কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই জ-ত্লং বেশ সহজে সামিট করে আসার পর আমরা ভাবলাম যে যোগীহাফং ও সহজেই সামিট করে আসতে পারবো। গাইডও বললো যে যোগীহাফং যেতে ৩ ঘণ্টা লাগবে এবং ফিরে আসতে একটু কম সময় লাগবে। পথও জ-ত্লং এর মতই। আমরা ভাবলাম রাতে একটু বেশি ঘুমিয়ে সকালে দেরী করে রওনা দিলে কোন সমস্যা হবে না। আমরা আগেই জেনে এসেছিলাম যে যোগীহাফং এর ৪টি চূড়া রয়েছে। আসলে একটি আসল পিক এবং ৩টি সাব পিক। ৪র্থ চূড়াটির উচ্চতা সবচেয়ে বেশি হলেও বেশির ভাগ মানুষই প্রথম দুটো পিক সামিট করে চলে যান। কারণ শেষের দুটো চূড়ায় যাওয়ার পথ বেশ বিপদজনক। ফলে এত কষ্ট করে এসেও অনেকেই যোগীহাফং এর প্রকৃত চূড়ায় যেতে পারেন না। যাই হোক, আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে শেষ পর্যন্তই যাবো।
যোগী হাফং এর সর্ব্বোচ্চ চূড়া থেকে করা আমাদের ভিডিও...
২৩/০২/১৭
সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমাদের দেরিই হয়ে গেল। যখন আমরা দলিয়ান পাড়া হতে যোগী হাফং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম তখন ঘড়িতে ৭ টা বাজে। দুই বন্ধু একটু অসন্তুষ্ট হল অযথা দেরী করার জন্য। দলিয়ান পাড়া থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর পাহাড় থেকে নিচে নামার সময় হঠাৎ করেই আমাদের গাইড থেমে গেল। দূর থেকে কিছু কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমরা। গাইড কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ বলে উঠল সবাই দৌঁড়ান। কি করবো বুঝে উঠতে না উঠতেই আমরা গাইডের পিছনে উল্টা দিকে দৌঁড় দিলাম। কিছুদূর দৌঁড়ানোর পর আমরা একটা ঝোঁপের আঁড়ালে অন্যদিকের একটা পথে ঢুকে গেলাম। বেশ কিছুটা পথ দৌঁড়ানোর পর নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে আমরা একটু থামলাম। গাইডকে বললাম কারা আসছিল তখন। গাইড বললো উনারা বিজিবির সদস্য ছিল। তারা আমাদের দেখতে পেলে সোজা ঢাকাতে পাঠিয়ে দিত। আমরা কিছুটা কৌতুকবোধ করলাম। পাহাড়ে এসে আমাদেরকে বিজিবির হাত থেকে পালানোর জন্য দৌঁড়াতে হচ্ছে।
যোগীহাফং এর সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় আমরা। ডান থেকেঃ Zahidul Islam Jewel, Zahid Tuhin, Our guide Lal Tha Khum, Oaliul Islam Piash, Mahdi Al Masud
তবে এরপরেই গাইড আমাদেরকে খারাপ সংবাদ দিলো। যোগীহাফং যাওয়ার জন্য জুমের ভিতর দিয়ে সোজা পথটা নতুন বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে গিয়েছে। সেই পথে গেলে বিজিবির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। আর বিজিবির মুখোমুখি হওয়া মানে আর যোগূ হাফং সামিট করা হবে না। গাইড বললো এক্ষেত্রে আমাদেরকে ঘুরপথে ঝিরির ভিতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এপথে সময় অনেক বেশি লাগবে এবং ঝিরিপথ টাও নাকি অনেক দুর্গম। আমরা চাইনি আমাদের প্ল্যান বিজিবির কারণে বাতিল হোক। আমরা ঝিরিপথের ভিতর দিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এরপর শুরু হল এক দীর্ঘ ঝিরি পথের যাত্রা। লোহ ঝিরি দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরেই ঝিরিটা পড়বে। খুব সম্ভবত ঝিরিটার নাম যোগী ঝিরি। ঝিরি পথ দিয়ে যাওয়ার সময়েই বুঝলাম এই পথে মানুষের যাতায়াত অনেক কম। আমার দেখা সবচেয়ে ওয়াইল্ড ঝিরি পথ ছিল এটা। কয়েক জায়গায় বন্য হরিণ, ভালুক প্রভৃতি শিকারের ফাঁদ দেখলাম। উল্লেখ্য আজ আমাদের সাথে দুজন ভিন্ন গাইড ছিল। তাদের মধ্যে একজন দলিয়ান পাড়ার প্রসিদ্ধ শিকারী। খুব সম্ভবত তার নাম ছিল লাল থা খুম। আরেকজন গাইডের নাম ছিল লিয়াং সাং। তারাই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। একটা যায়গায় গিয়ে দেখলাম একটা বন্য হরিণ ফাঁদে আটকা পড়ে উল্টা হয়ে ঝুলে রয়েছে। হরিণের শরীর থেকে খুব গন্ধ আসছিল। বুঝলাম যে হরিণটি বেশ কয়েকদিন ধরেই মৃত অবস্থায় ঝুলে রয়েছে। তারা ফাঁদ পাতার সাধারণত ২-৩ দিন পর আসে দেখতে। খারাপই লাগলো হরিণটার জন্য। এটা আর কোন কাজে আসবে না।
গভীর জঙ্গলে বন্য হরিণ, ভালুক প্রভৃতি ধরার ফাঁদঃ
যোগী ঝিরি আমাদেরকে ক্লান্ত করে ফেলল। আমরাও থেমে থেমে আমাদের পানির বোতল ভরে নিচ্ছিলাম। এবং সাথে থাকা হালকা খাবার খাচ্ছিলাম। সেই সময়টা নিয়ে আমরা ভয়ে থাকি যখন গাইড বলবে যে এটাই পানির শেষ সোর্স। যথাসময়ে গাইড ছোট একটা পানির ধারা দেখিয়ে বলল যে এর পরে আর পানি পাওয়া যাবে না। গাইড ছোট একটা বাঁশ কেঁটে পানির ধারাকে বোতলে ভরার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা ওয়াইল্ড যোগীঝিরি ধরে এগিয়ে চললাম।
আমাদের শেষ পানির উৎসঃ
রিজলাইন ধরে এভাবে বিপদজনক পথে চূড়ার দিকে যেতে হবে। ছবিটি ফিরে আসার সময় ৩য় থেকে ২য় চূড়ার দিকে যাওয়ার সময় তোলা।
অনেকটা পথ পার করার পর এবার আসলো ঘন বাঁশের জঙ্গল। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম যে অবশেষে যোগীঝিরি শেষ হল। ঘন বাঁশের জঙ্গলে আমাদেরকে ধীরে আগাতে হচ্ছিল। এভাবে বাঁশের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাওয়াটা শুধু ক্লান্তিকরই না বরং বিরক্তিকর। সম্ভবত বাঁশের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছিল। এরপর প্রথম চূড়ায় চলে আসলাম আমরা। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে দ্বিতীয় চূড়ায় চলে আসলাম। সেখানে কিছু সামিট নোট দেখলাম। এবার গাইডের মাঝে শুরু হল কনফিউশন। সে বলল সামনের পথ অনেক রিস্কি। যাওয়া ঠিক হবে না। আমরাও সেটা দেখতে পেলাম। তারপরও সিদ্ধান্ত নিলাম ধীরে ধীরে হলেও সবাই একসাথে যাবো। যতদূর যাওয়া যায়। ২য় থেকে ৩য় চূড়া এবং ৩য় থেকে ৪র্থ চূড়া পর্যন্ত খুব সরু রিজলাইন ধরে যেতে হবে। দুইপাশ খাড়া হয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। এক পাশে মিয়ানমার। অন্যপাশে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের দিকের অংশটা একেবারেই খাড়া হয়ে সরাসরি নিচে নেমে গিয়েছে। আমরা বসে বসে একটু বাংলাদেশের দিকে ঝুকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এভাবে অবশেষে আমরা ৪র্থ চূড়ায় যেতে পারলাম। খুব সম্ভবত তখন ১২টা বা ১২:৩০ বাজে। চূড়ায় যেয়ে আমরা এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলাম। অন্যরকম ভালোলাগা। দূরে দেখা যাচ্ছে পাশাপাশি সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে মোদক রেঞ্জের আয়ানক্লাং এবং জ-ত্লং। আমাদের জিপিএস ডিভাইসে যোগী হাফং এর সর্ব্বোচ্চ উচ্চতা পেয়েছিলাম ৩২৫৯ ফুট। সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় গিয়ে আমরা একটা নাম দেখে ইমোশনাল হয়ে গেলাম। সর্ব্বোচ্চ বা ৪র্থ চূড়াতে কোন সামিট নোট আমরা দেখতে পাইনি। শুধু একটা নাম লেখা লেমিনেটিং করা কাগজ পেলাম। নামটা ছিল তারিকুল আলম সুজন। আগেরদিন জ-ত্লং এর উপরে আমরা পেয়েছিলাম তাশদিদ রেজওয়ান মুগ্ধ ভাইয়ের নাম। উলেখ্য, ২০১২ সালে সুজন ভাই, মুগ্ধ ভাই, মাইনুল ভাই, সালেহীন আরশাদী ভাইরা যোগী হাফং এবং জ-ত্লং একসাথে সামিট করেছিলেন। তারপর থানচি থেকে বান্দরবান আসার সময় এক মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় সুজন ভাই এবং মুগ্ধ ভাই মারা যান। আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। তাদের নাম ভ্রমণপিপাসু মানুষের মন থেকে কখনো মুছে যাবে না।
সম্ভবত ২য় চূড়ার উপরে আমরা।
যোগী ঝিরির একাংশ..
চূড়া যত কাছে আসবে ততই এভাবে ঘন বাঁশের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেতে হবে...
আমরা আমাদের সামিট নোট রেখে আসলাম। এরপর আসার আগে সর্ব্বোচ্চ চূড়াতে বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে দিয়ে আসলাম। ফিরে আসার সময় আমরা অপেক্ষাকৃত সোজা জুমের পথ দিয়ে আসলাম। এই পথে ৩২০০ ফুট থেকে প্রায় ২৪০০ ফুট পর্যন্ত ঘন বাঁশের জঙ্গল দিয়ে নামতে হবে। তারপর মোটামুটি সহজ জুমের পথ। জুমের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা পর্যায়ে আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে গেলাম। সাথে থাকা খাবারও সব শেষ। শুধু একটু পানি এবং শুকনো নুডলস ছিল। কিন্তু নুডলস রান্না করার জন্য আগুন ছিল না আমাদের কাছে। অগত্যা রান্না ছাড়াই নুডলস পানি দিয়ে খেয়ে ফেললাম সবাই। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে যখন আমরা দলিয়ান পাড়াতে ফিরে আসলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে জুয়েল এর পা মচকে গিয়েছিল। সে আরো এক ঘণ্টা পরে ফিরে আসলো।
সর্ব্বোচ্চ চূড়াতে আমাদের জিপিএস রিডিং...
যোগী হাফং এর ৩য় চূড়া থেকে করা ভিডিও...
যোগী হাফং এর ২য় চূড়া থেকে করা ভিডিও...
এভাবে সফলভাবে আমাদের জ-ত্লং এবং যোগী হাফং এক্সপিডিশন সম্পন্ন হল। ঢাকায় থাকার সময় বিভিন্নভাবে আমাদেরকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রাতুল বিডি ভাই, সালেহীন আরশাদী ভাই এবং নিজাম ভাই। তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। জ-ত্লং ও যোগী হাফং নিয়ে খুব একটা লেখা চোখে পড়ে না। বিশেষকরে যোগীহাফং নিয়ে কোন লেখা পাওয়া যায় না। দুর্গম এলাকায় অবস্থিত অন্যতম শীর্ষ এ পাহাড়দুটো সব সময় আমাদেরকে নস্টালজিক করে রাখবে। আমাদেরকে স্মৃতিকাতর করে রাখবে অতীতের পথে। আবার হাতছানি দিয়ে ডাকবে...
যোগী হাফং এর চূড়া থেকে মিয়ানমারের পাহাড়ের দৃশ্যঃ
ধন্যবাদ সবাইকে। হ্যাপি ট্রাভেলিং।
জ-ত্লং নিয়ে প্রথম পর্বের লেখাটিঃ
জ-ত্লং (Jow Tlang) এবং যোগী হাফং (Jogi Haphong) এর পথে
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:১৪