১.
অনুচ্চ টিলাটার ওপর উঠে চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নিল মালাজো। তারপর দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল দূরে; নীল, ফিকে নীল আর ধূসর পাহাড় যেখানে আকাশের বুকে মাথা পেতে আছে। এ পাশের হলদে-সবুজ চারণভূমির বিপরীতে পাহাড়গুলোকে দেখায় শিনা টান করে মঞ্চে দাঁড়ানো গর্বিত নেতার মতো; যে কিনা এখনই জোরালো স্বরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে শুরু করবে। পাহাড় কি আসলেই কিছু বলে না মানুষকে? মালাজো অজান্তেই নিস্তব্ধ হয়ে কান পেতে থাকে। হয়ত ভাবে, বাতাস পাহাড়ের কাছ থেকে কোনো বার্তা বয়ে আনবে। অনেকক্ষন একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো বার্তা শুনতে না পেয়ে আশাভঙ্গের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে সে। বিকেল শেষ হয়ে যায় এক সময়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে সূর্যটা লাল হয়ে ঝুলে থাকতে থাকতে এক সময় মিলিয়ে যায়।
এমোরাতা’র দিকে আরও একদিন এগিয়ে গেল সে।
ছেলেরা কাল সাভান্না থেকে ফিরে আসবে। কাল তাদের পরনে থাকবে কালো শূকা। সবার মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হবে। শাদা খড়িমাটির প্রলেপে মুন্ডিত মাথায় আর মুখে নকশা করবে তারা। সারাদিন নেচে-গেয়ে আনন্দ করবে গাঁয়ের ছেলে-বুড়োরা। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগে তাঁবুতে তাদের ‘এমোরাতা’ হবে। এমোরাতা’র এক দিন আগে ছেলেদের ‘সাভান্না’য় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বনে-জঙ্গলে এক দিন কাটিয়ে গাঁয়ে ফিরে আসে তার।
যেসব বাবা-মা তাদের সন্তানদের এমোরাতা করাবে না তারা অভিশপ্ত হবে। প্রভু এনগাই নান্যোকে’র আক্রোশে তাদের জীবন জ্বলে-পুড়ে যাবে। আর যারা এই প্রথা পালন করবে, তাদের এবং তাদের সন্তানদের জীবন সমৃদ্ধিতে পূর্ণ হবে। মালাজো যে সমাজে বাস করে, এমনটাই বিশ্বাস সেই সমাজের মানুষের।
ছেলেদের এমোরাতা অনুষ্ঠান শেষ হলে মেয়েদেরটা শুরু হবে। মালাজোর বয়স বারো বছর শেষ হয়ে গেছে আজ। এমোরাতায় বসার সময় হয়ে গেছে তার। এমোরাতার পর অন্য গোত্রের কোনো পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে তার। সেদিন সবার জন্য বড় আনন্দের দিন হবে। দূর শহরে তার বাবা কাজ করে। বছর-ছ’মাসে একবার বাড়ি আসে। এবার প্রায় দু’বছর ধরে উধাও। বিয়েতে সে থাকবে আশা করা যায়। অবশ্য বাবা নামক মানুষটার তাদের সঙ্গে থাকা-না থাকাতে কিছু এসে যায় না। থাকলে বরং আরও খারাপ কিছু ঘটে। মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম করে টেনে নিয়ে যাওয়া সংসারটাকে দু’দিনে ভেঙে-চুরে দিয়ে যায় লোকটা। ঘটি-বাটি আর গবাদিপশু বেচে টাকা নিয়ে আবার শহরে চলে যায়। কিছু বললে মা-মেয়ে দু’জনকেই কিলিয়ে ভর্তা বানায়। অশ্রু ছাড়া আর কিছু তাদের দিতে পারে না লোকটা। নাহ, কোনো শ্রদ্ধাই মালাজোর মনে কাজ করে না বাবার জন্য। ‘পাপা’ ডাকতেও ঘৃণা হয় তার। বাবার প্রতি এমন ঘৃণার জন্য অনুতপ্তও হয় মালাজো। প্রভু এনগাই নিশ্চয়ই ক্রুদ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু মন তো মনই। শ্রদ্ধাটা মন থেকে আসছে না, তো কী করবে সে? প্রভু এনগাই কি বুঝবেন না তার সমস্যাটা? না বুঝলে সে আর ঈশ্বর কিসের? ঈশ্বরের প্রতি এমন অশ্রদ্ধাপূর্ণ ভাবনায় আবারো অনুতপ্ত হলো সদ্য বারো পেরুনো কৃষ্ণাঙ্গী মালাজো, যে এমোরাতা’র পর আর বালিকা থাকবে না।
মালাজোর মনে প্রায়ই এক প্রশ্ন জাগে, ‘আচ্ছা, তার বাপ-দাদাদের সবার তো এমোরাতা হয়েছিল। তবে কেন ঈশ্বর তাদের পরিবারকে সমৃদ্ধি দিলেন না? এত দারিদ্র্য আর দুর্ভোগ কেন তাদের? নাকি এটা আরও প্রাচীন কোনো অভিশাপের ফল?’
‘হতেও পারে প্রাচীন অভিশাপ’। মালাজো উত্তর দেয় নিজের মনে। বুড়োরা বলাবলি করে, তার দাদার বাপের লাশ নাকি কোনো জন্তুতে চেখে দেখেনি। যার লাশ কোনো জন্তু খায় না, এমনি এম্নিই পঁচে-গলে যায়, তার পরিবারের শুভ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একবার এও মনে হলো, ভালোই আছে তারা। ছোটবেলায় দাদার মুখে শুনেছিল, অনেক বছর আগে একবার গরুদের কী এক অসুখ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এত গরুর মৃত্যু নাকি তার আগে কেউ দেখেনি আর। না খেতে পেয়ে তাদের গোত্রের অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। আশেপাশের অনেক গ্রাম থেকেও প্রতিদিন বহু মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত রোজ। এমন অবস্থায় তো আর পড়তে হচ্ছে না তাদের। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে, নিজেকে অনেক প্রশ্ন করতে করতে আর সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে, তৃনভূমি পেরিয়ে মালাজো এগিয়ে চলে নিরাপদ জায়গার দিকে। ভাবনার ঘনঘটায় আনমনা হয়ে পড়েছিল সে। সখী এনকাসিওগির ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়।
এনকাসিওগি তাকে একচোট বকা-ঝকা করে নেয়। একটা গরু যে পাল থেকে ছুটে গিয়েছিল সেই খেয়াল রাখাটা তার উচিত ছিল। অভাবের সংসার, গরু হারিয়ে গেলে চলবে কী করে? এম্নিতেই গরু নিখোঁজ হওয়ার হিড়িক পড়েছে। আজ এর গরু নেই, কাল ওর নেই। সিংহের উৎপাত খুব বেড়েছে এদিকে। আফ্রিকার সব সিংহ এখানে চলে এসেছে কিনা কে জানে।
‘সিংহের দল আমাদের গরুগুলো টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আর কিছুদিন পর পর এক দল শাদা মানুষ এসে কিনা বলছে সিংহ না মারতে! আরে ভাই, আমাদের ছেলেরা যোদ্ধা হয় সিংহ মারার জন্য। সিংহ না মারলে আমাদের গরু একটাও থাকবে? তোমরা আমাদের গরু দাও, নয়তো গরু রক্ষা করার ব্যবস্থা কর। আমরা আর সিংহ মারব না। তাই না?’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে এনকাসিওগি। মালাজোর সমর্থনের আশায় তার মুখের দিকে তাকায়। মালাজো হেসে বলে,
‘এত চিন্তা? আচ্ছা, তোর বরের যেন শুধু একটা গরু থাকে।’
রসিকতাটা হজম করতে পারে না এনকাসিওগি। তার মন ভারী হয়। একটা গরুর মালিক যে ছেলে, তার চেয়ে দরিদ্র কি এই পৃথিবীতে আর কেউ আছে? মালাজো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে,
‘আচ্ছা যা, তোর তাহলে পাশের গ্রামের ঐ বুড়োটার সঙ্গে বিয়ে হবে, যার গরুর মাথা গুনতে গুনতে শেষ হয় না। পনেরটা বউ আর সাতষট্টি ছেলে-মেয়ে তার।’
এনকাসিওগি এবার ফিক করে হেসে একটু সামনে এগিয়ে হাঁটে। লজ্জা পেয়েছে বোঝা যায়। এখানকার মেয়েদের মনে স্বামী-সংসার, গরু আর পুঁতির অলংকার ছাড়া আর কিছু নেই। এনকাসিওগি তার চেয়ে ব্যতিক্রম কোনোভাবেই নয়। কিন্তু মালাজো এসব নিয়ে একদমই ভাবে না। বরং আসন্ন এমোরাতার চিন্তায় সে সন্ত্রস্ত।
এমোরাতার পর তাকে বিয়ে করতে হবে। বিয়ের পর সে আর পড়তে পারবে না। বাকী জীবন তাকে গোবর দিয়ে স্বামীর ঘর বানাতে হবে আর গবাদিপশুর দেখাশোনা করতে হবে। পুরুষদের ওপর কোনো কথা বলতে পারবে না। বললে প্রহৃত হবে। বছর বছর সন্তান জন্ম দেবে। ছেলে হলে ভাগ্য ভালো, মেয়ে হলে খারাপ। এইতো জীবন। অবশ্য এমনও হতে পারে, তার আগেই সে মারা যাবে। গত বছর পাশের কুঁড়ের সামানা নামের মেয়েটা মারা গিয়েছিল। তার আগের বছর মারা গেল এনতাইয়্যা আর ওসোতুয়া। এদের কথা মালাজোর মনে পড়ে। মনে পড়ে না যাদের কথা, তাদের মধ্য থেকেও নিশ্চয়ই মারা গিয়েছিল কেউ কেউ।
মাঝে মাঝে তার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে এসব ছেড়ে। একটা মেয়েদের গ্রাম আছে বলে শুনেছে সে। সেই গ্রামে মেয়েদের শাসন চলে। মেয়েরা সেখানে যেমন ইচ্ছে চলতে পারে। সেখানে মেয়েদের প্রহার করার জন্য কোনো পুরুষ নেই। কোনো পুরুষ থাকতে চাইলেও মেয়েদের আইন মেনে থাকতে হবে তাকে। তাদের সমাজের কোনো পুরুষ সেটা চায় না বলে সেই গ্রামে কোনো পুরুষ নেই। একটা ভারী, বেদনাক্লিষ্ট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মালাজো। সে যদি জানত সেই গ্রামটা কোথায়, অবশ্যই পালিয়ে যেত এখান থেকে।
সখী এনকাসিওগি তাড়া লাগায়- ‘এইলে, তাড়াতাড়ি হাঁট।’
মালাজো বিরক্ত হয় খুব। এনকাসিওগির বড্ড তাড়া যে কোনো কিছুতেই। কে যে তার নাম রেখেছে- এনকাসিওগি! একেবারে সার্থক নাম; আর নয়তো নামেরই প্রভাব পড়েছে স্বভাবে। এই উষ্ণ আর বিষন্ন সন্ধ্যায় তাই মালাজোর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে এনকাসিওগির আত্মীয়দের ওপর। পরমূহূর্তেই ভাবে- নাহ, কিসেরিয়ান মানে শান্তিপ্রিয় হলেও, কিসেরিয়ান মেয়েটা তো ভারী ঝগড়াটেই। তার মানে, এনকাসিওগির আত্মীয়দের ওপর রাগ করা উচিত হচ্ছে না।
২.
স্কুলের ম্যাম বললেন, ‘তাহলে, কী বোঝালাম আজকে? বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে বোঝাবে, এমোরাতা খারাপ, ঠিক আছে?’
সবাই মাথা নাড়ল। ঠিক আছে।
মালাজো ম্যাম’র দিকে তাকিয়ে রইল অপলক। পড়াশোনা করলে সেও নিশ্চয়ই এমন শিক্ষক হতে পারবে। গরুর মাথা গোনার বদলে সে তখন ছাত্র-ছাত্রীর মাথা গুনবে। ছাত্রীদের বোঝাবে, এমোরাতা তাদের জন্য কত খারাপ। তারা বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা-মাকে বোঝাবে।
শিক্ষক হলে সে ভালো জীবন-যাপনও করতে পারবে। তাকে রোজ রান্নার জন্য কাঠ কুড়োতে যেতে হবে না। ছোট ছোট জলাধারের ঘোলাটে পানি খেতে হবে না। ভালো খাবার খেতে পারবে, ভালো ভালো পোশাক পরতে পারবে। এই ম্যামের মতো সুন্দর জুতো নিশ্চয়ই সেও পরতে পারবে তখন। স্বপ্নের লেজ ধরে একেবারে মাথায় উঠে যায় মালাজো। ম্যাম’র মুখের জায়গায় সে নিজের মুখটা দেখতে পায়। হাসি-খুশি, উজ্জ্বল আর সুখী-সুখী। এভাবেই মালাজোর মনের ভেতর একজন শিক্ষক মালাজো একটা সিংহাসনে বসে তাকে শাসন করতে থাকে। নীলনদের তীর থেকে উঠে আসা মালাজোর পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া বিবর্তিত নিয়মের কিছুই আর তার মনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। উল্টো মনে মনে ভাবে, ‘বিয়ে আমি করব না কিছুতেই’। কিন্তু নিজের আলোকের বিস্তারে পাওয়া এই বন্দীদশার অনুভূতি থেকে নিস্তার কী করে মিলবে, সেই পথও সে বের করতে পারে না ।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সারাটা পথ সে ভাবল। পথে এনকাসিওগি অনেক বকবক করল- এমোরাতায় না বসলে তাদের ‘পাপা’দের সমাজে মুখ দেখাতে কিরকম সমস্যা হবে; প্রভু এনগাই নান্নোকে কিরকম ক্রুদ্ধ হবেন তাতে; পৃথিবীর সব গরু প্রভু এনগাই তাদেরই কেন দিয়েছেন; এই চারণভূমি শুষ্ক হয়ে গরুদের বাসের অযোগ্য হয়ে গেলে কোনদিকে যাবে তারা, পুরুষদের পছন্দে বিয়ে না করে নিজের পছন্দে বিয়ে করলে কেমন ছেলে পছন্দ করত সে—এমন অনেক কিছু। কথার কোনো অভাব নেই এনকাসিওগির। মালাজো কিছু কিছু শুনল, বেশিরভাগই শুনল না। তার মাথার মধ্যে তখনও শিক্ষক মালাজো কথা বলছিল।
বাড়ি ফিরে মালাজো দেখল, গ্রামে ছেলেদের এমোরাতার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। ছেলেরা কালো পোশাকে আছে। তাদের মুন্ডিত মাথায় খড়িমাটির নকশা দেয়া হচ্ছে, যেমনটি নিয়ম। নকশা দেয়া শেষে তারা লাফ-নৃত্য শুরু করল। কে লাফিয়ে কত উঁচুতে উঠতে পারে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। লেইশান সবচে’ বেশি উঁচুতে উঠল-প্রায় চার ফুট! বয়স্ক মহিলারা ‘মা’ ভাষায় গান গাইছে-
“এইই, ইয়েয়্যেই, য়েইয়্যে... এই, ইয়েয়্যেই, য়েইয়্যে...
আমাদের প্রভু ভালো,
তিনি আমাদের দিয়েছেন গরু, দিয়েছেন আলো,
তোমার সন্তানদের খৎনা করো, এইই, ইয়েয়্যেই, য়েইয়্যে...
প্রভুকে রাগিয়ো না, অভিশাপ নামবে আরো...
এই, ইয়েয়্যেই, য়েইয়্যে... এই, ইয়েয়্যেই, য়েইয়্যে...”
গাঁয়ের সকল বয়স্ক পিতা; ১১ জন সমাজপতি, যারা গাঁয়ের সবচে’ প্রাজ্ঞ এবং প্রবীন ব্যক্তি এবং বয়স্ক মহিলারা উপস্থিত আছেন এই অনুষ্ঠানে। তাঁরা এসেছেন ছেলেদের আশির্বাদ করতে। এই ছেলেরা একদিন বড় যোদ্ধা হবে। তাদের গবাদিপশু আর গ্রামকে সুরক্ষিত রাখবে সিংহ আর অন্য কোনো গোত্রের আক্রমনকারীদের হাত থেকে। এই ছেলেরা সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ।
পুরো অনুষ্ঠানটাই ভিডিও করছিল কিছু শ্বেতাঙ্গ লোক। এই গ্রামে তাদের প্রায়ই দেখা যায়। তারা এখানকার মানুষদের মতো লাল শূকা আর গলায় পুঁতির মালা পরে ঘুরে বেড়ায়। স্থানীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, একসঙ্গে নাচে, ‘ওল-কুরাই’র শেকড় থেকে তৈরি স্যুপ আর গরুর রক্ত মিশ্রিত দুধ পান করে। তারা এখানকার মানুষকে বোঝায়, ‘আমরা তোমাদেরই লোক। আমরা তোমাদের ভালো চাই। তোমরা সিংহ মেরো না’।
মানুষগুলো বলে বেড়াচ্ছে, পাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য নাকি সিংহ বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তাছাড়া, সিংহ সব মেরে ফেললে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ নাকি আর তাদের দেশ দেখতে আসবে না। মানুষ না আসলে দেশের উন্নতি হবে না। মালাজো ভেবে দেখেছে, কথাটা ঠিক। বহিরাগতরা বেড়াতে আসলে তাদের কাছ থেকে তাদের শূকা আর পুঁতির অলংকার কিনে নেয় ভালো দাম দিয়ে। তখন তাদের কিছু লাভ হয়। বহিরাগতদের জন্য যদি তাদের লাভ হয়, দেশের লাভ কেন হবে না?
এই শাদা মানুষরা যোদ্ধাদের কাজে লাগাচ্ছে সিংহ বাঁচানোর জন্য। যোদ্ধাদের বেতন দিচ্ছে। নিজেদের বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে একটি-দুটি করে তাদের হারানো গরু খুঁজে দিচ্ছে। এই যন্ত্র কাজে লাগিয়ে কিভাবে সিংহের হাত থেকে গরু বাঁচাতে হবে সেটাই তারা যোদ্ধাদের শেখায়। মালাজো নিরাপদ দূরত্বে থেকে তাদের কর্মকান্ড দেখে। এই ছোট্ট যন্ত্রটা দিয়ে কিভাবে তারা গরু খুঁজে বের করে, সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি সে। যন্ত্রটা কিভাবে কাজ করে, দেখতে পারলে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলত।
শাদা মানুষগুলোর কর্মকান্ড দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই মালাজোর মনে হলো, সে তো তাদের কাউকে তার অসহায়ত্বের কথা জানাতে পারে! তারা যদি সত্যিই এই মানুষগুলোর বন্ধু হয়ে থাকে, নিশ্চয়ই মালাজোর কিছু উপকার করবে। মালাজো তাই সিংহের মতোই তক্কে তক্কে থাকল, কিভাবে এই দলের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
৩.
দু-একদিন লক্ষ্য করে দেখল, মানুষগুলো রোজ একটা কালো জিপে করে আসে। কাজ শেষ করে যে পথে আসে, সে পথেই জিপের চাকায় ধুলোর ঝড় তুলে চলে যায়। দেখতে দেখতে কালো জিপ অদৃশ্য হয়ে যায় চারণভূমির ওপারে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কৌতূহলের জোয়ারে প্লাবিত হয় মালাজো—কোথায় থাকে তারা? কেমন তাদের বাসস্থান? তারা কি তুলতুলে বিছানায় ঘুমোয়? তাদের বাড়ি-ঘর কি সোনা-রূপা আর পুঁতির তৈরি? কেন তারা সিংহ বাঁচাতে নিজেদের টাকা খরচ করছে তাদের জন্য? সিংহ বাঁচলে লাভ যদি তাদের দেশের হয়, তবে এই শাদা মানুষগুলোর লাভ কী তাতে?
কৌতূহল নিবৃত্তির সুযোগ একদিন এসে গেল। হলুদ ফুলে ছাওয়া এক ‘ওল-কুরাই’ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল মালাজো, যেখানে শাদা মানুষগুলো রোজ তাদের জিপটা থামায়। জিপ থেকে তাদের সবাই একে একে নেমে এলে সে দেখল, আজ তাদের সঙ্গে একজন বাদামী মানুষও আছে। এই মানুষটিকে আগে কখনো দেখেনি সে। গায়ের রঙ বাদামী হলেও তাতে উজ্জ্বলতা নেই, অনেকটাই কালোঘেঁষা। বয়স হয়েছে, কিন্তু উচ্চতায় সে মালাজোর চেয়ে খানিকটা বেশি। অবশ্য এটা খুবই স্বাভাবিক। এখানে বেড়াতে আসা বহিরাগতদের বেশিরভাগই তাদের ঘাড়ের কাছে পড়ে থাকে। মালাজোদের সবাই এমন লম্বা। লম্বা আর ক্ষীণকায়।
মানুষটি মালাজোর কাছাকাছি এসে হাত বাড়িয়ে দিল। 'মা' ভাষায় জানতে চাইল সে কেমন আছে। জিজ্ঞেস করল এমনভাবে, যেন সে মালাজোর কতদিনের চেনা। মালাজোও হাত মিলিয়ে নিজের ভাষায় উত্তর দিল,
‘সিদাই ওলেং (খুব ভালো)।’
তারপর ইংরেজিতে যোগ করল,
‘আই ক্যান স্পিক ইংলিশ এ লিতল বিত। আই রিদ ইংলিশ ইন স্কুল’।
মানুষটি এই উত্তরে খুব উল্লসিত হয়ে উঠল। জানাল যে, এমন কাউকেই তাদের দরকার। মালাজো চাইলে তাদের সঙ্গে থাকতে পারে।
সেদিন সারা দিন মালাজো তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকল। কাছ থেকে দেখল তাদের সব কর্মকান্ড। অসংখ্য প্রশ্ন করে দলের প্রতিটি সদস্যকে সে অস্থির করে ফেলল। দলের সঙ্গে মিলে একটা অসুস্থ সিংহ ধরে সেটাকে ওষুধ দিতে সাহায্য করল। মালাজো এই প্রথম কোনো জীবিত সিংহ স্পর্শ করল। আপাদমস্তক এক অন্যরকম রোমাঞ্চ অনুভব করল সে। এই গ্রামের মধ্যে হয়ত সেইই একমাত্র মেয়ে, যে জীবিত সিংহ স্পর্শ করেছে। এমনকি তাদের যোদ্ধাদেরও সবার জীবিত সিংহ স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয় না। সারাদিন গর্বিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াল মালাজো। সমবয়সীদের কেউ একজন সেই ঘটনা পুরো গাঁয়ে চাউর করে দিল। মেয়েদের গল্পের মধ্যমণি হয়ে গেল সে।
পথে পথে অনেকেই সেই গল্প শুনতে চাইল। কিন্তু মালাজোর খুব বেশি কথা বলার সময় ছিল না কারো সঙ্গেই। সে দলটার সঙ্গে ঘুরে-বেড়াচ্ছিল আর এটা-ওটা প্রশ্ন করছিল। দিনের শেষে অনেক জ্ঞান অর্জন করার পর যখন সে শুনল, দলটা আজ গ্রামের ভেতরেই রাত কাটাবে, মালাজো নিজের কথাগুলো বলার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। কাকে বলবে? কাকে বললে ভালো হয়? খুব একটা চিন্তা করতে হলো না—তার সবচে’ বেশি খাতির জমেছে কালোঘেঁষা বাদামী চামড়ার লোকটার সঙ্গে।
রাতে গাছের ডাল আর গোবর দিয়ে তৈরি সংকীর্ণ ঘরে মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল মালাজো। আজকে সারাদিন কিছু খায়নি সে। সকালে একটু গাভীর রক্ত পান করেছিল শুধু, আর দুপুরে বিদেশীদের দলটার সঙ্গে একটু গরুর মাংস দেয়া পাউরুটি খেয়েছিল। কিন্তু তবু সে খুব একটা ক্ষিধে অনুভব করছিল না। মা কিছুক্ষণ চাপাচাপি করল দুধ আর ‘ওল-কিলোরিতি’ গাছের ছাল থেকে তৈরি স্যুপ খেতে। সে নড়ল না। মা বললেন,
‘না খেলে পড়ার শক্তি পাবি কোথা থেকে?’
‘আমাকে কে পড়তে দেবে? মা, আমি এমোরাতায় বসব না। আমি পড়ব।’
কথাটা বলে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না মালাজো। কিন্তু সে খুব অবাক হলো, মা খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। হয়ত পাত্তাই দিলেন না। কারন- তিনি এর পরই জানতে চাইলেন নতুন যে বাছুরটা জন্ম নিতে যাচ্ছে, তার নামের ব্যাপারে কী ভাবছে মালাজো। মালাজো কোনো কথা বলল না। সাড়া না পেয়ে মা নিজেই কয়েকটা নাম প্রস্তাব করে, আরও কীসব বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন। মায়ের ঘুম গাঢ় হয়ে এলে মালাজো ঘরের বালির মেঝেতে পায়ের ছাপ রেখে বাইরে বেরিয়ে এলো। দলটা কোথায় তাঁবু ফেলেছে, জানে সে।
চাঁদের আলোয় ছোট-বড় ঘাস-গুল্মভরা তৃণভূমিকে কেমন রহস্যময় লাগছিল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ওল-কুরাই আর ওল-গোরেতে’র গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, চাঁদের আলো থেকে বাঁচতে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘাঙ্গী মাসাই তরুনীরা। মালাজো নিরাপদ এলাকার ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। যোদ্ধারা কাঁটাগাছের ডাল দিয়ে পুরু করে দেয়াল বানিয়ে দিয়েছে। কোনো আক্রমনকারী এগুলো ডিঙিয়ে সহজে ঢুকতে পারবে না, সেটা সিংহ হোক বা অন্য কিছু। কিছুক্ষণ হাঁটতেই সে পৌঁছে যায় বিদেশীদের তাঁবুর কাছাকাছি। বিদেশীদের দেখা যাচ্ছিল দূর থেকেই। কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তারা তার চারপাশে বসে গল্প করছিল, হাসছিল এবং কাঁচের বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে বিশেষ কোনো তরল গলায় ঢালছিল। দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, তাদের জীবনে কোনো কষ্ট নেই। মালাজো তাই মনে করে।
দলটার একেবারে কাছাকাছি চলে এলে বাদামী মানুষটাই প্রথম লক্ষ্য করে তাকে।
‘আরে, মালাজো, সোপাই এ্যান্ড সিট ডাউন’।
মালাজোর হাসি পেয়ে যায়। তাদের ভাষায় স্বাগত জানানোর আগে কখনো নাম উচ্চারণ করে না তারা। কিন্তু এই মানুষগুলো আগে নাম উচ্চারণ করে। তারা ‘মা’ ভাষাকে নিজেদের ভাষার ধরনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। মালাজো বলল,
‘এ্যাশে ওলেং’।
মালাজোকে তারা দুপুরের মতো এক টুকরো পাউরুটি সাধল। মালাজোর খেতে ইচ্ছে করছিল না, তবু নিল। তারা যেমন দুধের ওপর বেঁচে আছে, এই মানুষগুলোও হয়ত পাউরুটির ওপর বেঁচে আছে। কেবল পাউরুটি খায়। মালাজো একটু উসখুস করছিল, তখন বাদামী চামড়ার মানুষটি জানতে চাইল সে গল্প করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসেছে কিনা; টাকা বা ওষুধ বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস লাগবে কিনা। মালাজো জানাল, সে শুধু গল্প করতেই এসেছে, কিন্তু গল্পটা সে শুধু এই মানুষটাকেই বলবে।
বাকীরা তাঁবুর ভেতর চলে গেল। বাদামী মানুষটা বলল,
‘মালাজো, তুমি চাইলে আমার নাম ধরে ডাকতে পার। আমি জন। এখন তুমি যে বিশেষ গল্পটা বলতে চাইছ, সেটা বলো।‘
মালাজো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ‘মা’ ভাষার উচ্চারণে ইংরেজিতে বলল,
‘তুমি দেখেছ, দু’দিন আগে ছেলেদের এমোরাতা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে এমোরাতার পর ছেলেরা যোদ্ধা হয়, আর মেয়েরা হয় গৃহিনী। এমোরাতা না করালে কোনো মেয়েকে কোনো ছেলে বিয়ে করবে না। তাই আমাদের সব মেয়েদের এমোরাতা হয়। আমি এমোরাতা করাতে চাই না। আমি স্কুলে যেতে চাই।‘
মালাজোর কথা শুনে জন নামের মানুষটার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। এমোরাতা কী ধরণের অনুষ্ঠান, সেটা সে জেনেছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু মেয়েদের এমোরাতা! এটা কী করে সম্ভব! জন অস্ফুট স্বরে বলল,
‘ওহ মাই গড!’
‘তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?’
‘আমি চেষ্টা করব। তুমি কী ধরনের সাহায্য চাও, বলো।‘
‘আমাকে তোমার দেশে নিয়ে যাবে? আমি পড়তে চাই। এখানে থাকলে আমার পড়াশোনা হবে না।‘
জন কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘আমার দেশ আমেরিকা। কিন্তু সেখানে যেতে হলে তোমাকে অনেক নিয়ম মানতে হবে। সেটা খুব সহজ নয়। তুমি মাধ্যমিক পাশ করার পর আমেরিকার কোনো কলেজে যদি পড়তে চাও, আমি ব্যবস্থা করতে পারব। তুমি যদি চাও, আমি তোমার পরিবারকে বোঝাতে পারি তারা যেন তোমার এমোরাতা না করায়।‘
‘তারা শুনবে না তোমার কথা। অনেকেই বলেছে, কোনো লাভ নেই। এমোরাতা না হলে এখানকার কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে বিয়ে করবে না। তাছাড়া, এমোরাতা না করালে প্রভু এনগাই রেগে যাবেন। তাই কেউ সেটা না করানোর কথা চিন্তাও করবে না’।
সবকিছু শুনে জন মাথা নিচু করে বসে রইল। মালাজো বলল,
‘সমস্যা নেই। আমি একটা উপায় বের করব।‘
তারপর পরিস্থিতি সহজ করতে জন তার কৃষ্ণাঙ্গ বাবা আর শ্বেতাঙ্গ মায়ের গল্প করতে শুরু করল। কতকাল আগে তারা আফ্রিকার কোনো একটি দেশের বাসিন্দা ছিল, কেন তারা আফ্রিকা ছেড়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিল, আমেরিকার জীবনধারা কেমন...এ সমস্ত কোনো গল্পেই অবশ্য মালাজো আর তেমন উৎসাহিত হতে পারল না। জনকে শুভরাত্রি জানিয়ে সে দ্রুত পদক্ষেপে ঘরে ফিরে এলো।
ঘরে ফিরে মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে অনেক্ষন কাঁদল মালাজো। তার মনে হলো, দূর থেকে ভেসে আসা সিংহের গর্জন, এই রাত, এই গোবরের ঘর, ওল-কুরাইয়ের পাতায় বাতাসের শব্দ, এমনকি ছোট ছোট হলুদ ফুলগুলো পর্যন্ত তাকে তিরস্কার করে বলছে- পৃথিবী তোমার নয়।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল মালাজো। স্বপ্ন দেখল- তার প্রিয় টিলার ওপর একটা সবুজ শূকা পরে বসে আছে সে। আর তখন এক ঝলক বাতাস এসে লাগল গায়ে। কেউ যেন ফিসফিস করে বলল- ‘পাহাড়ের মাথা উঁচু থাকে সব সময়।‘
৪.
দেখতে দেখতে মেয়েদের এমোরাতার দিন চলে এলো। সকল উপযুক্ত তরুনীর মাথা মুন্ডন করা হয়েছে। পুরো গাঁয়ে উৎসবের আমেজ। মহিলারা লাল, নীল আর হলুদ শূকা পরে সেজেছে। তাদের কানে, গলায় আর মাথায় বর্ণীল পুঁতির অলংকার। তারা নাচছে, গান গাইছে, একে অপরের সঙ্গে রসিকতায় মেতে উঠেছে। আত্মীয়রা সবার মাথায় আর মুখমন্ডলে লাল ওকার মেখে দিচ্ছে। এনকাসিওগি সখীর গলা জড়িয়ে ধরছে কিছুক্ষণ পর পর। সখীকে মেয়েদের নাচের আসরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু মালাজো অনড় রইল। তার ভালো লাগছে না কিছু। এনকাসিওগি আর জোর না করে নাচের আসরে ফিরে গেল।
মা আসলেন মালাজোর মাথায় আর মুখে রঙ ঘষে দিতে। মালাজো একপাশে সরে গেল। বলল,
‘আমি এমোরাতায় বসব না।‘
মা জিবে কামড় দিলেন,
‘ছি ছি, এমন কথা বলতে নেই। এমোরাতায় না বসলে তোর বাপ মুখ দেখাতে পারবে না সমাজে।‘
‘বাপ কোথায় আমার?’
মা আর কিছু বললেন না। গ্রামের বয়স্ক মহিলারা এসে বোঝাল মালাজোকে—‘এমোরাতায় না বসলে ঈশ্বরের অভিশাপে পুড়ে যেতে হবে। ‘
মালাজো বলল, ‘আমি বসব না এমোরাতায়।‘
গাঁয়ের বয়স্ক পুরুষরা শুনে বলল, ‘এই অভিশাপ এত ভয়ংকর, মৃত্যুর পর কোনো জীবন থাকলে তাতেও এর ফল ভোগ করতে হত। ভাগ্যিস, নেই তেমন কিছু।‘
মালাজোর কন্ঠস্বর এবার আরও দৃঢ়, ‘আমি আমার অভিশাপ ভোগ করব।‘
প্রতিবেশিনী এবং সঙ্গী-সাথীরাও একেক জন একেক রকম কথা বলল। মালাজো টলল না। শেষে সে এক শর্ত দিল- এমোরাতার পর সুস্থ হলে যদি তাকে ফের স্কুলে যেতে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করা হয়, তবেই কেবল সে এমোরাতায় বসবে।
কিন্তু কে প্রতিজ্ঞা করবে? মায়ের সম্মতির কোনো মূল্য নেই তাদের সমাজে। বাবার কোনো খবর নেই। সমাজপতিদের ডাকা হলো। জরুরি সভা বসল। সবাই দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে রায় দিলেন, ‘অভিশাপ এড়াতে হলে এমোরাতায় বসতেই হবে। তবে সুস্থ হলে সে স্কুলে যেতে পারবে।‘
এই ঘোষনার পর মালাজো নিজ হাতেই বালিকা হতে নারী হওয়ার উৎসবের সাজ-সজ্জা করল। নাচে যোগ দিল। গান গাইল। পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করল জন আর তার দলবল। মধ্যরাত পর্যন্ত চলল নাচ-গান। তারপর ধীরে ধীরে অতিথিরা চলে গেলে মেয়েদের আলাদা আলাদা তাঁবুতে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। এনকাসিওগি আর মালাজো একে-অপরকে আলিঙ্গন করে নির্ধারিত তাঁবুতে ঢুকল।
৫
একটা প্রায় মরিচা পড়া ছোরা হাতে একজন বয়স্ক মহিলা এসে বসলেন মালাজোর সামনে। তিনিই সব সময় মেয়েদের এমোরাতা করেন। মালাজো মাথা নিচু করল। মহিলা তাকে আশির্বাদ করলেন, ‘তোর পুত্র-কন্যাদের সবার এমোরাতা করানোর ক্ষমতা হোক তোর।‘
মালাজো মহিলার কাছাকাছি হয়ে দু’ পা ফাঁক করে বসল। তাকে দেখাতে লাগল প্রাণহীন কলের পুতুলের মতো। এমোরাতা শুরু হলো। মেয়েদের চিৎকারে তাঁবুগুলো নরকে পরিণত হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। মালাজোর মনে হলো, নিঃশ্বাস নেবার মতো এক ফোঁটা বাতাসও আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। মনে হলো, পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেছে। একটা প্রচন্ড চিৎকারে সেই স্তব্ধতা খন্ডন করে জ্ঞান হারাল মালাজো। বাইরে থেকে তার মা ছুটে এলেন। তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছিল মালাজোর দু’পায়ের ফাঁক।
নারীত্ব অর্জনের অনুষ্ঠানে মালাজো হারাল তার নারীত্বের উপহার; কিন্তু তারচে’ গুরুত্বপূর্ণ হলো, মালাজোর রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যাচ্ছিল না কিছুতেই। কোনো ওষধি গাছের পাতার রস কিংবা বাকল সাহায্য করছিল না। সবাই বলাবলি করল, ‘প্রভু এনগাই ক্রুদ্ধ হয়েছেন। নিস্তার কি মিলবে?’
৬.
মালাজোর সৌভাগ্য, তার নিস্তার মিলেছিল। শাদা বিদেশিদের দলে একজন চিকিৎসক ছিলেন।
সুস্থ হয়ে মালাজো আবার স্কুলে যেতে শুরু করল। তারপর এক শরতে ওল-কুরাইয়ের পাতাগুলো যখন নববধূর মতো রঙিন আর সুন্দর হয়ে উঠল, মালাজোর মাধ্যমিক পাশের খবর প্রচার হলো গাঁয়ে। সবাই বলল, ‘পড়াশোনা করবে ছেলেরা, মেয়েরা কেন বাপু? মেয়েরা গরু-বাছুর, সন্তান আর ঘর সামলাবে।’
মালাজো কান দিল না কারো কথায়। কয়েক মাস পর মালাজোর জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। জন নামের সেই ব্যক্তির কাছ থেকে একটা চিঠি পেল মালাজো, যেখানে ভার্জিনিয়ার একটি কলেজ মালাজোর পড়বার আবেদন মঞ্জুর করেছে এবং তাকে বৃত্তি দিয়েছে বলে উল্লেখ ছিল। গ্রাম ছাড়ার আগে মালাজো তার প্রিয় টিলাটার ওপর উঠে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিল। পাহাড় মানুষকে কী বলে, সেটা সে জানে এখন। কান পাতার প্রয়োজন হয় না।
(টিকাঃ শূকা- মাসাই উপজাতির পোশাক, এমোরাতা- খৎনা, এনগাই নান্নোকে- ঈশ্বরের ক্রুদ্ধ রূপ, এনগাই নারোকে- ঈশ্বরের দয়ালু রূপ, সাভান্না- জঙ্গলাবৃত তৃণভূমি, লাল ওকার- এক ধরণের প্রাকৃতিক রঙ, যে কোনো উৎসবে ব্যবহৃত হয়, ওল-কুরাই- বাবলা/এ্যাকেশিয়ার একটা প্রজাতি, সোপাই- স্বাগত/কেমন আছো, অ্যাশে ওলেং- ধন্যবাদ। )
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:৫৯