ইবনে সিনা : সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান সাধক এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ)
যিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যবসায়ের মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন সারাটা জীবন , এক রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ধন সম্পদ, ভোগ বিলাস ও প্রাচুর্যের মোহ যাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, যিনি ছিলেন মুসলমানদের গৌরব, তিনি হলেন ইবনে সিনা। তার আসল নাম আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি সাধারণত ইবনে সিনা , আবু আলী সিনা নামেই অধিক পরিচিত। ইউরোপে তিনি আভিসিনা (Avicenna) নামে সমধিক পরিচিত, হিব্রু ভাষায় তার নাম Aven Sina।
A drawing of Avicenna from 1271
ইবনে সীনা তুর্কীস্তানের বিখ্যাত শহর বুখারার (বর্তমান উজবেকিস্তান) অন্তর্গত খার্মাতায়েন জেলার আফসানা নামক স্থানে ৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে (মতান্তরে, আগস্ট মাস) জন্মগ্রহণ করেন। আরবি পঞ্জিকা অনুসারে সালটি ছিল ৩৭০ হিজরী। তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম সিতারা বিবি। তার মাতৃভাষা ছিল ফার্সি। তবে সমকালীন অন্যান্যদের মত তিনিও আরবি ভাষাকে জ্ঞান প্রকাশের মূল বাহন হিসেবে গ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল্লাহ ছিলেন বুখারার সামানীয় সম্রাটের অধীনে খোরাসানের শাসনকর্তা। জন্মের কিছুকাল পরেই তিনি ইবনে সিনাকে বোখারায় নিয়ে আসেন এবং তার লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করেন। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্ত করে ফেলেন। তার ৩ জন গৃহ শিক্ষক ছিলেন। তাদের মধ্যে ইসমাইল সূফী তাকে শিক্ষা দিতেন ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ শাস্ত্র আর তাফসীর; মাহমুদ মসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিত শাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক আল না' তেলী শিক্ষা দিতেন দর্শন, ন্যয় শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আল মাজেস্ট, জওয়াহেরে মান্তেক প্রভৃতি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্কল জ্ঞান তিনি লাভ করে ফেলেন। বিখ্যাত দার্শনিক আল না' তেলীর নিকট এমন কোন জ্ঞান আর অবশিষ্ট ছিল না, যা তিনি ইবনে সিনাকে শিক্ষা দিতে পারবেন। এরপর তিনি ইবনে সিনাকে নিজে স্বাধীন মত গবেষণা করার কথা বলেন। এসময় সম্বন্ধে ইবনে সিনা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন:
''যে কোন সমস্যার সমাধান ওস্তাদ যেরুপ করতেন আমি তার চেয়ে ভালভাবে করতে পারতাম। তারঁ কাছে জাওয়াহির মানতিক বা তর্কশাস্ত্রের খনি নামক বইটি পড়ে মুখস্থ করার পর বুঝলাম, আমাকে শেখাবার মত কিছু নতুন আর তার কাছে নেই। তখন বইগুলো আর একবার পড়তে শুরু করলাম। ফলে সকল বিষয়ে আমি বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠলাম। ইউক্লিডের জ্যামিতির (দ্য এলিমেন্ট্স) প্রথম কয়েকটি সম্পাদ্যের সমাধানে ওস্তাদের সাহায্য নিয়ে বাকি কটির সমাধান আমি নিজেই করলাম। টলেমির ১৩ খণ্ডের আলমাজেস্ট বইটি শুরু করে সমস্যার সম্মুখীন হলে ওস্তাদ বললেন, "তুমি নিজে সমাধান করতে চেষ্টা কর, যা ফল দাড়ায় এনে আমাকে দেখাও। আমি বিচার করে রায় দেবো।" একে একে সব সমস্যার সমাধান করে ওস্তাদের সম্মুখে হাজির করলাম। তিনি দেখে-শুনে বললেন, "ঠিক হয়েছে, সব কটিই নির্ভুল সমাধান হয়েছে।" আমি বেশ বুঝতে পারলাম, এ ব্যাপারে ওস্তাদ আমার কাছ থেকে কিছু নতুন তথ্য শিখে নিলেন।''
এভাবে না' তেলী বুঝতে পারলেন তার প্রয়োজন শেষ। এরপর তিনি বুখারা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বুআলী নিজেই এবার নিজের শিক্ষক সাজলেন। এসময় চিকিৎসা শাস্ত্র এবং স্রষ্টাতত্ত্ব সম্বন্ধে তার মৌলিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। এরিস্টটলের দর্শন সম্পূর্ণ ধাতস্থ করেন এ সময়েই। নতুন বই না পেয়ে আগের বইগুলোই আবার পড়তে লাগলেন। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা তার কাছে পড়তে আসত, তরুণ বয়সেই তিনি এবার শিক্ষকতা শুরু করলেন।
Avicenna's tomb in Hamadan, Iran.
এবার তিনি চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত কিতাব সংগ্রহ করে গবেষণা করতে শুরু করেন । ইবনে সিনা তার আত্নজীবনীতে লিখেছেন যে, এমন বহু দিনরাত্রী অতিবাহিত হয়েছে যার মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্য ও ঘুমাননি। কেবল মাত্র জ্ঞান সাধনার মধ্যেই ছিল তার মনোনিবেশ। যদি কখনো কোন বিষয় তিনি বুঝতে না পারতেন কিংবা জটিল কোন বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনই তিনি মসজিদে দিয়ে নফল নামাজ আদায় করতেন এবং সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে বলতেন, ''হে আল্লাহ আমার জ্ঞানের দরজাকে খুলে দাও। জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোন কামনা নেই।'' তারপর গৃহে এসে আবার গবেষণা শুরু করত। ক্লান্তিতে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো স্বপ্নের ন্যায় তার মনের মধ্যে ভাসত এবং জ্ঞানের দরজা যেন খুলে যেত। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠেই সমস্যা গুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন। এ সময় বুখারার বাদশাহ নুহ বিন মনসুর এক দুরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত হন। দেশ এবং বিদেশের সকল চিকিৎসক এর চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়। ততদিনে সীনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায়, বাদশাহের দরবারে তার ডাক পড়ে। তিনি বাদশাহকে সম্পূর্ণ সাড়িয়ে তুলেন। তার খ্যাতি এ সময় দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আরোগ্য লাভের পর বাদশাহ সীনাকে পুরস্কার দেয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। এসময় সীনা চাইলে বিপুল সম্পদ ও উচ্চপদ লাভ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেবল বাদশাহ্র কাছে শাহী কুতুবখানায় (বাদশাহ্র দরবারের গ্রন্থাগার) প্রবেশ করে পড়াশোনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। বাদশাহ তার এ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এভাবেই ইবন সিনা শাহী গ্রন্থাগারে প্রবেশের সুযোগ পান। গ্রন্থাগারের ভিতরে যেয়ে অবাক হয়েছিলেন সিনা। কারণ এমন সব বইয়ের সন্ধান তিনি সেখানে পেয়েছিলেন যেগুলো এর আগেও কোনদিন দেখেননি এবং এর পরেও কখনও দেখেননি। প্রাচীন থেকে শুরু করে সকল লেখকদের বইয়ের অমূল্য ভাণ্ডার ছিল এই গ্রন্থাগার। সব লেখকের নাম তাদের রচনাসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা তৈরির পর তিনি সেগুলো অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। এমনই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে, নাওয়া-খাওয়ার কথা তার মনেই থাকত না। মাত্র অল্প কয়েকদিনে তিনি অসীম ধৈর্য ও একাগ্রতার সাথে কুতুবখানার সব কিতাব মুখস্ত করে ফেলেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোন বিষয় ছিল না যা তিনি জানতেন না। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদতত্ত্ব, চিকিৎসা শাস্ত্র, কাব্য, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে 'আল মজমুয়া' নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন, যার মধ্যে গণিত শাস্ত্র ব্যতীত প্রায় সকল বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
The inside view of Avicenna's tomb in Hamadan, Iran.
১০০১ খ্রিস্টাব্দে পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। এসময় তার বয়স ছিল ২২ বছর। সুলতান নুহ বিন মনসুরও ততদিনে পরলোকে চলে গেছেন। নেমে আসে তার উপর রাজনৈতিক দুর্যোগ। তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হোন। নুহ বিন মনসুরের উত্তরাধিকারী নতুন সুলতান ইবন সিনাকে তার পিতার স্থলাভিষিক্ত করেন। এভাবে সিনা বুখারা অঞ্চলের শাসনকর্তার অধীনে সরকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ছিলেন নতুন। অভিজ্ঞতার অভাবে কার্য সম্পাদনে তাকে হিমশিম খেতে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ট্রান্সঅকসিনিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। খার্মাতায়েনের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে ঐতিহাসিক অক্সাস নদী (আমু দরিয়া) প্রবাহিত হয়ে গেছে যা বুখারা এবং তুর্কীস্তানের মধ্যবর্তী সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। ট্রান্সঅকসিনিয়া তথা খার্মাতায়েনের লোকেরা তাই বেশ দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ছিল। তাদের বিদ্রোহ দমন ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ইবন সিনা এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হন এবং এতে সুলতান তার উপর বেশ বিরক্ত হন। আত্মসম্মানবোধ থেকেই ইবন সিনা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। এই যাত্রায় তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কখনও রাজার হালে থেকেছেন কখনও আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তবে সকল কিছুর মধ্যেও তার মূল অবলম্বন ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের বলেই তিনি সবসময় সম্মানিত হয়েছেন। এর বদৌলতেই চরম দুর্দিনের মধ্যেও আনন্দের দেখা পেয়েছেন।
The first page of a manuscript, authored by Ibn Sina
এবং ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে ইবনে সিনা খাওয়ারিজমে রাজনৈতিক আশ্র্য় গ্রহণ করেন। এ সময়ে খাওয়ারিজমের বাদশাহ ছিলেন মামুন বিন মাহমুদ। সেখানে তিনি পণ্ডিত আল বেরুনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। আল বেরুনির মূল উৎসাহ ছিল ভারতবর্ষ। কিন্তু ইবন সিনা কখনও ভারত অভিমুখে আসেননি। তিনি যাত্রা করেছিলেন পশ্চিম দিকে। তার মূল উৎসাহও ছিল পশ্চিমের দিকে। এ কারণেই হয়তো তার চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলো প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য জগতেও আপন অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। স্বাধীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন সিনা। ১০০৪-১০১০ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি খাওয়ারিজমে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করলেও তার এ সুখ শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইবনে সিনার সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে গজনীর সুলতান মাহমুদ তাকে পেতে চাইলেন। কারণ মাহমুদ জ্ঞানী ব্যাক্তিদের খুব ভালবাসতেন। তাদেরকে দেশ বিদেশ থেকে ডেকে এনে তিনি তার শাহী দরবারে গৌরব বৃদ্ধি করতেন এবং তাদেরকে মণি মুক্তা উপহার দিতেন। এ উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদ তার প্রধান শিল্পী আবু নসরের মাধ্যমে ইবনে সিনার ৪০ খানা প্রতিকৃতি তৈরি করে সমগ্র সিনাকে খুঁজে বের করার জন্য দেশে বিদেশ সুলতান মাহমুদ লোক পাঠিয়ে দিলেন। এছাড়া তিনি খাওয়ারিজমের বাদশাহ মামুন বিন মাহমুদকে পরোক্ষভাবে এ নির্দেশ দিয়ে একটি পত্র পাঠালেন যে তিনি যেন তার দরবারের জ্ঞানী ব্যাক্তিদের সুলতান মাহমুদের দরবারে পাঠিয়ে দেন। আসলে অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে ইবনে সিনাকে পাওয়াই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য।
A Latin copy of The Canon of Medicine, dated 1484, located at the P.I. Nixon Medical Historical Library of The University of Texas Health Science Center at San Antonio, US
ইবনে সিনা ছিলেন স্বাধীনচেতা ও আত্নমর্যাদা সচেতন ব্যাক্তি। ধন সম্পদের প্রতি তার কোন লোভ লালসা ছিল না। কেবলমাত্র জ্ঞান চর্চার প্রতিই ছিল তার আসক্তি। তিনি নিজের স্বাধীনতা ও ইজ্জতকে অন্যের নিকট বিকিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। অন্যায় ভাবে কারো নিকট মাথা ন্ত করতে তিনি জানতেন না। এছাড়া বিনা যুক্তিতে কারো মতামতকে মেনে নিতেও রাজি ছিলেন না তিনি। এমনকি ধর্মের ব্যাপারেও তিনি যুক্তির সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতেন। তাই তৎকালীন সময়ে নেকে তাকে ধর্মীয় উগ্রপন্থী এবং পরবর্তীতে কয়েকজন বিখ্যাত পণ্ডিত তাকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। তারা তাকে ভুল বুঝেছিলেন। আসলে ইবনে সিনা ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। যারা তাকয়ে কাফির বলেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন। এতে তিনি বলেন, ''যারা আমাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করে তারা পৃথিবীতে বিখ্যাত হোক আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমার মত যোগ্য ব্যক্তি তোমরা আর পাবে না। আমি একথাও বলতে চাই যে, আমি যদি কাফির হয়ে থাকি, তাহলে পৃথিবীতে মুসলমান বলে কেউ নেই। পৃথিবীতে যদি একজন মুসলমানও থাকে তাহলে আমিই হলাম সেই ব্যাক্তি।''
An Arabic copy of The Canon of Medicine, dated 1593
গজনীর সুলতান মাহমুদ ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী নেতা। তার প্রতাপে অন্যান্য রাজা বাদশাহ গণ পর্যন্ত ভয়ে কম্পমান থাকতেন। তাই গজনীতে গেলে ইবনে সিনার স্বাধীনতা ও ইজ্জত অক্ষুণ্ণ থাকবে কিনা সে সম্পর্কে সন্ধিহান হয়েই তিনি গজনীতে সুলতান মাহমুদের দরবারে যেতে রাজি হননি। কিন্তু খাওয়ারিজমে তিনি এখন নিরাপদ নন ভেবে ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুন বিন মাহমুদের সহায়তায় সেখান থেকে পলায়ন করে এক অনিশ্চিত পথে রওনা দেন। প্রথমে আবিওয়াদি, তারপর তুস, নিশাপুর ও পরে গুরুগঞ্জ গিয়ে পৌঁছেন। গুরুগঞ্জ শহরে তিনি জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এখানে অবস্থানকালেই চিকিৎসা বিষয়ে তার অমর গ্রন্থ কানুন ফিত্ তিব রচনা করেন। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কিতাব রচনায় নিজেকে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এখানে তার সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে আর শহর থেকে শহরে। কিন্তু তিনি গজনীতে যেতে রাজি হলেন না। অবশেষে তিনি যান রাও প্রদশে। বিভিন্ন কিতাব লিখতে শুরু করেন। কিন্তু এখানেও তার সুখ স্থায়ী হল না। তার জ্ঞান সাধনা ও কিতাব রচনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। ইবনে সিনা এরপর জর্জন নামক স্থানে পালিয়ে যান। সুলতান মাহমুদ এ খবর জানতে পেরে জর্জনের অধিপতিকে ফরমান পাঠান যেন ইবনে সিনাকে হস্তান্তর করা হয়, যেভাবেই হোক; স্বেচ্ছায় আসতে না চাইলে বন্দী করে। কিন্তু ইবন সিনা এবার জর্জন থেকেও পালিয়ে গিয়ে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। এবার তার যাত্রার দিক ছিল ইরান বরাবর। তিনি চলে যান ইরানের সুপ্রাচীন হামাদান শহরে। ইরানে যাওয়ার পথে ইবন সিনা তার সমসাময়ীক কবি ফেরদৌসীর জন্মস্থান বিখ্যাত তুস নগরী পরিদর্শন করেছিলেন।
The oldest copies of Ibn Sina's second volume of "Canon Of Medicine" from the year 1030.
ঐশ্বর্যশালী এবং ঐতিহাসিক হামাদান নগরীটিকে ভাল লেগে গিয়েছিল সিনার। এখানে অনেকদিন ছিলেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বয়সও হয়েছিল অনেক। তাই তিনি মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি খুঁজছিলেন। হামাদানে তিনি এই প্রশান্তি খুঁজে পান। এখানে তিনি ধীর-স্থার মনে চিন্তা করার সময় সুযোগ লাভ করেন। হামাদেনের সম্রাট তার থাকা খাওয়া ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি এখানে চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে স্বাধীন জীবিকা উপার্জন করতেন। এর সাথে তিনি ধ্যান করতেন অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে। এখানেই তিনি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ কিতাব আশ শিফা রচনা করেন। এই বইটি কবি উমর খৈয়ামের খুব প্রিয় ছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটি তার সাথে ছিল বলে কথিত আছে। যাহোক, হামাদানে তিনি অনেক কাজ করার সুযোগ পেয়েছেণ। সারাদিন পরীশ্রেমের পর রাতে তিনি অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সাথে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতেন। সুবিশেষ দার্শনিক প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও গম্ভীর মূর্তিতে বসে থাকা তার স্বভাবে ছিলনা। তাই বলে কখনও আবার আমোদ আহ্লাদে একেবারে মজে যেতেননা। নিজের ধীশক্তি সবসময় সক্রিয় রাখতে পারতেন। কখনই বিস্মৃত হতেননা যে, তিনি একজন জ্ঞানপিপাসু এবং জ্ঞান চর্চাই তার মুখ্য কাজ।
এসময় হামাদানের বাদশাহ শামস-উদ-দৌলা মারাত্নক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে ৪০ দিন চিকিৎসা করে তাকে মুমূর্ষ অবস্থা থেকে সুস্থ করে তোলেন। এতে সম্রাট আরোগ্য লাভ করেন। এই চিকিৎসায় খুশি হয়ে সম্রাট তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু রজানীতিতে তিনি বরাবরের মতই ছিলেন অপরিপক্ক। তাই এই পদপ্রাপ্তি তার জীবনে নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তাছাড়া হামাদানের সেনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিদেশী ইবন সিনাকে সহ্য করতে পারছিলেননা। তাদের সাথে ইবন সিনার বিরোধের সৃষ্টি হয়। সেনাধ্যক্ষ সিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদন জানাতে থাকেন। সৈন্য বাহিনীর প্রধানের অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য সম্রাটের ছিলনা। তাই তিনি ইবন সিনাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দী করে রাখেন। তা না হলে শত্রুদের হাতে হয়তো তিনি মারা পড়তেন। শত্রুর পাশাপাশি সিনার বন্ধুও ছিল অনেক। তাদের সহায়তায় সিনা এই কারাজীবন থেকে পালিয়ে যে তে সক্ষম হন। হামাদান থেকে পালিয়ে তিনি ইরানের অন্যতম নগরী ইস্পাহানের পথে পা বাড়ান। ইবন সীনার পলায়নের কিছুদিন পরই ইরানের ইস্পাহান নগরীতে এক ছদ্মবেশী সাধুর আবির্ভাব হয়েছিল। এসময় ইস্পাহানের শাসনকর্তা ছিলেন আলা-উদ-দৌলা। ইস্পাহানের সম্রাট জানতে পারেন যে এই সাধু আসলে ইবন সিনা। তিনি তাকে নিজ দরবারে নিয়ে আসেন এবং রাজসভায় আশ্রয় দান করেন। তিনি ইবনে সিনাকে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তার জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সকল ব্যবস্থা করে দেন। এখানে নতুন উদ্যমে জ্ঞান চর্চা শুরু করেন এবং বিখ্যাত গ্রন্থ 'আশ শেফা' ও 'আল কানুন' এর অসমাপ্ত লেখা শেষ করেন।
Image of Avicenna on the Tajikistani somoni
ইবনে সিনা পদার্থ বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান , সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক কিতাব রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে আল কানুন, আশ শেফা, আরযুযা ফিত তিব্ব, লিসানুল আরব, আলমজনু, আল মুবাদাউন মায়াদা, আল মুখতাসারুল আওসাত, আল আরসাদুল কলিয়া উল্লেখযোগ্য। আল কানুন কিতাবটি তৎকালীন যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিপ্লব এনে দিয়েছিল। কারণ এত বিশাল গ্রন্থ সে যুগে অন্য কেউ রচনা করতে পারেননি। তার গ্রন্থ আল কানুন চিকিৎসা শাস্ত্রের মূল অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্য পুস্তক হিসেবে গন্য হত প্রায় পাচ শতক ধরে । আল কানুন কিতাবটি ল্যাটিন, ইংরেজি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় অনুদিত হয় এবং তৎকালীন ইউরোপের চিকিৎসা বিদ্যালয় গুলোতে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আল কানুন ৫টি বিশাল খণ্ডে বিভক্ত যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ লক্ষাধিক। কিতাবটিতে শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ, পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। তিনি ফার্মাকোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের প্রভূত উন্নয়ন করেন। তবে তার মূল অবদান ছিল চিকিৎসা শাস্ত্রে। তিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রণেতা। যেখানে একই সাথে শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। তিনি মানুষের চোখের সঠিক এনাটমি বর্ণনা করেন। যক্ষ্মা রোগ নিয়ে তিনি অভিমত দেন যে যক্ষ্মা একটি ছোয়াচে রোগ। যা তার পরের পশ্চিমা চিকিৎসকবৃন্দ প্রত্যাখ্যান করেন এবং যা আরো পরে সঠিক বলে প্রমানিত হয়। তিনিই প্রথম মেনিনজাইটিস রোগটি সনাক্ত করেন। প্রকৃত পক্ষে তিনিই আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক। আশ শেফা দর্শন শাস্ত্রের আরেকটি অমূল্য গ্রন্থ, যা ২০ খণ্ডে বিভক্ত ছিল। এতে ইবনে সিনা রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রানীতত্ত্ব ও উদ্ভিদতত্ত্ব সহ যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি মানুষের কল্যাণ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে আজীবন পরিশ্রম করেছেন এবং ভ্রমণ করেছেন জ্ঞানের সন্ধানে। পানি ও ভূমির মাধ্যেমে যে সকল রোগ ছড়ায় তা তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। সময় ও গতির সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্কের কথা তিনিই আবিষ্কার করেন। তিনি অ্যারিস্টটলের দর্শন ভালভাবে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু অ্যারিস্টটলের কিছু কিছু মতবাদের সাথে তিনি একমত হলেও সকল মতবাদের সাথে তিনি একমত হতে পারেননি।
ইস্পাহানে বেশ কিছুকাল তিনি শান্তিতে দিনাতিপাত করেন। হামাদানের কেউ তাকে এসময় বিরক্ত করত না। কিন্তু এখানেও বেশিদিন শান্তিতে থাকতে পারেননি সিনা। অচিরেই হামাদান এবং ইস্পাহাসের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। ইসপাহানের সম্রাট হমাদানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রস্তুত করেন। এসময় সম্রাট ইবন সিনাকে সাথে নেয়ার ইচ্ছ প্রকাশ করেন। চিকিৎসা সেবা প্রদানের কারণেই তাকে নেয়ার ব্যাপারে সম্রাট মনস্থির করেন। নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করেতে পারেননি। ইস্পাহানের সৈন্যবাহিনীর নাথে হামাদানের পথে রওয়ানা করেন। হামাদানের সাথে সিনার অনেক স্মুতি জড়িত ছিল। আর এখানে এসেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার এই অসুখ আর সারেনি। হামাদানের যুদ্ধ শিবিরে অবস্থানকালে ইবন সিনা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে (৪২৮ হিজরী) মৃত্যুবরণ করেন। হামাদানে তাকে সমাহিত করা হয়।
১৩টি মন্তব্য ১১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন