আর মাত্র ৪ দিন!!!! সময় এত্ত দ্রুত কিভাবে যে চলে যাচ্ছে!!!! গত ২ মাস দিন-রাত ২৪ ঘন্টার মাঝে ১৪-১৫ ঘন্টা পড়েও মনের মত প্রিপারেশন হচ্ছে না...ফাইনাল প্রফ (ফাইনাল প্রফেসনাল এক্সামিনেশন) বলে কথা!!! পড়ার লোডের থেকেও মানসিক চাপটাই বেশি। এই মানসিক চাপ সামলাতে পারাটাই হলো আসল পরীক্ষা। পরীক্ষার আগের এই পরীক্ষাতেই অনেকে ফেল করে, মানসিক চাপে ভেঙ্গে পরে, পরীক্ষার ভয়ে হোস্টেল থেকে রাতের অন্ধকারে রুম মেট , ইয়ার মেট বন্ধু-বান্ধবী ও কাছের অতিপ্রিয় বড়ভাই কিংবা জুনিয়রদের থেকে লুকিয়ে পালিয়ে যায় পরীক্ষা না দিয়েই!!!!প্রতি ইয়ারেই ২/১ জনের আচরণ হয়ে যায় অস্বাভাবিক...শুধু এই পরীক্ষার মানসিক চাপে।
সন্ধ্যার পর নামাজ শেষে হোস্টেলের নিচের মামার দোকান থেকে ডিম-বন দিয়ে নাস্তা করে রুমে ফিরে এল রাফি। রুমে আসার সময়ই সে মনে মনে হিসেব করছিলো আর মাত্র ৪ দিন বাকি পরীক্ষার। আর তা ভাবতেই বুকের ভেতর একটা ভয়ার্ত শীতল ভাব আসলো। এটা নতুন নয়। এর আগেও বড় বড় পরীক্ষা ও প্রফের আগে সে এমন বোধ করতো। শুধু সেই নয়, কম-বেশী সবারই একই অনুভূতি হয়। এক এক জনের মুখের দিকে তাকালেই বেশ ভালভাবেই সেটা বুঝা যায়। রাফি রুমে ফিরে এসে দেখলো রুমমেটরা অলরেডি পড়তে বসে গেছে। নিজেকে সামলে নিতে সে খাটে এসে বসলো, আর মনে মনে নিজেকে মনে মনে বলতে লাগলো"YOU CAN DO IT...YOU HAVE TO DO IT";সাথে সাথে সে ভাবতে লাগলো এবার পাশ করলেই গত ৫ বৎসরের সকল কষ্ট আর পরিশ্রমের ফল সে পাবে....পূর্ণ হবে নিজের ও বাবা-মা, ভাই-বোনের স্বপ্ন.....পাশের রেজাল্ট নিয়ে সে বাসায় ফিরবে নবীন চিকিৎসক হিসেবে.....এরপর তার বাসার আনন্দময় পরিবেশটার কথা ভাবতেই রাফির মনটা অনেকটা হালকা হয়ে এলো, মনের মাঝে একটি অজানা শক্তি নাড়া দিয়ে উঠলো....ওকে পারতেই হবে....গত ২ মাস ধরে এভাবেই সে নিজেকে সামলেছে, সকল মানসিক চাপকে সে মোকাবেলা করেছে,নিজেকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেছে।এরপর রাফি পড়তে বসলো....
একটানা পৌনে ১০টা পর্যন্ত পড়ে রাফি নামাজ ও রাতের খাবারের জন্য একটা ব্রেক নেয়। এর পর রুমে এসে আরও ১৫ রেস্ট; এসময়টা সে বিছানায় শুয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে, সারা রাত পড়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়ার জন্য এই সময় বরাদ্ধ। আজও সে একই নিয়েমে শুয়ে আছে কিছুক্ষণ হলো। তার রুমমেটরা ২জন রুমে , পড়তে বসবে বসবে এমন অবস্থা; আর একজন(অপু) এখনো রুমে আসেনি, সে গিয়েছে লেডিস হোস্টেলে, তার মেয়ে বন্ধুর সাথে এই সময় ৩০ মিনিট না কাটালে সারা রাতের পড়াই মাটি...। এর মাঝেই রাফি তার রুমের সামনে অনেক গুলো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো, সাথে কিছুটা উচ্চস্বরের কথা বার্তা। চোখ বুঝেই সে বোঝার চেষ্টা করলো এই পরীক্ষার আগে এখন আবার কাদের আগমন? পরীক্ষার আগে সাধারনত কেউ পরীক্ষার্থীদের রুমে কেউ ডিস্টার্ব করেনা। তবে মাঝে মাঝে পরীক্ষার্থীরা নিজেরাই হঠাৎ করে ৩/৪ জন এক হয়ে মজা করার জন্য ও কিছুটা মানসিক চাপ কমানোর জন্য একজন আর একজনের রুমের কলস (যাতে বুয়ারা খাবার পানি দিয়ে যায়) ভাঙ্গে। একটা ভাঙ্গা শুরু হলেই সেই ইয়ারের সব কলস ১৫-২০ মিনিটেড় মধ্যে ভাঙ্গা সারা হয়ে যায়; এই ১৫-২০ মিনিট বেশ হাউ-কাউ আর মজা হয়। এটাই পরীক্ষার আগের রাতের এন্টারটেইনমেন্ট। আজও কি সে রকম কিছু হচ্ছে নাকি?রাফি বুঝার চেষ্টা করলো আসল অবস্থাটা কী।কিন্তু আজ সে সেরকম আভাস পাচ্ছেনা। কারা যেন রাগত স্বরে চিল্লা-পাল্লা করছে, এর মাঝেই সে তার নাম শুনতে পারলো। কী হচ্ছে এসব? সে উঠে বসলো। দেখলো তার রুম মেট ২ জন রুমে নেই, তাদের গলার আওয়াজ সে শুনতে পেল রুমের সামনের করিডরে, সাথে তাদের আরও একজন ইয়ার মেট বন্ধুর গলাও সে শুনতে পেলো....মারুফ....কলেজের বর্তমান সংসদের ভি.পি সে; ইয়ার মেট হিসেবে তার সাথে ভাল সম্পর্ক রাফির।কিন্তু আজ মারুফের উচ্চস্বর তার কাছে অন্যরকম মনে হলো। কী হলো ভাবতে ভাবতে রাফি রুম থেকে বের হয়ে করিডরে এলো....
১৫-২০ জনের জটলা করিডরে, ইয়ারমেট আছে ২/৪ জন, বাকি সবাই বিভিন্ন ইয়ারের জুনিয়র। প্রায় সবার হাতেই ডাইনিংয়ের রান্না ঘরের চলা কাঠ।এদের মাঝে অনেকের সাথেই রাফির ভাল সম্পর্ক;অনেককেই সে বিভিন্ন সময় পড়াশুনা ও অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য করেছে, একনকি অনেকেই প্রথম ক্যাম্পাসে এসে রাফির রুমে থেকেছে, তার বেডে ঘুমিয়েছে। যাইহোক, রাফি করিডরে আসতেই ওকে মারুফ সহ অন্যান্যরা ওকে ঘিরে ধরলো...ওর রুম মেট ২ জনকে অন্যান্যরা চলে যেতে বলল, কিন্তু তারা না গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে....রাফি বুঝতে পারছিলোনা কী করবে.....। জুনিয়ররা এর মাঝেই রাফির ১৪ পুরুষ নিয়ে গালাগালি শুরু করে দিয়েছে।আর মারুফ হঠাৎ করেই কিছু বুঝে উঠার আগেই রাফির শার্টের কলার চেপে ধরে এক্টা ঘুসি দিয়ে বলে উঠে “ খাঙ্কির পো তুই ছাত্রলীগ করস!!!???তুই জানস না দেশে এখনো আমরা ক্ষমতায়???ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ করা নিষিদ্ধ তুই জানস না???” রাফি বলতে শুরু করে “কেন? আমরা ছাত্রলীগ করি এটা তো নতুন না, কিন্তু আজ কী হলো......?” কিন্তু রাফির কথা শেষ হবার আগেই শুরু হয়ে যায় সবার সম্মিলিত আক্রমন...একের পর এক ঘুসি,চড়,থাপ্পর আর চলার বারি পরতে থাকে রাফির শরীরে...সাথে সাথে ভেসে আসতে কানে থাকে বিভিন্ন বাণী “ মাগির পুতের সাহস কত ছাত্রলীগ করে !!! ওর নেত্রীরে গ্রেনেড মারছি এরপরও এইগুলার তেজ কমে নায়!!! আজকে ওরে শেষ কইরা দিমু, দেখমু ওর কোন আব্বা আজকে ওরে বাঁচায়... অর নেত্রীরে আমরা ......” রাফি বুঝতে পারেনা কোন দিক সামলাবে, একদিক ঠেকাতে গেলে অন্যদিক থেকে একের পর এক আঘাত আসতে থাকে ...আর চোখের সামনে উঠে আসে ক্ষমতার দাপটে মত্ত একের পর এক পরিচিত মুখের বিভৎস রুপ । এভাবেই মারতে মারতে রাফিকে ওরা নিয়ে যায় হোস্টেলের নীচ তলায় পিছনের ব্লকের একটি রুমে......যাওয়ার পথে রাফি দেখে চারদিকের অসংখ্য নিরীহ ছাত্রের কাতর চোখ তাকে দেখছে......।
নীচ তলার এই রুমটা পরিত্যক্ত... কেউই এখানে থাকেনা...আসলে থাকার মত কোন পরিবেশই নেই এই রুমের...আবছা অন্ধকার ও স্যাত স্যাতে রুমে রাফিকে নিয়ে ঢুকে মারুফ, সাথে তাদের ইয়ারমেট আরো ৩ জন ( সুমন, মামুন আর শিবিরের আহাদ)। জুনিয়ররা থেকে যায় রুমের বাহিরে, কিন্তু তাদের উচ্চস্বরের গালাগালি ও হাসাহাসি শুনতে পায় রাফি। মারুফ রুমে ঢুকেই বন্ধ করে দেয় দরজা... এরপর ৪ জন মিলে রুমে আগেই রক্ষিত ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটাতে শুরু করে আবার...রাফির শরীর অবশ হয়ে আসে...কোন বোধই ওর আর নেই...নেই দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা...রাফি পরে যায় ফ্লোরে...কিন্তু থামেনা ওদের আঘাত ও বানী “শুয়োরের বাচ্চার সাহস কত ক্যম্পাসে ছাত্রলীগের মিছিল করে!!! ওর নেত্রীরে গ্রেনেড দিয়া উড়াইয়া দিতে পারি আর এই বাঞ্চোতগুলা মিছিল মারায়...তোর নেত্রীরে আমরা......” এইঅবস্থা কতক্ষন চলে রাফি আর জানে না...সে জ্ঞান হারায়...
জ্ঞান হারানোর আগে একটি কথাই শুধু রাফির মনে পরে, এই কী সেই মারুফ যার মৃত্যুপথযাত্রী মা এর জন্য মাত্র ২ মাস আগেই রাফি নিজের ১ ব্যাগ রক্ত দিয়েছে...
রাফির জ্ঞান ফিরে পরদিন দুপুরে...সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে সে নিজেকে খুজে পেল সেই রুমের মেঝেতে...রুমের কোনার তাকিয়ে সে দেখতে পেল তার রুমমেট অপু নিজের বা হাত কোলে নিয়ে বসে আছে...। রাফি বুঝতে পারলো অপুকেও ওরা গতকাল রাত্রে ক্যাম্পাস থেকে ধরে একই ভাবে পিটিয়ে নিয়ে এসেছে......অপুর বা হাতটা ভেঙ্গে গেছে সেটাও সে বুঝতে পারলো...। প্রচন্ড ব্যাথা আর ক্ষোভে এই প্রথম রাফির চোখ দিয়ে পানি এসে গেলো...একই সাথে সে দেখলো অপুর চোখেও পানি...২জনই লজ্জা আর ক্ষোভে চোখ ফিরিয়ে নিলো একজন আর একজন থেকে...
পরদিন দুপুরে রাফি আর অপুর বাবা ঢাকা থেকে এসে তাদের বাসায় নিয়ে যায়। এজন্য তাদের মারুফকে ১০ হাজার করে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়।কলেজের প্রিন্সিপাল ও লোকাল প্রসাশন থেকে তারা কোন সাহায্যই পাননি, বরং বিভিন্নভাবে তাদের অপদস্ত করা হয়।
ঢাকা এসে রাফি জানতে পারে অপুকে ওরা ধরে নিয়ে আসে তার মেয়ে বন্ধুর পাশ থেকে...এবং ওরা শুধু অপুর হাত ই ভেঙ্গে দেয়নি, মারুফ সিগারেট দিয়ে পুরিয়ে দেয় অপুর চেহারা ও হাতের বিভিন্ন অংশ। অপুর ভাঙ্গা হাতের জন্য অপারেশন করতে হয়, লাগাতে হয় স্ক্র-প্লেট। ২ মাস তাকে হাস্পাতালে থাকতে হয়। রাফিকেও তা থেথলে যাওয়া মাংসপেশীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে থাকতে হয় ১০ দিন...বাসায় বিছানায় থাকে রাফি ১ মাস...।
সেটা ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখের ঘটনা।১লা সেপ্টেম্বর ছিল তাদের ফাইনাল পরীক্ষা। সেবার আর তাদের পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পরেরবার জানুয়ারী সেশনে তারা পরীক্ষা দেয়। তবে সে জন্য তাদের মারুফকে আবারো টাকা দিতে হয়...আর করতে হয় অনেক কিছু , যা বলার মত না...।
আজ ২০০৯ সালের ১৪ই জানুয়ারী। মারুফকে খুজে পাওয়া যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
রাফি, অপুর জুনিয়ররা মারুফকে খুজে পেয়ে খবর দেয় তাদের; আর মারুফকে রিকশায় করে নিয়ে আসে পি.জি হাসপাতালের হোস্টেলে...সেখানে এসে উপস্থিত হয় রাফি ও অপু...। মারুফ তাকায় না ওদের দিকে ...অপু চুপ...রাফিও চুপ...
রাফি পরে শুধু একটি কথাই মারুফকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কিভাবে পারলি এমন করতে!!!???আমি তোর মা’র জন্য রক্ত দিলাম , আর সেই তুই কিনা আমার সাথে...” আর বলতে পারে না কিছু রাফি...
এরপর...আপনারাই বলুন এই মারুফকে কী করা উচিত???
***১.মারুফ এর মাঝে একটি ছিনতাই মামলায় আড়াই বৎসর জেলে ছিল, মাত্র ৬ মাস আগে সে ছাড়া পায়।