ষাটের দশকে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ক্লান্ত দুপুরে প্রচারিত দুঃখে ভরা দুঃখের একটি গান প্রায়ই শুনতে পেতাম “পদ্মার ঢেউ রে” কার লিখা গান, কে গেয়েছেন এইসব মনে রাখার মতো বয়স তখন ছিলো না, তবে স্কুল ফিরে এই গান শুনে শুনে ক্লান্ত দুপুরে ঘুমিয়েছি এটি মনে আছে। সত্তরের দশকে এক সময় জানতে পারি এই গানটি যিনি লিখেছেন তিনি আসলেই অত্যন্ত দুঃখী একজন মানুষ - আমাদের দুখু মিয়া, আমাদের কবি - কাজী নজরুল ইসলাম।
যখন বাংলার সড়ক মহাসড়কে গর্জনধ্বনি দেখেছি “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা” - তখনো পদ্মা আমার কাছে একটি স্বপ্ন! আমাদের বাড়ি মেঘনা ও তিতাস নদীর মাঝামাঝি এলাকায়। মেঘনা ও তিতাসের সাথে আমার সম্পর্ক যুগ যুগান্তরের - অনন্ত অনন্তকালের। ছাত্রজীবনে পদ্মা নদী দেখার সুযোগ আমার হয়নি। আমাদের সময় বেড়াতে যাওয়া খুব ব্যয়বহুল বিষয় ছিলো আর সেই আমলের মা বাবাও আমাদের একা বেড়াতে যেতে দিতেন না, বা ছাত্র ছাত্রী গ্রুপ করে বেড়াতে যাবে এমনও ছিলো না। সময় পেরিয়ে গিয়েছে সময়ের স্রোতে। জীবনে যখন প্রথম পদ্মা দেখার সুযোগ পাই ততোদিনে কর্মজীবন শুরু হয়েছে। এটি কাকতালীয় বিষয় কিনা জানিনা সেদিনও ক্লান্ত দুপুর ছিলো আমি নিজেও ছিলাম বেশ ক্লান্ত। পদ্মার তীরে যখন এসে পৌছেছি আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি একি! এ যে সাগর মহা সাগরের মতো অবস্থা! এতো বড় নদী হয়! এই আমাদের পদ্মা! হাটি হাটি পা পা করে কখন যে নদীর পানির কাছে এসে পৌছেছি তা হয়তো নিজেরও মনে ছিলো না। দুইহাত ভরে পানি হাতে নিয়েছি, পানি টিউবওয়েলের পানির মতো স্বচ্ছ ঝকঝকে পরিস্কার মিষ্টি।
পদ্মার বুকে ফেরিতে যখন পাড়ি দিচ্ছি বারবার একটি কথাই মনে হয়েছে - তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা! ঠিক তখনই কাকতালীয় আরেকটি বিষয় ঘটে! আমার জীবনে আমি দেখেছি কাকতালীয় বিষয়গুলো কখনো একা একা চলে না, এদের ভাইবোন থাকে - এরা ভাইবোন নিয়ে একসাথে চলাফেরা করে। ফেরিতে আমার পাশেই সেই সময়ের একটি আধুনিক সেডান টয়োটা স্টারলেটের স্টিরিও থেকে কিন্নর কন্ঠে একটি গান বেজে চলছে। গানটি আমার অতি পরিচিত আমার শৈশবের স্মৃতি আমার স্বপ্নে দেখা - না দেখা পদ্মা নিয়ে গান “পদ্মার ঢেউ রে” আমি পদ্মার বুকে ফেরিতে দাড়িয়ে আছি - সামনে উথাল পাথাল পদ্মার ঢেউ আর ফেরদৌসি রহমানের গলায় “পদ্মার ঢেউ রে - মোর শূণ্য হৃদয়–পদ্ম নিয়ে যা, যা রে” - কখন যে চোখের কোনে জল জমে উঠেছে আমি নিজেও জানিনা।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পদ্মার ঢেউ রে
গীতিকারঃ কাজী নজরুল ইসলাম
সুরকারঃ কাজী নজরুল ইসলাম
শিল্পীঃ ফিরোজা বেগম
শিল্পীঃ ফেরদৌসি রহমান
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পদ্মার ঢেউ রে —
মোর শূণ্য হৃদয়–পদ্ম নিয়ে যা, যা রে।
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙ্গা পা
আমি হারায়েছি তারে।।
মোর পরান–বঁধু নাই, পদ্মে তাই মধু নাই (নাই রে)
বাতাস কাঁদে বাইরে, সে সুগন্ধ নাই রে
মোর রূপের সরসীতে আনন্দ–মৌমাছি নাহি ঝঙ্কারে রে।।
ও পদ্মারে —
ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো
মোর বঁধুয়ার রূপ তেমনি ঝিল্মিল করে কৃষ্ণ–কালো।
সে প্রেমের ঘাটে ঘাটে বাঁশি বাজায়
যদি দেখিস্ তারে, দিস্ এই পদ্ম তার পায়
বলিস্, কেন বুকে আশার দেয়ালি জ্বালিয়ে
ফেলে গেল চির–অন্ধকারে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পদ্মার ঢেউ রে গানটি যথাক্রমে বেশ কয়েকজন শিল্পী গেয়েছেন তাঁদের মধ্য অন্যতম শচীন দেববর্মণ, ফিরোজা বেগম ও ফেরদৌসি রহমান। এই তিনজনই আমার অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী। ফিরোজা বেগম নজরুল গীতির অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শিল্পী তিনি সরাসরি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছাত্রী ছিলেন। ফিরোজা বেগম কোনো অনুষ্ঠানে একটির বেশী গান করেছেন বলে আমার জানা নেই। তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে তিনি আমাদের দেশের খুবই জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসের শিল্পী শাফিন ভাই ও হামিন ভাইয়ের আম্মা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২৫