এক:
ছাত্রজীবনে টিউশনি পাওয়াটা সত্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার। টিউশানির সুবিধা অনেক, দৈনন্দিন হাত খরচ চালাতে যেমন বাবার কাছে হাত পাততে হয় না এটা যে কারো জন্য গর্বের ব্যাপার,আবার চাকুরীর প্রস্তুতি হিসাবে টিউশনি খুবই উপকারি। মুলত সিক্স সেভেন এইট এই ক্লাশেগুলির অংক ইংরেজিই মুলত বিসিএস সহ অন্যান্য প্রতিযোগিতামুলক পরিক্ষায় আসে,তাই অতি সহজেই একটা টিউশনি পেয়ে রাশেদ খুবই আনন্দিত। টিউশনিটার প্রস্তাব এসেছে রাশেদের বাবার কলিগ ইয়াছিন সাহেবের তরফ থেকে।উনার ক্লাশ এইটের মেয়ে বর্ণাকে পড়াতে হবে সাথে তারই বান্ধবী নুপুর ও পড়বে। মূলত বর্ণার আগ্রহেই তার বাবা রাশেদের কাছে এসেছেই এই টিউশনির প্রস্তাব নিয়ে। সম্মানীও রাশেদের কাছে মুটামুটি আকর্ষনীয়। ক্লাশ এইটের বইয়ের উপর বেশ ভালই দখল তার। তাই রাজী না হওয়ার কোন কারণ নেই। বাজার থেকে কয়েকটা নোট বই কিনে নিজেকে দুদিন ঝালিয়ে নিল রাশেদ।
রাশেদের দুই ছাত্রীর নাম বর্ণা এবং নুপুর। সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া দুটি মেয়ে। বর্ণা বেশ চটপটে, নুপুর একটু গম্ভীর টাইপের। তবে দুটো মেয়েই যথেষ্ট সুন্দরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাস্ট ইয়ারে পড়া ছেলের কাছে ক্লাশ এইটের মেয়েরা নিতান্তই বাচ্চা, তাদের ওদের নিয়ে রাশেদের মনের মধ্যে তেমন কোন ভাবনা নেই। প্রতিদিন বিকেল ৫টায় তাদের পড়াতে যায় রাশেদ। মেয়ে দুটি যথেষ্টই মেধাবী তাই রাশেদকে খুব বেশি একটা বেগ পেতে হয় না তাদের পড়াতে। তবে এরা যথেষ্ট দুষ্টু, কারণে অকারণে একে আপরের দিকে তাকিয়ে অহেতুক হাসাহাসি করে, রাশেদ মাঝেমাঝে বুঝতে পারেনা আসলে তাদের হাসির বিষয় বস্তু কি? রাশেদের ধমকেও তাদের হাসি থামতে চায় না।
রাশেদ ক্লাশ থেকে ফেরার পথে অনেকদিনই খেয়াল করেছে বর্ণা তাদের বাসার খোলা জানালায় চুল খুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম দিকে বিষয়টি কাকতালীয়ই ভাবতো, কিন্তু যখন দেখে প্রতিদিনই একই ঘটনা তখন রাশেদের বুঝতে বাকী রইলো মেয়েটা দিন দিন তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে। আসলে এ বয়সের মেয়েদের বৈশিষ্ট্য এমনি, খুব অল্পতেই প্রেমে পড়ে যায়। তাছাড়া বর্ণার বাবা রাশেদের বাবার কলিগ হওয়ায় রাশেদের বাসায় তার অবাধ যাতায়াত ছিল।
একদিন পড়ার ফাকে বর্ণা বললো
-স্যার আপনি শুধু জিন্স আর টি শার্ট পরবেন, আপনাকে ভাল মানায়,
বলেই বর্ণার নুপুরের একযোগে হাসি।
রাশেদ ধমক দিয়ে ওদের থামায়।
অন্য একদিনের কথা পড়ানো শেষ নুপুর চলে গেছে রাশেদ তখন চা খাচ্ছিল হঠাৎ বর্ণা তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা গিফট বের করে বলে
-হ্যাপি বার্থডে টু ইউ স্যার।আমার কাছে খুব বেশি টাকা ছিল না তাই আপনার জন্য শুধুই একটা টি শার্ট কিনেছি।
আসলে রাশেদের নিজেরও মনে ছিল না আজ তার জন্মদিন। কোন একদিন হয়তো কথায় কথায় বলে ফেলেছিল জন্মদিনের কথা। বর্ণা সেটা তার ডাইরিতে লিখে রেখেছিল। রাশেদ বর্ণাকে একটা ধমক লাগায় এবং বলে
-কোন প্রয়োজন ছিল না তোমার জমানো টাকায় আমার জন্য গিফট কেনার।
-স্যার আপনি যদি আমার গিফট গ্রহণ না করেন তবে আমি খুবই কষ্ট পাবো। অনেকটা বাধ্য হয়েই বর্ণার উপহার গ্রহণ করে রাশেদ।
এভাবেই টানা দুই বছর রাশেদ বর্ণা আর নুপুরকে পড়াতে থাকে।বর্ণা আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে তার ভালবাসার কথা কিন্তু রাশেদ বিষয়টি মোটেই পাত্তা দেয় না।
একদিন পড়াতে গিয়ে খেয়াল করলো বর্ণার মুখে হাসি নেই পড়ার ফাকেই হঠাৎ করেই বর্ণা রাশেদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে,
রাশেদ জিজ্ঞাসা করে
-এটা কি হল?
স্যার আপনার পায়ের সাথে আমার পা লেগেছে তাই সালাম করলাম।
এর পরেরদিনই রাশেদ জানতে পারলো বর্ণার বাবা বদলী হয়ে গেছে, তাই ওরা অন্য শহরে চলে যাবে। টিউশনিটা থাকবে না, রোজগারের পথ বন্ধ তাই কিছুটা হলেও মর্মাহত হল রাশেদ, কিন্তু কি করা! আসলে বর্ণার প্রতি রাশেদের প্রেম ভালবাসার কোন অনূভুতি কখনই কাজ করেনি তাই রাশেদ খুব বেশি দুঃখিতও নয়। শেষ যেদিন পড়াতে যায় এবং বিদায় নিতে যায় সেদিন বর্ণার চোখ ছিল ছলছল। বর্ণার শেষ কথা ছিল
-আপনাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল স্যার কিন্তু তার কিছুই পূর্ণ হল না ।
দুই:
বর্ণারা চলে গেছে রাশেদ তার পড়াশুনায় মনোনিবেশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ চার বছরেও প্রেম ভালবাসার আগমন ঘটেনি তার জীবনে। মাঝেমধ্যে তার এজন্য কিছুটা আক্ষেপও হয়,ইস বন্ধুরা কি সুন্দর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গার্লফ্রেন্ডের হাতের রান্না খাচ্ছে আর তার কাছে এসে গল্প করছে মনের মধ্যে কিছুটা হতাশা বিরাজ করে তার মধ্যে। দু'একজনকে যে তারও ভাললাগেনি তা নয়। আর এই ভালোলাগা একজন মেয়ের নাম মৌলী। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ করেই একটা মেয়েকে দেখে রাশেদের চোখ আটকে যায়। রাশেদের মনে হয় আহা কি সুন্দর মেয়েটা! রাশেদ তার নাম ঠিকানা ডিপার্টমেন্ট সব জোগাড় করে ফেলে। মেয়েটার নাম মৌলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই থাকে। রাশেদ পুরো একটা রাত জেগে মৌলীর জন্য একখানা আবেগঘন ভালবাসার চিঠি লিখে ফেলে।
পরের দিন বিকেলে রাশেদ প্রচুর সাহস সঞ্চয় করে মৌলীর হলের সামনে যায় এবং তার এক সহপাঠী বান্ধবীর মাধ্যমে মৌলীকে কল দেয়। দীর্ঘ এক ঘন্টা অপেক্ষার পর মৌলীর আগমন,
-ভাইয়া আপনি কি আমাকে কল দিয়েছেন? -জি হ্যা, রাশেদের উওর।
-কেন বলুনতো?
-চলুন কোথাও বসে বলি।
-আচ্ছা চলুন।
রাশেদ বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠে তার মনে হচ্ছে কাজ হবে।
রাশেদ মৌলীকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে। হট প্যাটিস আর কোল্ড ড্রিংক অর্ডার দেয়।
মৌলী বেশ মিশুক মেয়ে সেটা রাশেদ অল্প সময়েই বুঝে যায়।
-ভাইয়া আপনি কি বলতে চাইছিলেন যেন?
মৌলীর প্রশ্ন?
যদি প্রেম ভালবাসার কথা বলতে চান তাহলে আমি সত্যি দুঃখিত ভাইয়া।আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।
মৌলীর এই কথা শোনার পর রাশেদ একেবারে চুপসে যায়। তার মনে হয় ধরণি তুমি দুভাগ হয়ে যাও আমি ভিতরে ঢুকে যাই। রাত জেগে লেখা চিঠিটা আর কোনদিনই দেওয়া হয়না।
এরপর ক্যাম্পাসে মৌলীর সাথে অনেকবারই দেখা হয়েছে প্রত্যেকবারই তার সাথে ছিল সেই বয়ফ্রেন্ড, কখনো একটু হেসে কুশল বিনিময় করে চলে গেছে, আবার কখনো কিছু না বলেই পাশ দিয়ে হেটে গেছে। অবশ্য রাশেদ আর মৌলীর ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায় না।
তিন:
রাশেদের পড়াশুনা প্রায় শেষ পর্যায়ে, অনার্স পরীক্ষার রেজাল্টও বেশ ভাল হয়েছে। রাশেদের হাতে বেশ কিছুটা অবসর সময় আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন এডমিশন টেষ্ট চলছে রাশেদের এলাকার কিছু ছোট ভাই তার রুমে থেকে ভর্তি পরিক্ষা দিচ্ছে। ওরা ক্যাম্পাসে নতুন,কিছুই চেনে না, তাই রাশেদ ওদেরকে পরিক্ষার হলে বসিয়ে দিতে ক্যাম্পাসে যায়। ছোটভাইদের পরিক্ষা শুরু হওয়ার আগেই বাইরে বেরিয়ে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ায়। ভাবলো একঘন্টার পরিক্ষা, এত সময় একা একা বাইরে বসে থাকা খুবই বোরিং, তারচেয়ে লাইব্রেরিতে বসে একটু আধটু পড়াশুনা করা ঢের ভাল।
রাশেদ যখন লাইব্রেরিতে ঢুকতে যাবে তখন হঠাৎ করেই খেয়াল করলো একজন বয়স্ক ভদ্রলোক পত্রিকা বিছিয়ে বসে আছেন। লোকটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল তার কাছে তাই দাঁড়িয়ে গেল রাশেদ।
ভাল করে খেয়াল করেই বুঝতে পারলো
-আরে ইনিতো ইয়াছিন আংকেল তার সাবেক ছাত্রী বর্ণার বাবা এবং রাশেদের বাবার সাবেক কলিগ।
কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বললো আংকেল আমি রাশেদ, ইয়াছিন আংকেলও রাশেদকে দেখেই চিনতে পারলো।
-আংকেল আপনি এখানে কি মনে করে?
-আমার মেয়ে বর্ণা এডমিশন টেষ্ট দিতে এসেছে আমি ওর সাথে এসেছি, ও পরিক্ষা দিতে হলে ঢুকেছে তাই আমি বাইরে বসে আছি।
বর্ণা নাম শুনতেই রাশেদের অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। রাশেদ আংকেল পাশেই বসে পড়ে, আংকেল রাশেদের পড়াশুনোর খোজ নেন তার বাবা মা কেমন আছে সেটাও জিজ্ঞাসা করেন। রাশেদও বর্ণার মা আন্টির খোজ নেয়। আংকেলের সাথে কথা বলতে বলতে বর্ণা পরিক্ষা শেষ হয়। রাশেদ বর্ণাকে দেখে পুরোপুরি অবাক! তিন বছর আগের সেই বর্ণার সাথে এই বর্ণার পার্থক্য আকাশ পাতাল। এখন আর তাকে বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে না, এখনকার বর্ণা অনেক সুন্দরী এবং স্মার্ট।
-রাশেদকে দেখে বর্ণাও যে খুবই উচ্ছসিত সেটা রাশেদের বুঝতে বাকী থাকে না।
-ভাইয়া আমার বিশ্বাস ছিল পরিক্ষা দিতে এসে আপনার সাথে দেখা হবেই, দুজনার মোবাইল নাম্বার আদানপ্রদানের কাজটাও এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়। অত:পর বর্ণা ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নেয়।
বর্ণাকে দেখার পর থেকেই রাশেদের বুকের ভিতর তোলপাড় চলতে থাকে। অনেকবার ভাবছে ফোন দেবে কিন্তু পরে ভাবে না থাক বর্ণাই আগে ফোন দিক। রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন বর্ণা ফোন আসে না তখন রাশেদ নিজেই ফোন দেয়। ফোন পেয়ে বর্ণার প্রথম কথা ছিল
-আমি সেই সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি আপনার ফোনের আর এখন সময় হল আপনার?
রাশেদের কোনকিছু বলার প্রয়োজন হচ্ছে না, বর্ণা তার হাবভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে রাশেদকে কতটা ভালবাসে।
-তুমি কবে থেকে এত সুন্দরী আর স্মার্ট হলে? রাশেদের প্রশ্ন।
-আমি সবসময়ই স্মার্ট ও সুন্দর সেদিন আপনার চোখ ছিল না তাই দেখতে পাননি,বর্ণার উওর। এভাবেই মোবাইলে রাতের পর চলতে থাকে ভালবাসা মাখা কথোপকথন।
দুজন দুই শহরে থাকায় তাদের মধ্যে দেখা হয় না শুধুই ফোনে চলতে থাকে তাদের ভালবাসার কথোপকথন।
চার:
রাশেদের পড়াশুনা শেষ সে ঢাকায় এসেছে চাকুরী খুঁজতে। ওদিকে বর্ণা একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ইদানীং বর্ণার ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে রাশেদের ফোন রিসিভ করে কম। একদিন বর্ণা বলেই ফেললো
-একবছর হল পড়াশুনা শেষ করেছো এখনো একটা চাকুরী জোগাড় করতে পারলে না, তোমার সাথে আমি আর নেই আজই তোমার সাথে আমার শেষ কথা,আসলে আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।
বর্ণার এমন আচরণে খুবই কষ্ট পায় রাশেদ, আসলেইতো বর্ণা ঠিকই বলেছে আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।
ইতিমধ্যেই অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। বর্ণা ভেবেছিল রাশেদ সারাজীবনই বেকার থাকবে আসলে তেমনটি ঘটেনি রাশেদ চাকুরী পেয়েছে,বিয়েসাদী করে সংসারী হয়েছে।রাশেদ জানেনা বর্ণা কোথায় আছে? জানতেও চায় না,যে সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে তাকে হারিয়ে যেতে দিতে হয়।তবে এখনো বর্ণার একটা কথা তার কানে বাজে 'আবেগ দিয়ে জীবন চলে না'।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:১৩