আবু হামিদ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ আল-গাজ্জালি যিনি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) হিসেবে বেশি পরিচিত।তিনি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একজন শিক্ষাবিদ । ইমাম আল-গাজ্জালির ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসানের তুশ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নামটিও ছিল তার নামের অনুরূপ, মুহাম্মদ। মুহাম্মদের পিতা অর্থাৎ ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)-এর দাদার নাম ছিল আহমদ। তার পিতা মুহাম্মদ তখনকার সময়ে একজন স্বনামধন্য সূতা ব্যাবসায়ী ছিলেন। গাজল অর্থ সূতা, নামকরনের এই সামঞ্জস্যতা তাই তার বংশকে গাজ্জালী নামে পরিচিত করেছে। আবার কারো মতে তিনি হরিণের চক্ষু বিশিষ্ট অপরূপ সুদর্শন ছিলেন, আর গাজাল অর্থ হরিণ, তাই পিতা মাতা তাকে শৈশবে আদর করে গাজ্জালী বলে ডাকতেন। উভয় বর্ণনানুসারে তাকে গাজ্জালী বা গাজালীও বলা হয়। তিনি সে সময়ে ইরানের শিক্ষা নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেন। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য তিনি বেশ কিছু দেশ ভ্রমণ করেছেন।ছোট বেলায়ই আল-গাজ্জালি (রাহঃ) তার বাবাকে হারান। তার শিক্ষা জীবন এবং বাল্যকাল কাটে তুস নগরীতে। ইমাম আল গাজ্জালি (রহঃ) তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠতম ধর্মতত্ত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনির কাছে কয়েক বছর অতিবাহিত করেন। পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে এমন এক পরিস্থিতিতে ইমাম গাজ্জালী জন্মগ্রহণ করেন যখন পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শণের বিস্তার লাভ করে ছিল।সে যুগে যে শিক্ষা পার্থিব উন্নতির বাহন হতে পারতো, প্রথমত সেই ধরনের শিক্ষা তিনি লাভ করেন। বাজারে যেসব বিদ্যার চাহিদা ছিল, তাতেও তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেন। অতঃপর একটি বস্তু কে নিয়ে তিনি ঠিক সেখানেই পৌঁছেন সেখানকার জন্যে এটি তৈরি হয়েছিল এবং তৎকালে একজন আলেম যতদূর উন্নতির কল্পনা করতে পারতেন, ততদূর তিনি পৌঁছে যান।
তিনি পরিণত বয়সে ৪৮৪ হিজরিতে বাগদাদ গমন করেন। বাগদাদে তত্কালীন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপনায় যোগ দিলেন। মুসলিম দর্শন, ফিকাহ, ইলমুল কালাম অথবা ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে তিনি সর্বকালের প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের একজন। ইমাম গাজ্জালীর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতি ছিল অগাধ তৃষ্ণা। নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনা তার এই জ্ঞান পিপাসা নিবারণ করতে পারেনি। তাই অল্প সময়ের মধ্যে নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনা ছেড়ে সৃষ্টি রহস্যের সন্ধানে তিনি পথে বেরিয়ে পড়েন। প্রায় দশ বছর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন,এবং অবশেষে আবার তিনি বাগদাদে তৎকালীন দুনিয়ার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় বাগদাদের নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকটর নিযুক্ত হন। নেজামুল মুলক তুসী মালিক শাহ সালজুকী এবং বাগদাদের খলিফার দরবারে যোগ্য আসন লাভ করেন। সমকালীন রাজনীতিতে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেন যে সালজুকী শাসক এবং আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ দুর করার জন্যে তার খেদমত হাসিল করা হতো। পার্থিব উন্নতির এই পর্যায়ে উপনিত হবার পর অকস্মাৎতার জীবনে বিপ্লব আসে। নিজের যুগের তত্ত্বগত নৈতিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও তমুদ্দুনিক জীবনধারাকে যত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন, ততই তার মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে এবং ততই বিবেক তারস্বরে শুরু করে যে এই পুঁতিগন্ধময় সমুদ্রে সন্তরণ করা তোমার কাজ নয়, তোমার কাজ অন্য কিছু। অবশেষে সমস্ত রাজকীয় মর্যাদা, লাভ , মুনাফা, ও মর্যদাপূর্ণ কার্যসমূহেকে ঘৃণাভাবে দূরে নিক্ষেপ করেন। কেননা এগুলোই তার পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর ফকির বেশে দেশ পর্যটনে বেরিয়ে পড়েন। বনে-জঙ্গলে ও নির্জন স্থানে বসে নিরিবিলিতে চিন্তায় নিমগ্ন হন। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মুসলমানদের সংগে মেলামেশা করে তাদের জীবনধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।দীর্ঘকাল মোজাহাদা এবং সাধনার মাধ্যমে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে থাকেন। ৩৮ বছর বয়সে বের হয়ে পূর্ণ দশ বছর পর ৪৮বছর বয়সে ফিরে আসেন। ওই দীর্ঘকালীন চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের পর তিনি যে কার্য সম্পাদন করেন তা হলো এই যে, বাদশাহদের সংগে সম্পর্কেচ্ছেদ করেন। এবং তাদের মাসোহারা গ্রহণ করা বন্ধ করেন। বিবাদ ও বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার জন্যে শপথ করেন। সারকারী প্রভাবাধীনে পরিচালিত শিক্ষায়তনসমূহে কাজ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তুসে নিজের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিশেষ পদ্ধতিতে তালিম দিয়ে তৈরি করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সম্ভবত তার এ প্রচেষ্টা কোনো বিরাট বৈপ্লবিক কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হয়নি, কেননা এ পদ্ধতিতে কাজ করার জন্যে তার আয়ু তাকে পাঁচ ছয় বছরের বেশি অবকাশ দেয়নি।
গ্রিক দর্শন গভীরভাবে অধ্যায়ন করার পর তিনি তার সমালোচানা করেন এবং জবরদস্ত সমালোচানা করেন যে তার যে শ্রেষ্ঠত্ব ও শক্তিমত্তা মুসলমানদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, তা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং লোকেরা যে সমস্ত মতবাদকে চরম সত্য বলে মেনে নিয়েছিল, কোরআন ও হাদীসের শিক্ষাসমূহকে যার ফলে ছাঁচে ঢালাই করা ছাড়া দ্বীনের উদ্ধারের আর কোন উপায় পরিদৃষ্ট হচ্ছিল না, তার আসল চেহারা অনেকাংশে জনগণের সম্মুখে উম্মক্ত হয়ে যায়। ইমামের এই সমালোচানার প্রভাব শুধু মুসলমান দেশসমূহেই সীমাদ্ধ থাকেনি বরং ইউরোপে উপনীত হয় এবং সেখানে গ্রিক দর্শনের কর্তৃত্ব খতম করার এবং আধুনিক সমালোচনা এবং গবেষণা যুগের দ্বারোদঘাটন করার ব্যাপারে অংশগ্রহণ করে।ন্যায় শাস্ত্র গভীর জ্ঞান না রাখার কারণে ইসলামের সমর্থকগণ দার্শনিক এবং মুতাকাল্লিমদের মোকাবিলায় যেসব ভুল করছিল তিনি সেগুলো সংশোধন করে দেন। পরবর্তীকালে ইউরোপের পাদ্রিরা যে ভুল করেছিল ইসলামের এই সমর্থকরা ঠিক সেই পর্যায়ে ভুল করে চলছিল। অর্থাৎ ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের যুক্তি প্রমাণকে কতক সুস্পষ্ট অযৌক্তিক বিষয়াবলীর ওপর নির্ভরশীল মনে করে অযথা সেগুলোকে মূলনীতি হিসেবে গণ্য করা,অতঃপর সেই মনগড়া মূলনীতিগুলোকেও ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের মধ্যে শামিল করে যারা সেগুলো অস্বীকার করে তাদেরকে কাফের গণ্য করা আর যে সমস্ত দলিল প্রমান অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণের সাহায্যে মনগড়া সেই নীতিগুলোর গলদ প্রমাণিত হয়, সেগুলোকে ধর্মের জন্যে বিপদ স্বরুপ মনে করা। সেই জিনিসটিই ইউরোপকে নাস্তিক্যবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মুসলিম দেশ সমুহে সেই জিনিসটিই বিপুল বিক্রমে কাজ করে যাচ্ছিল এবং জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করছিল। কিন্তু ইমাম গাজ্জালী যথাসময়ে এর সংশোধন করেন। তিনি মুসলমানদেরকে জানান যে, অযৌক্তিক বিষয়সমুহের ওপর তোমাদের ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের প্রমাণ নির্ভরশীল নয় বরং এর পেছনে উপযুক্ত প্রমাণ আছে। কাজেই ঐ গুলোর ওপর জোর দেয়া শুধুই অর্থহীন।
তিনি ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও মুলনীতিসমূহের এমন যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা পেশ করেন যে তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে সে যুগে এবং তার পরবর্তী কয়েক যুগ পর্যন্ত ন্যায়শাস্ত্র ভিত্তিক কোনো প্রকার আপত্তি উত্থাপিত হতে পারতো না। সেই সঙ্গে তিনি শরিয়তের নির্দেশাবলী এবং ইবাদতের গূঢ় রহস্য ও যৌক্তিকতাও বর্ণনা করেন এবং এমন একটি চিত্র পেশ করেন যার ফলে ইসলাম যুক্তি ও বুদ্ধির পরীক্ষার বোঝা বহন করতে পারবে না বলে যে ভুল ধারণা মানুষের মনে স্থানলাভ করেছিল, তা বিদূরিত হয়।তিনি সমকালীন সকল মযহাবী ফেরকা এবং তাদের মতবিরোধ পূর্ণরূপে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে ইসলাম ও কুফরের পৃথক পৃথক সীমারেখা নির্ধারণ করেন এবং কোন সীমারেখার মধ্যে মানুষের জন্যে মত প্রকাশ ও ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা আছে, কোন সীমারেখা অতিক্রম করার অর্থ ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া ইসলামের আসল আকিদা বিশ্বাস কি কি এবং কোন কোন জিনিসকে অনর্থন ইসলামী আকিদার মধ্যে শামিল করা হয়েছে তা বিবৃত করেন। তার সেই পর্যালোচনার ফলে পরস্পর বিবদমান এবং পরস্পর কাফের আখ্যাদানকারী ফেরকাসমুগের সুড়ঙ্গের মধ্য হতে অনেক বারুদ বের হয়ে যায় এবং মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গীতে ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়।তিনি দ্বীনের জ্ঞানকে সঞ্জীবিত ও সতেজ করেন।চেতনাবিহীন ধার্মিকতাকে অর্থহীন গণ্য করেন। অন্ধ অণুসৃতির কঠোর বিরোধাতা করেন। জনগণকে পুনর্বার খোদার কিতান ও রসূলের সুন্নতের উৎস ধারার দিকে আকৃষ্ট করেন। ইজতিহাদের প্রাণশক্তিকে সঞ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। এবং নিজের যুগের প্রায় প্রত্যেকটি দলের ভ্রান্তি এবং দূর্বলতার সমালোচনা করে তাদেরকে ব্যাপকভাবে সংশোধনের আহবান জানান।
তিনি পুরাতন জরাজীর্ন শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেন এবং একটি নয়া শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা পেশ করেন। সে সময় পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল, তার মধ্যে দুই ধরনের ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। প্রথমটি হলো এই যে, দ্বীন ও দুনিয়ার শিক্ষাব্যস্থা পৃথক ছিল। আর তার ফলস্বরূপ দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে পৃথকীকরণ দেখা দেয়। ইসলাম এটিকে মূলতঃভ্রান্ত মনে করে।দ্বিতীয়টি এই যে, শরিয়তের জ্ঞান হিসাবে এমন অনেক বিষয় পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ন ছিল না। আর তার ফলে দ্বীন সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভ্রান্তিতে পরিপূর্ন হয়ে যায় এবং কতিপয় অপ্রয়োজনীয় বিষয় গুরুত্ব অর্জন করার কারণে ফিরকাগত বিরোধ শুরু হয়। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এই গলদগুলো দূর করে একটি সুসামঞ্জস্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন। তার সমকালীন লোকেরা তার এই মহান কর্মকাণ্ডের ঘোর বিরোধিতা করে। কিন্তু অবশেষে সকল মুসলিম দেশে এই নীতির স্বীকৃতি লাভ করে এবং পরবর্তীকালে যতগুলো শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তার সবগুলোই ইমাম নির্ধারিত পথেই প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানকাল পর্যন্ত আরবি মাদ্রাসাসমুহের কারীকুলামে যে সমস্ত ব্ই শামিল আছে, তার প্রাথমিক নকসা ইমাম গজ্জালী (রঃ) তৈরি করে রেখে যাওয়া।তিনি জনসাধারণের নৈতিক চরিত্র পূর্ণরূপে পর্যালোচনা করেন। উলামা,মাশায়েখ,আমির-ওমরাহ,বাদশাহ এবং জনসাধাণের প্রত্যেকের জীবন প্রণালী অধ্যয়নের সুযোগ তিনি পান। নিজে পরিভ্রমণ করে প্রাচ্য জগতের একটি অংশের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। তার উল-উলুম কিতাবটি সেই অধ্যায়নের ফল।এ কিতাবে তিনি মুসলমানদের প্রত্যেকটি শ্রেণীর নৈতিক অবস্থার সমালোচনা করেন, প্রত্যেকটি দোষ্কৃতির মূল এবং তার মনস্তাত্ত্বিক ও তমুদ্দুনিক কারণসমুহ অনুসন্ধান করেন এবং ইসলামের নির্ভুল ও সত্যিকার নৈতিক মানদণ্ড পেশ করার চেষ্টা করেন।
তিনি সমকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থারও অবাধ সমালোচনা করেন সমকালীন শাসক গোষ্ঠীকেও সরাসরি সংশোধনের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকেন এবং এই সঙ্গে তিনি জনগণের মধ্যেও জূলুম-নির্যাতনের সম্মুখে স্বেচ্ছায় নত না হয়ে অবাধ সমালোচনা করার প্রেরণা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন।এহইয়া-উল-উলুম এর একস্থানে লেখেন,আমাদের জামানার সুলতানদের সমস্ত বা অধিকাংশ ধন-সম্পদ হারাম। আর একস্থানে লেখেন এই সুলতানদের নিজেদের চেহারা অন্যকে না দেখানো উচিত এবং অন্যদের চেহারা না দেখা উচিত।এদের জুলুমকে ঘৃণা করা এদের অস্তিত্বকে পছন্দ না করা, এদের সঙ্গে কোন প্রকার সম্পর্ক না রাখা এবং এদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের থেকেও দূরে অবন্থান করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে অপরিহার্য। অপর একস্থানে দরবারে প্রচলিত আদব -কায়দা এবং বাদশাহ পূজার সমালোচনা করেন বাদশাহ ও আমির -ওমরাহর অণুসৃত সামাজিক রীতিনীতির নিন্দা করেন, এমনকি তাদের দালান কোঠা পোশাক-পরিচ্ছদ গৃহের সাজসরঞ্জাম সব কিছুকেই নাপাক গণ্য করেন। শুধু এখানেই ক্ষান্ত হননি তিনি বরং নিজের যুগের বাদশাহদের নিকট একটি বিস্তারিত পত্র লেখেন। পত্রের মাধ্যমে তাকে ইসলাম প্রবর্তিত রাষ্ট্র পদ্ধতির দিকে আহবান জানান , শাসকের দায়িত্ব বুঝান এবং তাকে জানান যে, তার দেশে যে জুলুম হচ্ছে তা তিনি নিজেই করেন বা তার অধীনস্থ কর্মচারীরা করেন,সবকিছুর জন্যে তিনিই দায়ী। একবার বাধ্য হয়ে রাজ দরবারে যেতে হয় তাকে,তখন আলোচনা প্রসঙ্গে বাদশাহর মুখের ওপর তিনি বলে ফেলেন “স্বর্ণ অলংকারের ভারে তোমার ঘোড়ার পিঠ ভাঙেনি তো কি হয়েছে, অনাহারে -অর্ধহারে মুসলমানদের পিঠতো ভেঙে গিয়েছে”। তার শেষ যুগে যে সকল উজির নিযুক্ত হন তাদের প্রায় সবার নিকট তিনি পত্র লেখেন এবং জনগনের দুরবস্থার প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জনৈক উজিরকে লেখেন যে, “জুলুম সীমা অতিক্রম করেছে। যেহেতু আমাকে স্বচক্ষে এসব দর্শন করতে হতো তাই নির্লজ্জ এবং নির্দয় জালেমদের কীর্তিকলাপ প্রত্যক্ষ না করার জন্যে প্রায় এক বছর থেকে আমি তুসের আবাস উঠিয়ে নিয়েছি”। ইবনে খালদুনের বর্ণনা মতে এতদূর জানা যায় যে, তিনি পৃথিবীর যে কোনো এলাকাতেই হোক না কেন নির্ভেজাল ইসলামী নীতিতে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করতেন। কাজেই তার ইঙ্গিতেই দুর প্রতীচ্যে আফ্রিকায় তার জনৈক ছাত্র, মুওয়াহিদ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ইমাম গাজ্জালীর কর্মকাণ্ডে এই রাজনৈতিক রূপ ও রং নেহাতই গৌণ ছিল। রাজনৈতিক বিপ্লব সাধনের জন্যে তিনি কোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাননি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর সামান্যতম প্রভাব ও বিস্তার করতে সক্ষম হননি। তার পরবর্তীকালে জাহেলীয়াতের কর্তৃত্বাধীনে মুসলিম জাতিসমূহের অবস্থা উত্তরোত্তর অবনতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এমনকি এক শতাব্দির পর তাতারীরা তুফানের ন্যায় মুসলিম দেশসমুহের ওপর দিয়ে ছুটে চলে এবং তাদের সমগ্র তমুদ্দুনকে বিধ্স্ত করে দেয় ।
ইমাম গাজ্জালীর সাফল্য এবং শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে দুটি কারণ রয়েছে, যথা-
১। গ্রিক দর্শনের সঙ্গে ইসলামের ঘোর মোকাবেলার দিনে তিনিই ছিলেন মুসলমানদের কর্ণধার। আর সে সংগ্রামে ইসলামী ধর্মশাস্ত্র বিজয়ী হয়েছিল।
২। শরিয়ত ও মারেফাতকে পরস্পরের সান্নিধ্যে এনেছিলেন। তিনি সুফিবাদের পরিপূর্ণতা দান করেন। তার গ্রন্থের অসংখ্য বাণী আমাদের মনকে নাড়া দেয়। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হল। যথা-
ক। তিনটি বস্তু মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। ‘লোভ, হিংসা ও অহংকার।
খ। তিনটি অভ্যাস মানুষের জন্য সর্বমুখী কল্যাণ ডেকে আনে। আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, বিপদের সময় দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া এবং যে কোন সংকটে ধৈর্য ধারণ করা।
গ। মানবজীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তার ‘মন এবং জবানকে’ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সমর্থ হওয়া।
ঘ। দুই ধরনের লোক কখনও তৃপ্ত হতে পারে না- জ্ঞানের অম্বেষী এবং সম্পদের লোভী।
ঙ। আয়নায় নিজের চেহারা দেখ, যদি সুদর্শন হও তবে পাপের কালিমা লেপন করে ওকে কুৎসিত করো না! আর যদি কালো-কুশ্রী হয়ে থাক, তবে ওকে পাপ-পঙ্কিলতা মেখে আরও বীভৎস করে তুলো না।
চ। আল্লাহর প্রত্যেকটি ফয়সালাই ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তিশীল। সুতরাং কোন অবস্থাতেই অভিযোগের ভাষা যেন তোমার মুখে উচ্চারিত না হয়।
ছ। ক্রোধ মনুষ্যত্বের আলোকশিখা নির্বাপিত করে দেয়।
জ। শক্ত কথায় রেশমের মতো নরম অন্তরও পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়।
ঝ। সাফল্যের অপর নামই অধ্যবসায়। ইমাম গাজ্জালি (রহঃ) ইসলামকে মধ্যযুগীয় অনৈসলামিক দার্শনিক চিন্তাধারার পঙ্গুকারী প্রভাব থেকে মুক্ত করে পবিত্র কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় মুসলমানদের ফিরিয়ে আনেন। তাই তার এই অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাকে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বা ‘ইসলামের রক্ষক’ বলা হয়ে থাকে।
এই মহামনীষী খ্রিস্টাব্দ ১১১১ সনের ডিসেম্বর মাস মোতাবেক ৫০৫ হিজরি সনে নিজ জন্মভূমি তুস নগরীতে সুস্থ অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মৃত্যুর দিন ভোর বেলায় তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন এবং তার ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিজ হাতে কাফনের কাপড় পরিধান করেন এবং কেবলার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়েন। এভাবেই এই নশ্বর পৃথীবি থেকে বিদায় নেন এই মহান দার্শনিক। ইরানের অমর কবি ফেরদৌসীর সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এটাই বহুল প্রচলিত।
http://its.org.uk/product-category/the-ghazali-series/
http://www.islamtimes.org/en/doc/article/6161/
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৬:৩৬