ড. ইউনূস নোবেল শানিত্ম পুরস্কারটিকে কাজে লাগাতে পারলেন না
যে রাষ্ট্রপতি এখনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অঙ্গুলি হেলনে চলেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে বসার পর একবারও নিজের সাহস ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে পারেননি, ড. ইউনূস তাকে সাহসী ও সক্ষম ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন, ‘আপনি শক্ত হোন এবং কারো কথা না শুনে শক্তভাবে এবং চোখ বুজে সিদ্ধানত্ম নিন।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতিকে জনদাবি না মেনে শক্ত হয়ে থাকার জন্যই পরামর্শ দিয়েছেন। তাহলে লাভ বিএনপি-জামাত জোটের। ক্ষতি বাংলাদেশের।
ড. মুহম্মদ ইউনূসের এবার নোবেল শানিত্ম পুরস্কার লাভ বাংলাদেশ ও বাঙালির একটি বড় অর্জন এবং গৌরবের বিষয়ও। এর আগে আরও দুজন বাঙালি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। একজন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, তিনি সাহিত্যে এবং অন্যজন ড. অমর্ত্য সেন, তিনি অর্থনীতি বিষয়ে পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। তাদের মেধা ও প্রতিভার সঙ্গে আমি ড. ইউনূসের তুলনা করছি না। তাকে সাহিত্য, অর্থনীতি দর্শন ইত্যাদি কোনো বিষয়েই মৌলিক গবেষণা বা অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে তার উদ্ভাবিত গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস'ার ব্যবসায়ের সাফল্যের জন্য। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। সুতরাং আর কোনো বিষয়ে তাকে পুরস্কার দেওয়ার সুযোগ না থাকায় শেষ পর্যনত্ম শানিত্ম পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। তাতেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ উল্লসিত।
নোবেল শান্তি পুরস্কারটি এখন বিতর্কিত। স্নায়ু যুদ্ধের আমল থেকে এই পুরস্কারটির পশ্চিমা শিবিরের রাজনৈতিক স্বার্থে বারবার ব্যবহৃত হওয়ায় এই পুরস্কারটির আগের মর্যাদা নেই। এই পুরস্কারটি পাওয়ার সবচেয়ে যোগ্যতম প্রার্থী মহাত্মা গান্ধীর নাম পুরস্কার লাভের জন্য ৫ বার উত্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও মরণোত্তর পুরস্কার হিসেবেও তাকে এটি দেওয়া হয়নি। কিন' এ বছর ড. ইউনূসের নাম শানিত্ম পুরস্কার লাভের জন্য প্রসত্মাবিত না হওয়া সত্ত্বেও তাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে কোনো রহস্য আছে কিনা, তা নিয়েও কোনো কোনো মহলে জল্পনা-কল্পনার অনত্ম নেই।
নোবেল শান্তি পুরস্কারটি পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির যারা মহানায়ক এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যারা বিবেচিত হওয়ার যোগ্য, তাদের অনেককেও দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ড. ইউনূসের এই বিতর্কিত পুরস্কারটি লাভ অথবা এই পুরস্কার পাওয়ার পরই আমেরিকার একটি আশ্রিত দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওলে ছুটে গিয়ে আরেকটি শানিত্ম পুরস্কার গ্রহণ তার প্রকৃত মর্যাদা কতোটা বাড়িয়েছে, সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। বাংলাদেশেও তার নোবেল পুরস্কার লাভ নিয়ে যে ইউফোরিয়া শুরু হয়েছে তা কেটে গেলে তাকে এই পুরস্কার দেওয়ার উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা এবং তার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে।
ড. ইউনূসকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রভাবশালী মহল চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। তাদের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন একজন। ক্লিনটন যখন আরাকানসাস রাজ্যের গভর্নর ছিলেন তখন থেকেই ড. ইউনূসের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব। শোনা যাচ্ছিল, ড. অমর্ত্য সেনের পর ড. ইউনূসকেই অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। কিন' অর্থনীতিতে তার মৌলিক অবদান সম্পর্কে বিচারকমণ্ডলীকে নাকি কনভিনসড করা যায়নি। ফলে এ বছর তার নাম শানিত্ম পুরস্কারের জন্য উত্থাপিত না হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ মহলের চেষ্টায় তড়িঘড়ি পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। হয়তো বিচার-বিবেচনা করেই তাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। কিন' নরওয়ের রাজধানী যে অসলো শহর থেকে পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয়েছে, সেই শহরের কোনো কোনো পত্রিকায় এ কথাও বলা হয়েছে, ড. ইউনূসের যে গ্রামীণফোনের ব্যবসা বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য ধার্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, সেই গ্রামীণফোন ব্যবসায়ের শতকরা ৮০ ভাগের মালিক হচ্ছে নরওয়েজিয়ান কোম্পানি। এ খবর জেনে অনেকে দুয়ে দুয়ে চার করেছেন।
সন্দেহবাতিকরা বলেন, ড. ইউনূসকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে দেশটিতে তাকে হিরো বানানোর পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর অন্য উদ্দেশ্যেও রয়েছে। তা হলো দেশটিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সফল হতে না দিয়ে এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসতে না দিয়ে অরাজকতা, সন্ত্রাস ইত্যাদির ধুয়ো তুলে তাদের পছন্দ মতো একটি অনির্বাচিত সিভিল সরকার ক্ষমতায় বসানো এবং ড. ইউনূসকে জাতীয় হিরো হিসেবে সেই সরকারের প্রধানের পদে বসানো। এ নিয়ে বাংলাদেশে কথাবার্তাও উঠেছিল প্রচুর। অনেকে ড. ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার জন্যও আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন' এই পরিকল্পনাটি কার্যকর করা যায়নি। অবস'া বুঝে ড. ইউনূসও বলেছেন, আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে চাই না।
কিন' তার মন থেকে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে মুছে যায়নি, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, সিওল যাত্রার প্রাক্কালে তার ঘোষণায়। তিনি সাংবাদিকদের জানালেন, তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন। তার অসতর্ক মুহূর্তের এই কথাটিই তাকে দেশে বিতর্কিত করে তোলে। অনেকেই বুঝতে পারেন, নোবেল শানিত্ম পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলাদেশে তাকে নিয়ে যে ইউফোরিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তার সুযোগ নিয়ে এবং নোবেল পুরস্কারটিকে ব্যবহার করে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চান। গ্রামীণফোন ব্যবসা থেকে মুনাফার পাহাড় তৈরি করা, গ্রামীণ ব্যাংকের অস্বাভাবিক ও উচ্চ সুদের হার নিয়ে তার যে কাবুলিওয়ালা ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছিল, নোবেল শানিত্ম পুরস্কার পাওয়ায় তার সেই ইমেজ আপাতত ধামাচাপা পড়ে এবং তিনি কিছুদিনের জন্য জাতীয় হিরো হয়ে ওঠেন। তিনি সম্ভবত এই অবস'ার সুযোগ নিতে চেয়ে নিজেকে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে ফেলেছেন।
এখন দেশের কয়েকটি মহল থেকেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তাকে যে নোবেল শানিত্ম পুরস্কার দেওয়া হলো, তার যৌক্তিকতাটা কি? তিনি বিদেশী সাহায্যের টাকায় বিশাল সুদের ব্যবসা করা ছাড়া দেশ বা বিদেশে শানিত্মর জন্য কী অবদান রেখেছেন? ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নর্যাতন, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক হত্যা চলেছে, তিনি তার বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। শেখ হাসিনার ওপর ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর (যে হামলায় ২২ ব্যক্তির মৃত্যু এবং অসংখ্য নরনারী আহত ও পঙ্গু হয়) তার শত্রুমিত্র সকলেই তাকে দেখতে গেছেন অথবা তাকে সাহস ও সমবেদনার বাণী পাঠিয়েছেন। একমাত্র ড. ইউনূস শেখ হাসিনাকে দেখতে যাওয়া দূরের কথা, একটা টেলিফোনও করেননি। তবু এ বছর নোবেল শানিত্ম পুরস্কার পাওয়ার পর শেখ হাসিনা তাকে বিদেশে বসেও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ড. ইউনূস বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন, তার রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ আগ্রহী ও আস'াশীল নয়। তাই বলতে শুরু করেছেন, তিনি এখনই রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান না। কিন' তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করলেও বাংলাদেশকে কী নতুন রাজনৈতিক দর্শন উপহার দেবেন, কী নতুন পথ দেখাবেন? তার ঝোলায় নতুন কী আছে? তিনি যে বিএনপি-জামাত জোটের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সমর্থক তা ৫ বছর আগেই প্রকাশ করেছিলেন। বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় বসার পর উল্লাস প্রকাশ করে একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছিলেন- ‘এবার বাংলাদেশে উন্নয়নের সম্ভাবনার সব দরজা খুলে গেছে।’ বিএনপি-জামাতের ৫ বছরের শাসন দেখার পর তিনি এখন এই শাসন সম্পর্কে মুখ খুলছেন না কেন?
বাংলাদেশে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বদলে সংবিধান, জনমত, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে দলীয় রাষ্ট্রপতির দ্বারা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে, ড. ইউনূস বাংলাদেশে ফিরে এসে তাকেই সমর্থন দিয়েছেন। তার নোবেল পুরস্কার লাভের জনপ্রিয়তাকে তিনি অগণতান্ত্রিক পন'ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদে বসা এক ব্যক্তি ও তার কার্যকলাপকে সমর্থন দানের জন্য ব্যবহার করতে চান। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জনগণের যে দাবি, যে দাবি পূরণই বাংলাদেশে শানিত্ম ও স্বাভাবিক অবস'ার নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে সেই দাবির সঙ্গে কণ্ঠ না মিলিয়ে রাষ্ট্রপতির অবৈধ কার্যকলাপ দেশটিকে যে ভয়াবহ অরাজকতা ও অশানিত্ম সৃষ্টির দিকে ঠেলে দিচ্ছে নোবেল শানিত্ম পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূস তাকেই উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। নোবেল জয়ী শানিত্মবাদীর কী চমৎকার ভূমিকা।
সমপ্রতি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বঙ্গভবনের দরবার হলে ড. ইউনূসের এক সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। সেখানেও ড. ইউনূস তার স্বভাবসুলভ ভাষায় রাজনৈতিক সরকারগুলোর সমালোচনা করেছেন এবং যে সরকার অনির্বাচিত এবং জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন বঞ্চিত সেই সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে সাহসী কাজের দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এই সরকারই নাকি তিন মাসের মধ্যে দুর্নীতি দমন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সঙ্কট সমাধান পর্যনত্ম সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারে। অর্থাৎ নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার নয়, একটি অনির্বাচিত ও বিশেষ দলের হ্যান্ডপিকড প্রেসিডেন্টই দেশের সব সমস্যার সমাধান করার উপযুক্ত লোক। তিনি তাকে শক্ত ও কঠোর হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। যে রাষ্ট্রপতি এখনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অঙ্গুলি হেলনে চলেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে বসার পর একবারও নিজের সাহস ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে পারেননি, ড. ইউনূস তাকে সাহসী ও সক্ষম ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন, ‘আপনি শক্ত হোন এবং কারো কথা না শুনে শক্তভাবে এবং চোখ বুজে সিদ্ধানত্ম নিন।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতিকে জনদাবি না মেনে শক্ত হয়ে থাকার জন্যই পরামর্শ দিয়েছেন। তাহলে লাভ বিএনপি-জামাত জোটের। ক্ষতি বাংলাদেশের। কারণ রাষ্ট্রপতি ড. ইউনূস গণদাবি না মানলে বাংলাদেশে সংঘর্ষ ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে। ‘শানিত্মর পূজারী’ ড. ইউনূস কি তাই চান?
প্রেসিডেন্ট ভবনের দরবার হলে ড. ইউনূসের সংবর্ধনাকে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা বলা হয়েছে। কিন' এই সংবর্ধনায় শেখ হাসিনাসহ ১৪ দলের কোনো নেতানেত্রী যাননি। যাননি দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও। তাহলে এটা কি করে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা হলো? বরং বলা চলে দলীয় রাষ্ট্রপতি দ্বারা আয়োজিত দলীয় সংবর্ধনা। এটাও কী নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর ভাবমূর্তি ও মর্যাদা বাড়ানোর কাজে কিছু মাত্র সহায়ক হলো বা হবে? এই নোবেল শানিত্ম পুরস্কার লাভের আনন্দ ও বিজয়কে ড. ইউনূস সত্য সত্যই জনগণের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের কাজে লাগাতে পারতেন। পারতেন গণআন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে শানিত্মপূর্ণ পথে তাদের দাবি আদায়ের কাজে প্রভাব ও শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে। তিনি তা পারলেন না। এটা বাংলাদেশের জন্য এক চরম দুর্ভাগ্য।
লন্ডন ।। ৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার, ২০০৬
আবদুল গাফ ফার চৌধুরী : সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১:০৪