পাহাড় প্রেমীদের কাছে জ-ত্লং এবং যোগী হাফং পরিচিত দুটি নাম। আন অফিশিয়ালি জ-ত্লং বাংলাদেশের ২য় সর্ব্বোচ্চ পাহাড় এবং যোগী হাফং বা কংদুক ৪র্থ সর্ব্বোচ্চ পাহাড়। বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে বেশ দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত মোদক রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত এ পাহাড় দুটি। বাংলাদেশের মধ্যে মোদক রেঞ্জের পাহাড়গুলোর উচ্চতাই সবচেয়ে বেশি। এই রেঞ্জের পাহাড় গুলো সমহিমায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ হতে মায়ানমার কে পৃথক করেছে। অনেকদিনের ইচ্ছা বাংলাদেশের উঁচু পাহাড় গুলো সামিট করা। গতবছর সাকা হাফং সামিট করতে যেয়ে নিরাপত্তাজনিত কারণে থুইসাপাড়া থেকে ফিরে আসতে হয়। এবার অনেক অনিশ্চয়তার কথা মাথায় নিয়েই জ-ত্লং এবং যোগীহাফং সামিট করার জন্য ২০/০২/১৭ তারিখে রাতে আমরা চার বন্ধু বান্দরবান রওনা দেই
২১ তারিখ সকালে বান্দরবান পৌঁছে নাস্তা করে থানচিগামী বাসের টিকেট কাটলাম। থানচি পৌঁছাতে ১২:৩০ বেজে গেল। এরপর ট্রলার রিসার্ভ করে রেমাক্রির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আঁকাবাঁকা খরস্রোতা সাঙ্গু নদী দিয়ে রেমাক্রি পৌঁছাতে দুপুর ২:৩০ হয়ে গেল। সাঙ্গু বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর নদীগুলোর মধ্যে একটি।
সাংগু নদী দিয়ে তিন্দু পার হয়ে রেমাক্রী পর্যন্ত পথটা এদেশের সবচেয়ে সুন্দর পথগুলোর মধ্যে একটা। দুপাশে পাহাড়ে ঢাকা অসংখ্য ছোট বড় পাথরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সাংগু নদীর ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ।এই পথ কখনোই পুরাতন হয় না।
রেমাক্রী তে নামলেই নাফাখুমের গাইডরা আপনাকে ঘিরে ধরবে। তাদেরকে avoid করা ঝামেলার। আমাদের কাছে জিপিএস ডিভাইস ছিল। দলিয়ান পাড়া যাওয়ার ট্রেইলও সেইভ করা ছিল। আমরা সরাসরি রেমাক্রি ফলস এর আপস্ট্রীমে চলা শুরু করি। রেমাক্রী থেকে দলিয়ান পাড়া পৌঁছাতে ৩ ঘণ্টার মত সময় লাগবে। পুরোটাই পাহাড়ি পথ। মাঝে বেশ কিছু পাড়া পড়বে। যেমন পেনেডং পাড়া, কাবু পাড়া, চেহ্লাউ পাড়া। অত্যন্ত সুন্দর সাঁজানো গোছানো এই দলিয়ান পাড়া। দলিয়ান পাড়া গিয়ে আমরা কারবারির ছেলেকে পেয়ে গেলাম। তার সাথে বিস্তারিত কথা বললাম জ-ত্লং এবং যোগী হাফং সামিটের সম্ভাবনা নিয়ে। উনি বললেন এখন নিরাপত্তা নিয়ে কোন ঝামেলা নেই। তবে বিজিবি যেতে দিবে না। যাই হোক, অনেক কথোপকথনের পর উনি আমাদেরকে তাদের পাড়ার দুজন অভিজ্ঞ গাইড ঠিক করে দিলেন। আমাদের আনন্দ তখন দেখে কে। যেই জ-ত্লং নিয়ে এত কথা শুনেছি, এত অনিশ্চিয়তা নিয়ে আসার পর অবশেষে আগামীকাল আমরা সেই জ-ত্লং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিবো।
ছবিতে দলিয়ান পাড়া...
পরদিন ২২/০২/১৭ তারিখে দ্রুত ঘুম থেকে উঠে গেলাম আমরা। সকাল ৬ টায় আমরা চার বন্ধু জ-ত্লং এর উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। সাথে দলিয়ান পাড়ার দুইজন গাইড। জ-ত্লং সম্পর্কে অনেক খোঁজ খবর নিয়ে গিয়েছিলাম আগেই। শুনেছিলাম সর্ব্বোচ্চ দশটা পাহাড়ের মধ্যে এই পাহাড়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন। যাই হোক, পাড়া থেকে কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা লোহ ঝিরিতে চলে আসলাম। শুধু পাথর আর পাথর। অবশ্যই এদেশের সবচেয়ে সুন্দর ঝিরি গুলোর মধ্যে একটা হলো লোহ ঝিরি। হাঁটছি তো হাঁটছিই। লোহ ঝিরি যেন শেষ হবার নয়। মাঝে মাঝে আমরা থেমে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সাথে থাকা চকোলেট কেক খেলাম। ঝিরি থেকে পানির বোতল গুলো ভরে নিচ্ছিলাম মাঝে মাঝে। শেষ ২ ঘণ্টার পথে কোন পানি পাওয়া যাবে না। আমরাও সেরকম পানি সাথে নিয়ে নিলাম।
দলিয়ান পাড়া হতে ভোর বেলায় জ-তলং এর চূড়ার এর দৃশ্য...
লোহ ঝিরি এবং যাত্রা পথের কিছু ছবি...
এভাবে লোহ ঝিরি ছোট বড় পাহাড় বাঁশের জঙ্গল পার হয়ে আমরা যখন জ-ত্লং এর চূড়ায় চলে আসলাম তখন ঘড়িয়ে ১০:৩৪ বাজে। সময় দেখে আমরা নিজেরাই অবাক। ধারণার চেয়ে বেশ দ্রুতই চলে আসলাম আমরা। সাথে আমরা দড়ি নিয়ে এসেছিলাম। সেটাও বের করতে হয়নি। দুই তিনটা জায়গায় বেশ রিস্ক ছিল। সেসব জায়গায় একটু সাবধানে চললে আর কোন সমস্যা হবার কথা না। শুকনো মৌসুম এবং গাইড দুইজনের সাহায্যের জন্যই আমরা এত সহজে আসতে পেরেছিলাম। আমাদের চারজনের মধ্যে একজন এই প্রথম কোন পাহাড়ের চূড়ায় আসলো। তার আনন্দ একটু বেশিই ছিল। জ-ত্লং এর চূড়ায় এসে আগের সামিট নোট গুলো আমরা দেখলাম। আমাদের সামিট নোটও রেখে আসলাম। জিপিএস ডিভাইসে আমরা পাহাড়ের উচ্চতা পেয়েছিলাম ৩৩২৩ ফুট প্রায়। এরপর কিছু ছবি তুলে আবার আমরা দলিয়ান পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
জ-ত্লং এর চূড়ায় আমাদের চার বন্ধুর 'টিম সংশপ্তক' (ভিডিও)...
জ-ত্লং এর চূড়ায় আমাদের চার বন্ধুর 'টিম সংশপ্তক'। ডান থেকে থেকেঃ Zahidul Islam Jewel, Mahdi al Masud, our guide, Zahid Tuhin, Oaliul Islam Piash
একই পথে ফেরত এসে আমরা যখন দলিয়ান পাড়ায় পৌঁছলাম তখন দুপুর সাড়ে তিনটা বাজে। আগের সংগ্রহ করা তথ্য অনুসারে জ-ত্লং পৌঁছাতে ৬-৭ ঘণ্টা লাগার কথা। এবং পাড়ায় পৌঁছাতে নাকি রাত হয়ে যায়। কেউ জ-ত্লং সামিট করতে গেলে এ ব্যাপার গুলো মাথায় রাখতে হবে। বেশ দীর্ঘ পথ। সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার এবং পানি রাখতে হবে। একটু পর পর অবশ্যই ঝিরি থেকে পানির বোতল গুলো ভরে নিতে হবে। আগে একটা দুইটা পাহাড় (যেমন কেওকারাডং, তাজিনডং) সামিট করার অভিজ্ঞতা থাকলেই জ-ত্লং সামিট করা কোন সমস্যা হবে না। তবে অবশ্যই শুকনো মৌসুমে আসতে হবে। বর্ষায় এটা সামিট করা অনেক অনেক কঠিন হয়ে যাবে। ম্যালেরিয়া প্রফাইল্যাক্সিস নিতে হবে। পাহাড়ে বাস করা মানুষদেরকে শ্রদ্ধা করতে হবে। পাহাড়ের পরিবেশ নোংরা করা যাবে না। আর ফুল হাতা গেঞ্জি এবং প্যান্ট পরলে অনেক সুবিধা হবে। বিশেষ করে অনেক আঘাত থেকে বাঁচা যাবে। বিভিন্ন সময়ে আমাদেরকে তথ্য দিয়ে অনেক সহযোগিতা করেছেন রাতুল বিডি ভাই, সালেহীন আরশাদী ভাই এবং নিজাম ভাই। তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
দলিয়ান পাড়া থেকে ১৫-২০ মিনিটের দূরত্বে একটা পাহাড়ের উপরে পুরাতন পরিত্যক্ত বিজিবি ক্যাম্পে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। আমরা সন্ধ্যার পর সেখানে গিয়ে ঢাকায় সবার সাথে কথা বললাম। পাহাড়ের উপর শুয়ে খোলা আকাশের দিকে নিরবে তাকিয়ে তাকার অনুভূতি বলার মত নয়। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত পরিস্কার আকাশে কয়েকবার shooting star দেখলাম। জ-ত্লং এত সহজে সামিট করার পর যোগী হাফং এর কথা আমাদের আর মাথায় আসলো না। কিন্তু তখনো আমরা জানতাম না যে যোগী হাফং আমাদের জন্য কি বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:১৩