কানাডা দেশটার নাম শুনলে প্রথম যে তিনটি জিনিসের কথা মাথায় আসবে তা হচ্ছে বর্তমানে সবচেয়ে ভদ্র এবং সুদর্শন চেহারার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, লাল রংয়ের ম্যাপল লীফ আর অপুরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নায়াগ্রা ফলস। আর কানাডা নিয়ে সেই কৌতুকটার কথা কে না জানে। ঐ যে, একটা কানা ছেলেক পড়া না পারার জন্যে স্কুলের পিছনে বেধে রাখা অতঃপর শিক্ষকের কানাডা কোথায় অবস্থিত প্রশ্নের উত্তরে এক ছাত্রের উত্তর:- কানাডা স্কুলের পিছনে অবস্থিত। এইতো দুই দিন আগেই কানাডার স্বাধীনতার ১৫০ বছর পূর্তি হলো। আর ১৫০ বছর আগে কার থেকে স্বাধীন হয়েছিল বলেনতো! সেই ব্রিটিশ, শালার এমন কোনো দেশ নেই যাদেরকে শোষন করেনি! যাই হোক সূচনাপর্ব সমাপ্ত করে এখন মূল বর্ননায় যাই। (ভ্রমনের ভিডিওর লিংক দিয়ে দিচ্ছি: https://www.youtube.com/watch?v=1fHDqx1kJPU )
গত মাসেই ঘুরে আসলাম কানাডার অন্টারিও শহর থেকে। আমি আমেরিকার যে স্ট্যাট(মেরিল্যান্ড) এ থাকি সেখান থেকে গাড়ি চালিয়ে যেতে সর্বোচ্চ সাত ঘন্টা লাগে। যদিও এতো লম্বা সময় গাড়ি চালাতে হলে পথিমধ্যে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কয়েকবার যাত্রা বিরতি দিতে হয়। পাহাড় বেয়ে কোথাও রাস্তা উপরে চলে যাচ্ছে আবার কোথাও নিচে নেমে যাচ্ছে। আর রাস্তার দুধারে সবুজ গাছ গাছালি আর বনজন্গল তো রয়েছেই। দূরের পাহাড়পর্বত গুলো আস্তে আস্তে কাছে চলে আসছে আবার দূরে সরে যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা এতো উচুতে যে সেখানে গাছের ফাকে ফাকে সাদা মেঘ জায়গায় জায়গায় জমাট বেধে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। অনেকক্ষন পর পর একটা দুইটা লোকালয় চোখে পরে আবার হারিয়ে যায় গাছগাছালি আর পাহাড়পর্বতের আড়ালে। আর এসব লোকালয়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট কোনোটাই পাওয়া যায় না। মেরিল্যান্ড থেকে পেনসিলভেনিয়া হয়ে নিউইউর্কের বাফেলো শহরের উপর দিয়ে আপনি আমেরিকা আর কানাডার বর্ডারে এসে পৌছাবেন। কানাডার বর্ডারের কাছাকাছি চলে আসলেই দেখা মেলে নায়াগ্রা নদীর যার স্বচ্ছ নীল পানি গিয়ে পরেছে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে।
এখানকার রাস্তাগুলোতে কিছু বিশেষ বিশেষ ট্রাফিক সাইন দেখা যায়, যেমন হরিনের ছবি কিংবা ভাল্লুকের ছবি সম্বলিত ট্রাফিক সাইন যার মানে হচ্ছে যে, এসব রাস্তায় যে কোনো সময় হরিন কিংবা ভাল্লুক আপনার গাড়ির সামনে চলে আসতে পারে তাই গাড়ির চালকরা যাতে সতর্ক অবস্থায় থাকে। এ তো গেলো হাইওয়ের বর্ননা।
আট ঘন্টা যাত্রা শেষে অবশেষে আমরা যখন হোটেলে এসে পৌছালম তখন প্রায় চারটা বাজে। আমেরিকার মতন কানাডার হোটেলেও দেখলাম যে তাদের এখানে ১৩ নাম্বার রুমটা অনুপস্থিত। কারন ১৩ সংখাকে তারা অশুভ মনে করে। এবং হোটেলের রুমে বাইবেল রাখা।
হালকা একটু রেস্ট নিয়ে বের হয়ে গেলাম আমাদের বহু আকাঙ্খিত নায়াগ্রাফলস দেখার উদ্দেশ্যে। ছবি কিংবা ভিডিওতে অনেকবার নায়াগ্রাফলস দেখেছি কিন্তু নিজের চোখে সামনা সামনি নায়াগ্রাফলস দেখার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করবার মত নয়। অসাধারন সুন্দর। মনে হয় যেনো সবুজ পানিতে গিয়ে ঝাপ দেই। নায়াগ্রাফলস আসলে তিনটি জলপ্রপাতের সমুষ্ঠি। সবচেয়ে বড় এবং প্রধান যেটা তার নাম হচ্ছে হরসশু জলপ্রপাত ঘোড়ার খুরের মতন আকৃতি দেখে এই নামকরন। মাঝারি জলপ্রপাতটির নাম হচ্ছে আমেরিকান ফলস। এইটা সম্পূর্নই আমেরিকার বর্ডারে অবস্থিত। তৃতীয় এবং সবচেয়ে ছোটোটির নাম হচ্ছে ব্রাইডাল ভেইন ফলস। চাইলে আপনি বোটে করে খুব কাছ থেকেই তিনটি জলজলপ্রপাত দেখে আসতে পারে।
এই তিনটি জলপ্রপাতের মধ্যে প্রধান আকর্ষন মূলত সবচে বড়টি যেটির নাম হচ্ছে হর্ষশুফলস। জলপ্রপাতের উপরে সবসময় এক পাল কালো মেঘ ভেসে থাকতে দেখা যায়। ছোটবেলায় আমরা রংধনু দেখতাম আর বলতাম যে রংধনুর শেষপ্রান্তে গুপ্তধন পাওয়া যায়। কথাটা আসলে সত্য নয়। কারন বিকেলের রৌদ্র জলপ্রপাতের বাষ্পকনায় প্রতিফলিত হয়ে সুন্দর সাতরঙ্গা রংধনুর সৃষ্টি হয়। রংধনুর এক মাথা পানির উপর গিয়ে শেষ হয়েছে অন্য প্রান্ত আকাশে ভাসমান অবস্থায় ঝুলে থাকতে দেখা যায়। মূলত গৃষ্মের পুরাটা সময় জুড়েই হাজার হাজার মানুষ নায়াগ্রার এই অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে সেখানে উপস্থিত থাকে। শীতের সময় আস্তে আস্তে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমতে শুরু করে। আমরা অবশ্য বোটের টিকিট কেটে একে বারে কাছ থেকে দেখে এসেছি তিনটি ফলসকে। জলপ্রপাতের একেবারে কাছাকাছি আসলে পানিতে সম্পূর্ন ভিজে যেতে হয়। এজন্য বোটে উঠার আগে শরীলের উপর পরার জন্য হালকা পলিথিনের একটি কোট দিয়ে দেয়। যদিও সেটা তেমন কোনো কাজে দেয় না। প্রথম দিন আমরা জলপ্রপাত আর এর আশে পাশের এলাকা ঘুরে রাতে একটি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে খেয়ে হোটেলে ফিরে আসি।
পরের দিন ঈদের দিন ছিলো। তো সকালে উঠে এক ঘন্টা ড্রাইভ করে আমরা একটি ঈদগাহে গিয়ে ঈদের জামাত আদায় করে আবার দ্বিতীয় দিনের যাত্রা শুরু করি। প্রথমেই যাই একটা ফ্লোরাল ঘড়ি দেখতে এর পর যাই বার্ড কিংডমে। হোটেল যাওয়ার পথেই চোখে পরে বৌদ্ধদের অনেক বড় একটি উপসনালয়। গৌতম বুদ্ধের সহ আরো শখানেক মূর্তি রয়েসে সেই উপসনালয়ে। কানাডায় এত বড় বৌদ্ধমন্দির দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি। বার্ড কিংডমে হরেক রকমের পাখি, বৌদ্ধমন্দির আর শহরের ডাউন টাউনে ঘুরাঘুরি করে সন্দ্ধায় আমরা রউনা হই এক আত্নীয়ের বাসার উদ্দেশ্যে। আমরা যে হোটেলে থাকি সেখান থেকে ড্রাইভিং করে কানাডার টরেন্টো শহরে যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘন্টা। যাওয়ার পথে আপনার নজরে আসবে রাস্তার এক ধারে সাগর আর অন্য পাশে বিরান ভুমি। কিছু দুর পর পর সাইন বোর্ডে সে সব গ্রামের লোক সংখ্যা লেখা থাকে। যেমন একটা সাইন বোর্ডে দেখলাম সেখানের পপুলেশন মাত্র ২০হাজার। কত বড় বড় গ্রাম আর মানুষ মোটে বিশ হাজার। টরেন্টো শহরে ঢুকার পথেই আপনার চোখে পরবে সুউচ্চ সব দালান কোঠা। আরো দেখতে পারবেন কানাডার সবচয়ে বড় দালান যার নাম হচ্ছে সি এন টাওয়ার (টিকিট কেটে এই টাওয়ারে উঠতে হয়)। এই বড় বড় দালান কোঠায় অবস্থিত অফিস থেকেই তাদের দেশের মূল অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়। যাই হোক রাতে সেই আত্নীয়ের বাসায় খাওয়া দাওয়া করে ড্রাইভ করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত একটার মত বেজে যায়।
পরের দিন সকালে উঠে বিদায়ের পালা। এত সুন্দর একটা যায়গা আসলে এত কম সময় ঘুরে তেমন একটা তৃপ্তি পাওয়া যায় না। এর পর যদি আবার আসি তবে অবশ্যই কয়েকদিন হাতে সময় নিয়ে আসব। কারন এক নায়াগ্রা ফলস দেখেই আপনি পুরো একদিন সময় পার করে দিতে পারবেন। আজকের মতন তাহলে এখানেই থামছি। পরে আবার আপনাদের সাথে কথা হবে সে পর্যন্ত ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।
রংধনুর শেষ প্রান্তে কোনো গুপ্তধন নাই। খালি পানি আর পানি!
কানাডার ডাউনটাউনের একটি ছবি।
কানাডার ডাউনটাউন।
এই ঘড়িটাকে বলা হয় ফ্লোরাল ক্লক।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ৩:০৪