somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি টিউশনের গল্প

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২০১৫ সালের মার্চ মাসের কথা। একটা টিউশন শুরু করি। মাত্র তিন অথবা চার মাস পড়াই। দুই ভাই বোন। ভাইটা ক্লাস ফাইভে এবং বোনটা ক্লাস ফোরে। এটাই জীবনের প্রথম টিউশন। একই সাথে ক্লাস নাইনের এক স্টুডেন্ট কেও পড়ানো শুরু করি। তার গল্প না হয় অন্য কোন দিন বলবো।
আংকেলের আর্থিক স্বচ্ছলতা খুব একটা ভালো না হওয়ায় আমি মোটামুটি বেতনেই পড়াতে রাজি হলাম।
প্রথমদিনের অভিজ্ঞতাটাই ছিল বেশ কষ্ট লাগার মতো। ছেলে মেয়ে দুটোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর আন্টির প্রথম প্রশ্ন ছিল, "আম্মু, একটু দেখে বলোনা, আমার ছেলেটা কি প্রতিবন্ধী? " প্রথম প্রশ্নেই বুকটা কেঁপে উঠলো।
খুব অস্বস্তির হাসি হেসে বললাম, "না আন্টি। কি বলেন আপনি!!!! প্রতিবন্ধী হলে কি আপনার ছেলে পড়া শুনা, খেলাধুলা, দৌড় ঝাঁপ এসব করতে পারতো? ও অনেক সুস্থ একটা ছেলে।" বলেই বাচ্চাটার দিকে তাকালাম। ছেলেটাও অনেক মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালো। ওর হাসিতে একটা প্রশান্তি ছিল, একটা সন্তুষ্টির ছাপ ছিল।
এভাবে এক মাস পার হয়ে যায়। আন্টিও পড়ার ফাঁকে আমার সাথে গল্প করে। অনেক কথা শেয়ার করে। বাচ্চা দুটোর পাশাপাশি আংকেল আন্টিও আমার উপর অনেক নির্ভর হয়ে পড়ে। এই নির্ভরতা থেকে আন্টি ঘরের অনেক কথাও আমাকে বলে ফেলেন। একবার বলেছিলেন, "আম্মু জানো, আমার ছেলেটার শরীরটা দেখতে এমন কেনো? কেনো ও সব সময় অসুস্থ থাকে? ওর জন্মের পর না আমি ওকে খুব মারতাম। হাতের কাছে যা পেতাম, তাই দিয়েই মারতাম।"
-আন্টি, এতো ছোট বাচ্চাকে কেনো মারতেন?
-কি করবো বলো? ও অনেক দুষ্ট। আমার কোন কথাই শুনতো না। এখনো শোনেনা। আমাকে অনেক জালাতো।আমি সহ্য করতে না পেরে মারতাম।
-বাচ্চার তো একটু দুষ্টামি করেই। এত কিছু তো ওরা বুঝেনা। বড় হলে যখন সব বুঝতে শিখবে, তখন নিজ থেকেই শান্ত হয়ে যাবে। মারলে এটা বাচ্চাদের মনের উপর অনেক খারাপ প্রভাব ফেলে।
- সত্যি বলতে কি, আমরা তখন গ্রামে ছিলাম। তোমার আংকেল চাকরিতে নতুন জয়েন করেছিল। তাই জুনিয়র অবস্থায় কোয়ার্টার পায়নি। আমি ছিলাম আমার শ্বাশুড়ির সাথে। উনি আমাকে অনেক জ্বালাতো। ঠিক মতো খেতে দিতোনা। তোমার আংকেল কোন চিঠি পাঠালে আমাকে জানাতো না। তোমার আংকেল ভাবতো আমি ইচ্ছা করে চিঠির উত্তর দেই না। উনি উনার ছেলেকে চিঠিতে অনেক আজে বাজে কথা লিখত আমার বিরুদ্ধে। লিখত, আমি নাকি ঠিক মতো আমার শ্বাশুড়িকে খেতে দেইনা। ভালো ব্যবহার করিনা। এভাবে ওকে উস্কায় দেয়। তোমার আংকেল ছুটিতে বাড়ি আসলে আমার সাথে কোনদিন ঠিক করে একটা কথাও বলতেন না। আমি খুব কষ্ট পেতাম। যে মানুষ টার জন্য এতগুলা মাস অপেক্ষা করতাম, কত কথা, কত অভিযোগ থাকতো বলার জন্য, কিছুই বলতে পারতাম না। একবার অভাবের তাড়নায় আমি আমার গলার স্ব্ররণের চেইনটা বিক্রি করে দিয়ে ঘরে চাল, ডাল, নূন, মসলা-পাতি সব আনি। আর এই ঘরেই তোমার আংকেল বেতন পাওয়ার পর যে টাকা পাঠাতো, তা আমার হাতে কোন দিন আসতোনা। আমি প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় আরেক মহিলার বুদ্ধিতে আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়। সারা রাত ঘরে ঢুকতে দেয়নি। সন্ধ্যার পর অনেক ভয় পাচ্ছিলাম। প্রেগন্যান্ট মহিলাদের কিছু নির্দিষ্ট সময় বাইরে থাকতে হয়না। খারাপ কিছুর আছড় পরে। আমার ভয় লাগছিল, যদি আমার বাচ্চাটার উপর কোন কিছুর আছড় লাগে??
আমার বাচ্চাটা যদি নষ্ট হয়ে যায়!!!!
পরে আমাকে আরেকজনের ঘরে আশ্রয় দেয়া হয়।
আমার বড় ছেলেটা হওয়ার পরেও শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার কমেনি। একদিকে শ্বশুড়বাড়ির অত্যাচার, ঐদিকে বাচ্চাটা কাঁদতো। এতকিছু সহ্য করতে পারতাম না। আবার কাউকে কিছু বলতেও পারতাম না। তখন রাগ সামলাতে না পেরে শুধু এই বাচ্চাটাকে মারতাম। সবার অত্যাচারের ঝাল গিয়ে মিটাতাম আমার ছেলেটার উপর। আমার মা'র খেয়ে খেয়ে আমার ছেলেটার শরীর স্বাস্থ্য মেধার আজ এই দশা। আম্মু আমার ছেলেটা কি আর কোন দিনই ঠিক হবেনা??? মেয়ে মানুষ হলে চিন্তা ছিলনা। বিয়ে দিলে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু ও তো ছেলে। ওর দায়িত্ব কে নিবে?? ওর ভবিষ্যত কি হবে ?? আমি কি করবো ওকে নিয়ে??
- আমি চুপচাপ কথা গুলো শুনছিলাম। একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু করিনি। কারণ এটা কাটা ঘায়ে নূনের ছিটা দেয়ার মতো। ভদ্র মহিলার শুধু আফসোসই বেড়ে যাবে। তাই উনার কথা শেষে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাসই ফেললাম। আর ভাবলাম, আমার ছোটবেলাটা। এমন কোন দিন ছিলোনা, যে, পড়া শুনার জন্য আম্মুর কাছে মা'র খাইনি। ঝাড়ুর বাড়ি, জালি বেতের বাড়ি, প্যান্টের বেল্ট, হ্যাংগার, পেয়ারা গাছের ডাল, ছোট লোহার শিক, ব্যাডমিন্টন,কাঠের স্কেল, স্টিলের স্কেল, রুটি বানানোর বেলুন, আটার কাই করার লাঠি, ডাল ঘুটনি সহ মোটামুটি সব কিছুর মা'রই আমি খেয়েছি, কেবল জুতা ছাড়া। এটা আমার সর্বশেষ সম্মান টুকু বাঁচিয়ে রেখেছিল।
তাই মা ছিল আমার কাছে বাঘিনী। "মা" শব্দটা সবার কাছে যেখানে মধুর শব্দ, আমার জন্য ছিল সেটা দজ্জালের প্রতিরুপ। সেই মা আজ কত অসহায় হয়ে নিজের অতীতের কষ্টের কথা গুলো আমাকে বলেন!!!!
এখন বুঝি, তখন কেনো এত পড়াশোনা নিয়ে আমি মা'র খেতাম। আমি রেজাল্ট খারাপ করলেই নাকি আম্মুর দিকে আংগুল উঠতো, "মা অশিক্ষিত। তাই মেয়েরে পড়াইতে পারেনা। এই জন্যই তো মেয়ে রেজাল্ট খারাপ করে।" সেই সময়ের HSC পাস করা একজন মহিলা অশিক্ষিতের মিথ্যা অপবাদ মেনে নিতে পারতেন না।
আরো আছে। "ছেলে মেয়ে গুলা কেনো মানুষ হয়না জানেন?? এইগুলা আসলে মা'র পাপের ফল! অতীতে হয়ত কোন পাপ করছে, তাই তার ফল ছেলে মেয়েরা ভোগ করতেছে!" এত বড় মিথ্যা অপবাদ হজম করাটা আমার মায়ের মতো মিশুক, হাসি খুশি চঞ্চল স্বভাবের মেয়ের জন্য অনেক কঠিন ছিল।
আমার সম বয়সী কোন মেয়ের মায়ের সাথে তুলনা করে বলা হতো, ঐ মেয়ের মা শিক্ষিত। মেয়ের পড়ার জন্য অনেক শ্রম দেয়। তার এক অংশও আমার মা মার পিছনে দেন না। তাই আমি প্রাইমারি এবং জুনিয়র স্কলারশিপ কোন কিছুই পাইনি।এসএসসিতে গোল্ডেন পাইনি। এটা হজম করাও আম্মুর জন্য অনেক কঠিন ছিল। কারণ সেই ভদ্র মহিলা বাস্তবে এসএসসির গন্ডি টুকুও পেরোতে পারেন নি। আর উনি উনার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ শ্রমটা উনার মেয়ের পেছনে দেন। আমার মা তাঁর অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ শ্রমটা আমার পেছনে দেন।
আমাকে নিয়ে আম্মুর স্বপ্ন ছিল বেশি। আমি বড় সন্তান। তাই আম্মু চাইতো, আমাকে দিয়ে সকল স্বপ্ন পূরণ করতে। আমি যদি ভালো রেজাল্ট করি, তাইলে কেউ আর আম্মুর দিকে আংগুল তুলে কথা বলবেনা।
আগে হয়ত বুঝতাম না, তাই মাকে দজ্জাল মনে হতো। কিন্তু এখন সব বুঝি। তাই খুব আফসোস হয়, আম্মুর উপর হওয়া মানসিক অত্যাচার গুলার কথা ভাবলে । এখন তো আমার কাছে এসব শেয়ার করতে পারে। তখন তো আমি ছোট ছিলাম। এত কিছু বুঝতাম না। কারো কাছে এসব বলতেও পারতেন না। এসব সহ্য করতে করতে যখন সহ্য সীমা ছাড়িয়ে যেতো, তখন তার পুরো প্রভাবটা এসে পড়তো আমার উপর।
আমি ভাবি, এই বাচ্চাটাও একদিন বড়ো হবে। তখন কি সে তার মায়ের এই বিরুপ আচরণের জন্য তার মাকে ঘৃণা করবে?? নাকি মায়ের কষ্টটা বুঝবে? মায়ের স্বপ্নটা পূরণ করবে??? একটা মেয়ে মায়ের অনেক কাছে থাকে। তাই অনেক কথা জানতে পারে, বুঝতে পারে। একটা ছেলে তো মায়ের এত কাছে থাকেনা। সেকি এতো কিছু উপলব্ধি করতে পারে???
.
আমরা আসলে অনেক খারাপ পরিবেশ দেখি , অনেক খারাপ আচরণ অনেকের থেকে পাই। অনেক আপনজনদের থেকেই পাই। কিন্তু কখনো বুঝিনা, এর পিছনের কারণ টা কি?? জানিনা, এর পিছনের কাহিনী গুলো।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৩
২৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২১

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

ট্রাম্প হচ্ছে একজন আপাদমস্তক বিজনেসম্যান। কমলা হ্যা্রিস যেহেতু ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত তাই ইন্ডিয়ান ভোটার টানার জন্য সে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে জাস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্রগ্রামে যৌথবাহিনীর ওপর ইসকনের এসিড হামলা সাত পুলিশ আহত।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৪৩

এসিড নিক্ষেপে আহত পুলিশ সদস্য



চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর ইসকন সমর্থকদের হামলা ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানব সভ্যতা চিরতরে ধ্বংস হবে কি করে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৬



সে এক বড় অদ্ভুত বিষয়।
চিন্তা করে দেখুন এত দিনের চেনা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশাল বিশাল ইমারত ভেঙ্গে যাবে, গুড়িয়ে যাবে। মানুষ গুহা থেকে বেরিয়ে আজকের আধুনিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসকন

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭


INTERNATIONAL SOCIETY FOR KRISHNA CONSCIOUSNESS যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ISKCON এর বাংলা অর্থ হল আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ। যে সংঘের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় করে তোলার মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রকৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×