somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই

২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৩:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মোসাদ্দেক খুব ঘামতে শুরু করেছে। এমনিতে সে চায়ের দোকানদার, সারাদিন আগুনের সামনে থাকে তাতে সে এতটা ঘামে না।অবশ্য বৈশাখের গরমও চরমে পৌছেছে।সে বুঝতে পারছে না আসলে সে কি করছে। অনেক ক্ষণ ধুম ধরে বসে থেকে বুঝলো ,সে কিছু একটা খুঁজছে। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে সে কি যেন খুঁজছে। এবার সে আরও কিছুটা বিচলিত হয়ে খানিক উত্তেজিত হয়ে উঠলো। টেনশানের সময় সামনে কেউ পড়লে তার খুব রাগ হয়। স্ত্রী সামনে আসতেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে মোসাদ্দেক বলল রবিনের মা এহানে একখান বই আছিল সেইডা কই? রবিন তাদের একমাত্র ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে। মোসাদ্দেকের খুব আশা ছেলে কে নিয়ে। তার নিজের খুব ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করার কিন্তু ক্লাশ এইটে উঠার পড়ে আর পড়া হয় নাই সংসারের দূর অবস্থার কারনে। অবশ্য সে ভাল ছাত্রও ছিলনা।

কোন বই? রবিনের বৃত্তি বই? হ রবিনের বৃত্তি বই। আইজ বিয়ানে কাগজ কিনতে আইছিল এক লোক তার কাছে বেইচা দিছি। মোসাদ্দেক চুপচাপ চকির উপর বসে পড়লো। তারপর আর কোন কথা বলে নাই বৌ এর সাথে। রবিনের মা ভাত দিতে চাইলেও কোন কথা না বলে শুয়ে পড়লো।রবিনের মা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো কি হইছে কিন্তু কোন উত্তর দিলনা মোসাদ্দেক।

শুয়ে শুয়ে সে ভাবছে কত স্বপ্ন ছিল তার জীবনে। একদিন স্বচ্ছল সংসার হবে, কোন অভাব থাকবে না। তার আরেকটা ইচ্ছে ছিল খুব, তার একটা মেয়ে থাকবে। রবিন যে বার হয় সেবারই মোসাদ্দেক খোদাতালার কাছে খুব দোয়া করেছিল যাতে মেয়ে হয়। মোসাদ্দেকের দাদী তখন বেঁচে ছিল। দাদী বলছিল পেরথম মাইয়া অওন বালো, আমি আমার বাপের পেরথম মাইয়া। দেহিস তরো পেরথম মাইয়া হবিনি। মাইয়া অইলো সংসারের সুখের বাত্তি, যার পেরথম মাইয়া অয় আল্লাহ তারে রহম দেয়। মোসাদ্দেক দাদীর কথার সাথে মিল পায়। ছোটবেলা থেকে মোসাদ্দেক দেখে আসছে যে তার দাদী অভাবের সংসার কি সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছে। মোসাদ্দেকের দাদার সম্পত্তি বলে ভিটে আর এক বিঘা জমি ছিল। কোনমত সংসার চালাতো দাদা, নিজের আর পরের জমিতে কাজ করে। দাদী একবার কোথা থেকে যেন কিছু টাকা নিয়ে মোসদ্দেকের বাপের আর চাচাকে বললো গোয়ালের গরু দুইডা বেঁচে দিয়ে আর এই টাকা নিয়ে দুইডা মহিষ কিনে আন। আর তোর নানার বাশ ঝাড় থেইকা কয়ডা বাশ নিয়া একটা গাড়ি বানা। তারপর মোসাদ্দেকের বাপ আর চাচা মিলে একখান মহিষের গাড়ি করে ফেলল। সেই গাড়ীতে তারা ফসলের সময় লোকের ফসল আনতো দূর থেকে। সেই খান থেকে গৃহস্ত ধান দিতো তাদের। এভাবে সংসার ভালই চলছিল। সে দিন মোসাদ্দেক ভাবলো দাদী ঠিক কথাই বলেছে মেয়েরা সংসারের সুখের বাত্তি। কিন্তু মোসাদ্দেকের ছেলে জন্ম নিলো। দাদী এই খবর পেয়ে মোসাদ্দেককে বললো মাইয়া অইলে বালো হইতো, তয় পোলাও বালা। তোর দাদা কত্ত বালো ছিল। আমারে ছাড়া একবেলাও ভাত খাইতো না।

মোসাদ্দেক অভাবের কারনে আর বাচ্চা নেয়ার সাহস করে নাই। তবে মনে মনে একটা মেয়ের স্বপ্ন দেখতো। রবিন এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে, এখনই সন্তান না নিলে দেরী হয়ে যাবে। রাত অনেক হয়েছে মোসাদ্দেকের ঘুম আসছে না। এলোমেলো ভাবছে আর গোপনে কাঁদছে। ফজরের আযান পড়ার পরে সে আর বিছানায় থাকতে পারলো না। হাত মুখ ধুয়ে জামা পরে রবিনের মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল সে শহরে যাচ্ছে। রবিনের মা বলল আইজ আবার শহরে যাও ক্যা? কাইল রাইতে খাইলে না, এহন আবার শহরে যাও! মোসাদ্দেক কিছু না বলে চলে গেলো।এমনিতে সে নিয়মিত নামায পড়ে না কিন্তু আজ তার মনে অনেক মেঘ। বাজারের মসজিদে নামায পড়ে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছে শহরে যাওয়ার জন্য। কোন গাড়ী নেই গ্রামের রাস্তায় এত সকালে শহরে যাওয়ার জন্য। একটা নসিমন ভ্যান কয়েকজন লোক নিয়ে শহরের কাছাকাছি যাচ্ছে। মোসাদ্দেক হাত তুলে ইশারা করলো থামার জন্য।

সকাল নয়টা মোসাদ্দেক শহরের পুরাতন বই এর মার্কেটে এসে উপস্থিত। দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। মোসাদ্দেক সবাইকে যথা সম্ভব শুদ্ধ ভাষায় জিজ্ঞেস করছে ভাই আপনারা কি মীরগঞ্জ থেকে বই কিনছেন কাইল? দোকানদার বলছে আমরা তো ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে বই কিনি তারা কই থেকে কিনছে জানিনা। মোসাদ্দেক একে একে সবগুলো দোকান তন্ন তন্ন করে খোঁজে, কোথাও সবুজ মলাটের রবিনের বৃত্তি বই পায়না। রবিনের বৃত্তি বইটার উপরে বাংলাদেশের একটা ম্যাপ ছিল। বইটা যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য তার দোকানের পাসের ঔষধের দোকান থেকে পুরাতন একটা ক্যালেন্ডার চেয়ে নিয়েছিল বইয়ের মলাট বাঁধার জন্য। ক্যালেন্ডারে ছবি ছিল জঙ্গলের, সবুজ আর সবুজে ভরা ঘন জঙ্গল।

তারপর টানা এক সপ্তাহ মোসাদ্দেক শহরে গেছে পুরাতন বইয়ের দোকানগুলোতে বইটি খুঁজতে। না মোসাদ্দেক খুঁজে পায় নাই। এর মধ্যে সে বাড়ীতে এসে বৌকে কিছুই বলে নাই মনোবেদনার কথা। সে অবশ্য এই বই হারিয়ে যাওয়ার কারন খুঁজে পেয়েছে মনে মনে। সংসারের সুখের বাতি রমণী, সেই রমনীকে গোপন করে কিছু করা উচিৎ হয় নাই তার। মোসাদ্দেক ভাবছে তার উচিৎ ছিল বইটি দিয়ে সে কি করছে তা তার স্ত্রীর কাছে প্রথম থেকেই বলা। বৌ এর কাছে গোপন করার কারনেই তার বই এভাবে হারিয়ে গেছে, এমনটাই ভাবছে মোসাদ্দেক। যদিও এটাই সত্যি, না জানানোর কারনেই তার বৌ বইটি বিক্রি করেছে কিন্তু মোসাদ্দেক ভাবছে বৌকে না বলে ভাল কাজ করাও অন্যায়। যতই ভাল কাজ হোক তবুও তার উচিৎ ছিল বৌকে বলা। কিন্তু সে ভেবেছিল একদিন বৌকে বলে চমকে দিবে। সিনেমায় সে এ রকম দেখেছে বহুবার। এক সময় সে সিনেমার পোকা ছিল।

মোসাদ্দেকের স্বপ্ন থমকে গেছে ছোট্ট একটা ভুলে। রবিন বৃত্তি পরিক্ষা দেবার পরই সে ভেবেছিল এবার একটা মেয়ের আশায় সন্তান নেবে সে। এই জন্য প্রতিদিন টাকা জমাতো। সারাদিন চা,সিগেরেট, বিস্কিট এসব বিক্রি করে সে মোটামুটি রোজগার করতো। এ ছাড়া চায়ের দোকানের পাশাপাশি সে মাঝেমাঝে টুটকা ব্যবসা করতো বভিন্ন সিজেনে। রবিনের বৃত্তি পরিক্ষা হওয়ার পর গত দেড় বছর ধরে সে ওই বৃত্তি বইয়ের ভেতর টাকা জমিয়ে আসছিল। বইটি সে যত্ন করে ঘরের বেড়ার সাথে তকতা লাগিয়ে র‍্যাকের মত বানিয়ে তার উপর রেখেছিল উচুতে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে জামার পকেট থেকে টাকা বের করে সে বইয়ের ভেতর রাখতো। দুই একদিন বৌ বই নাড়াচড়া করা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল কি করছে সে। কিন্তু মোসাদ্দেক উত্তর দিয়েছিল ইঁদুর হয়েছে খুব, কুটকুট শব্দ হচ্ছে ভাবলাম ইঁদুর মনে হয় বই কাটছে। বেশ কয়েকদিন ধরে জমিয়ে খুচরা টাকাগুলো সে পাঁচ শত টাকার নোট করে বইয়ের পাতার ভেতরে রাখতো। ঊনপঞ্চাশ হাজার পাঁচশত টাকা জমেছিল, মোসাদ্দেকের ইচ্ছে ছিল যেদিন পঞ্চাশ হাজার টাকা জমবে সেদিন সে দোকান থেকে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে একটা পান মুখে দিয়ে বৌকে সব বলে সন্তান নেবার কথা জানাবে

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ গল্পটি বাড়ীর পাশে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বন করে লেখা। আমাদের বাজারের এক চায়ের দোকানদারের এই ঘটনা শুনলাম এলাকা থেকে আসা বন্ধুর কাছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল শোনার পরে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৩:৫৫
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মি. চুপ্পুর পক্ষ নিয়েছে বিএনপি-জামাত; কারণ কী?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬


বিএনপি গত ১৬ বছর আম্লিগের এগুচ্ছ কেশও ছিড়তে পারেনি অথচ যখন ছাত্ররা গণহত্যাকারীদের হটিয়েছে তখন কেন বিএনপি চু্প্পুর পক্ষ নিচ্ছে? অনেকেই বলছে সাংবিধানিক শুন্যতা সৃষ্টি হবে তার সংগে বিএনপিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এতো কাঁদাও কেনো=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৬




আয়না হতে চেয়েছিলে আমার। মেনে নিয়ে কথা, তোমায় আয়না ভেবে বসি, দেখতে চাই তোমাতে আমি আর আমার সুখ দু:খ আনন্দ বেদনা। রোদ্দুরের আলোয় কিংবা রাতের আঁধারে আলোয় আলোকিত মনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২




জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই উত্তপ্ত এই পৃথিবীকে শীতল করার জন্য বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হতে পারে ৫০ লাখ টন হীরার ধূলিকণা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×