলমানই থাকতে পারেননা। এই যদি কুরআন আর রাসুল সা: এর হাদিসের উপরে ঈমান হয়, তা হলে মুনাফিক আর কাকে বলে?
এবারে আসি জনাব নাজমুস এর পরামর্শের প্রতি, তিনি বলেছেন ‘আর কুÍআন বুঝে বা না বুঝে যে ভাবেই পড়া হোকনা কেন, মুসলমান জাতি কখনই উন্নতি লাভ করতে পারবেনা, কেননা অন্ধত্ব কখনই আলো আনতে পারেনা।’ আমরাও সে কথাই বলি। আসলেই, অন্ধত্ব কখনই আলো বয়ে আনতে পারেনা। আল কুরআনও সেই কথা-ই বলে। আল কুরআন আমাদের আরও জানিয়ে দিয়েছে যে, আল্লাহর রাব্বুল আলামীন কোন কোন মানুষের চোখ, কান, অন্তর, তাদের চিন্তা-চেতনার উপরে, তাদের উপলব্ধির উপরে আচ্ছাদন দিয়ে দেন। তারা কান থেকেও বধীর, চোখ থেকেও অন্ধ হয়। তা না হলে জনাব নাজমুস দেখতে পেতেন ইতিহাসের পাতা থেকে, ইসলাম কিভাবে একটা অশিক্ষিত, বর্বর, যাযাবর, নেতৃত্বহীন আরব জাতিকে তার অধ:পতিত দশা থেকে মাত্র চারটি দশকের মধ্যে তুলে এনে শিক্ষা, সংস্কৃতি সুখ সাফল্য আর সমৃদ্ধির কোন সুউচ্চ স্তরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। দেখতে পেতেন, আল কুরআন কিভাবে একটা পশ্চাৎপর জাতিকে অপরাজেয় করে তুলেছে, দেখতে পেতেন, কিভাবে আল কুরআন বিশ্বসভ্যতা’কে বিগত দেড় হাজার বৎসর ধরে প্রভাবিত করে রেখেছে। আজও বিশ্ব কুরআনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কাল কেয়ামত পর্যন্ত সে তা পারবেও না।
আর আজ মুসলমানরা যে পশ্চাৎপর অপমানিত আর উপেক্ষিত, এর অন্য কোন কারণ নেই, মাত্র একটা কারণ ছাড়া। আর সেই কারণটি হলো, আল কুরআনকে তারা ছেড়ে দিয়েছে। আল কুরআন এর কিছু অংশ তারা মানে, আর কিছু অংশকে তারা করেছে অস্বীকার। আর এর পরিণতি যে হবে অপমান, জিল্লতী সে কথাটা কুরআনুল কারিমে আল্লাহ পাক সেই দেড় হাজার বৎসর আগেই বলে দিয়েছেন। রেফারেন্স চাইলে তা দিতে পারি, আল কুরআনের সুরা বাকারা’র ৮৫ নাম্বার আয়াতটি একবার খুলে দেখে নিতে পারেন।
কাজেই এ কথাটাই সত্য যে, আল কুরআন এর একনিষ্ঠ অনুসরণ ছেড়েই মুসলমানরা পশ্চাৎপর। আজ আবার সেই জাতিকে কুরআন ছাড়ার প্রেসক্রিপশন দেয়াটা একমাত্র কোন অমুসলিম কিংবা মুসলিম ছদ্ববেশী মোনাফেক এর পক্ষেই সম্ভবপর হতে পারে। আর আমরা সে ব্যপারে পুরোমাত্রায় সচেতন। আমরা বরং আসন্ন রমজান মাসে এ কথাটাই নিজেদের কাছে বিশ্লেষন করে উপলব্ধির চেষ্টা করব যে, সত্যিকার অর্থেই আমরা আল কুরআন থেকে কতটা দুরে সরে গেছি? আর কিভাবেই বা সেই দুরত্ব কমিয়ে আনা যায়? আমাদের আগামি দিনের সফলতা এর উপরেই নির্ভর করছে। আসুন রমজানের প্রারম্ভে সে প্রস্তুতিই নেই।