চুরি হওয়া বা যাওয়া আমাদের দেশের জন্য নতুন কিছু নয়,আমাদের দেশে অতীতে ব্যাংক জালিয়াতিতে যে পরমিাণ অর্থ চুরি হয়েছে, তার তুলনায় এই চুরি কম হয়েছে ধরে নেয়া যায়,মাত্র ৮০০ কোটি টাকা। কেউ কেউ আবার বলবেন, এ তো মাত্র শতকের ঘরে, হাজারের ঘরে তো তো পেরিয়ে যায়নি,হাজারের ঘর পেরিয়ে গেলেও তা ছোট খাট চুরি মাত্র,বলতেই পারেন, কারণ আমরা ক্রমেই বিত্তশালী দেশে পরিণত হচ্ছি, সেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকা চুরিকে ‘তুচ্ছ, কিছুর সাথে তুলনা করতে পারি।যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে গচ্ছিত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ডিজিটাল পদ্ধতিতে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি হয়েছে।এই খবর টি আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকাতে প্রকাশ হওয়ার পর আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত মনে করেন, অর্থ চুরির বিষয়টি তাঁকেসহ অন্যদের না জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।তবে এবারের চুরিটি অন্যরকম। চারটি দেশ জড়িত এবং বড় মাপের চুরি। তথ্যে প্রকাশ, প্রায় ২০ কোটি টাকা শ্রীলঙ্কায় পাওয়া গেছে। বাকি প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইন হয়ে হংকংয়ে পৌঁছেছে। এর পেছনে রয়েছেন একজন চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিনো ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই পরিমাণ অর্থ কীভাবে গেছে, তার তদন্ত চলছে। ফিলিপাইনে যেভাবে এ টাকা পৌঁছানোর পর বিভিন্ন হাত ঘুরে হংকংয়ে পৌঁছায়, এই ডিজিটাল চুরি কে সাই -ফাই ফ্লিমের ব্যাংক হ্যাকিং করাকে হার মানায়।
দেশি বিদেশি পত্রিকার তথ্যমতে,এই চুরির বা মানি লন্ডারিংয়ের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক করপোরেশনের (আরসিবিসি) মাধ্যমে জালিয়াতি হয়েছে, যার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছে ফিলিপাইনের ডেইলি ইনকোয়ারার। অবশ্য এই বিশেষ পত্রিকাটি ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বিষয়টি অনুসন্ধান করছিল। আলোচ্য ব্যাংকটি একটি প্রাইভেট ব্যাংক। পত্রিকাটি আরও তথ্য দেয়, বাংলাদেশের অ্যাকাউন্ট থেকে আরও ৮৭ কোটি ডলার চুরির উদ্যোগ রুখে দেওয়া হয়েছিল এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর। একই সূত্র থেকে এ প্রচেষ্টা চলেছিল বলে ওই পত্রিকার দাবি।
উল্লিখিত পত্রিকায় প্রকাশিত বিস্তারিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে এ ঘটনার কারণে ওই ব্যাংকের জুপিটার স্টিট, মাকেলি শহরের ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের সহকারীকে দায়ী করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই ব্যক্তির তথ্যমতে, ২০১৫ সালের মে মাসে ম্যানেজারের নির্দেশে পাঁচটি ভুয়া আইডির সাহায্যে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। এসব অ্যাকাউন্টের হয়ে এত বড় অর্থ বিদেশি মুদ্রা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা ৩৭ লাখ পেসোতে রূপান্তরিত করা হয় এবং তা তিনটি জুয়ার আড্ডা বা ক্যাসিনোতে দেওয়া হয়। ক্যাসিনো তিনটির নাম সোলার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি অব ড্রিমস এবং মাইডাস ক্যাসিনো। ওই ক্যাসিনোগুলো প্রাপ্ত অর্থ চিপসে পরিণত করে জুয়ায় খাটানোর পর ওই চিপসগুলো পুনরায় স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করে হংকংয়ে পাচার করা হয়। এ অভিনব উপায়ে প্রাপ্ত অর্থকে বৈধ পথে হংকংয়ে পাঠানো হয়েছে।
আলোচিত পত্রিকায় আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটি ব্যাংক ও উইলস ফারগোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক তার বার্তার মাধ্যমে এসব অর্থ ট্রান্সফার করা হয়। এই তিনটি ব্যাংকই ছিল সহযোগী ব্যাংক। ফিলিপাইনের ওই পত্রিকামতে, ফিলিপাইনের আলোচিত ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে আগাম তথ্য ছিল এবং ম্যানেজারসহ ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা এর সঙ্গে জড়িত, এমন তথ্য ব্যাংকটি অস্বীকার করেছে। এ ধরনের এত বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচার ফিলিপাইনের ইতিহাসে নথিভুক্ত প্রথম ঘটনা।
এত বড় অর্থ পাচার, ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা এবং রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক করপোরেশনের জড়িত থাকার বিষয় নিয়ে ফিলিপাইনের গণমাধ্যমগুলো বেশ কিছুদিন থেকেই সরব। এর মধ্যে প্রধান আলোচিত পত্রিকা ডেইলি ইনকোয়ারার। পত্রিকার তথ্যমতে, ফিলিপাইন সরকার এ ঘটনায় দারুণ বিব্রত ও স্তম্ভিত হয়েছে। ঘটনার তদন্তে নেমেছে ফিলিপাইন সিনেটের বিশেষ কমিটি, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই) এবং ফিলিপিনস অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড গেমিং করপোরেশন, যারা নিজেরা ক্যাসিনো চালায়, ক্যাসিনোগুলোর তদারক করে এবং সনদ দিয়ে থাকে। ফিলিপাইনের সবচেয়ে বড় অর্থ পাচারের ঘটনাকে ওই দেশের সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছে।
এশিয়ার অর্থনীতির ওপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও ভারত সরকার আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এখন দিল্লিতে । এসময় বাংলাদেশের একটি পত্রিকার ভারতের প্রতিনিধিকে তিনি অর্থ চুরির বিষয় নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সম্মেলনের ফাঁকে দিল্লির তাজমহল হোটেলে তিনি এ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বলে পত্রিকাটি জানায়।
রোববার প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ড. আতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাকিংয়ের ঘটনার পর সাইবার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাংকিয়ের মাধ্যমে আট কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা গোটা বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এখানে তিনি আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিনা লাগার্দসহ বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। হ্যাকারদের পরিচয় অচিরেই পাওয়া যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ড. আতিউর রহমান বলেন, হ্যাকাররা হাতিয়ে নেওয়া অর্থ ফিলিপাইনে পাচার করে। ঘটনার পর ফিলিপাইন সরকার নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা আন্তরিকভাবে তদন্ত করছেন। বিষয়টি নিয়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। হ্যাকাররা যে অর্থ জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তার ৮০ শতাংশ রুখে দেওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক উদ্যোগের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে ফিরিয়ে আনা যাবে।
অতপর:আজ রোববার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা সাংবাদিকদের জানানো হবে।