বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ স্যারের ৬৪ তম জন্মবার্ষিকী আজ। আমাদের অনেকেরই সবচেয়ে প্রিয় এই ঔপন্যাসিককে আজ সবাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে, কিন্তু তা তিনি দেখতে পাবেন না এর মত দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না। তিনি স্বর্গ থেকে শুভেচ্ছা নেন আর নাই নেন আমাদের সকলের শুভেচ্ছা পৌছে যাবে নন্দিত নরকে কিংবা শঙ্খনীল কারাগারে...
বাংলা সাহিত্য যখন কেবল মাত্র পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের দখলে, যখন প্রকাশকরা মনে করতেন পশ্চিমবঙ্গের লেখক ছাড়া বই লেখার মত কেউ নেই ঠিক তখনই বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে আবির্ভূত হলেন হুমায়ুন স্যার। একেবারে ধুমকেতুর মত আবির্ভাব। বর্ণিল রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যকে। তাঁর আজন্ম সলজ্জ সাধ ছিল আকাশে একশো ফানুস উড়ানোর। তিনি আকাশে ফানুস উড়িয়েছেন কিনা জানি না তবে বাংলা সাহিত্যে উড়িয়েছেন হাজারো রঙ্গিন ফানুস। অসম্ভব সাবলীলতার সাথে লিখে গেছেন একের পর এক উপন্যাস।
মধ্যবিত্তদের নিয়ে উপন্যাস লেখার ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে ফুটে এসেছে মধ্যবিত্তের হাহাকার, বেঁচে থাকার জন্য নিদারুন চেষ্টা, প্রেম- ভালবাসার সংঘাত কিংবা সুখ-দুঃখের গল্প। তাঁর উপন্যাস আমাদের পাগলের মত হাসায়, তাঁর উপন্যাস আমাদের চোখকে করে অশ্রুসিক্ত। কি সাবলীলতার সাথে লিখে যেতেন! মনে হয় যেন নিজের আপনজনের কথাই বলছেন। এজন্যই তিনি আমাদের এত প্রিয়, এত কাছের একটা মানুষ।
আশি বা নব্বইয়ের দশকে এদেশে বিনোদনের তেমন কোন মাধ্যম ছিল না। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবন ছিল চরমতম একঘেয়ে এবং বৈচিত্রহীন। হুমায়ুন স্যার তাঁর বৈচিত্রময় উপন্যাস দ্বারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একঘেয়ে জীবনকে করে দিয়েছিলেন বর্ণময়।
জ্যোৎস্না ভালবাসে না এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু জ্যোৎস্না যে গিলে খাওয়ার জিনিস, চাঁদের আলো যে গায়ে মাখা যায়, চান্নি-পসর রাত্রিতে চাঁদের তীব্র মায়া যে উপেক্ষা করা সম্ভব না তা তো হুমায়ুন স্যারই শিখিয়েছেন।
আমার দেখা মতে তিনি পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা গল্পকার। এই লাইনটা পড়ে অনেকেরই ভ্রু কুচকাচ্ছে তাই না? না, খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নাই। পৃথিবীর কোন লেখকই একটি চরিত্রকে নিয়ে বইয়ের পর বই লিখে যেতে পারেন নি। হুমায়ুন স্যার যেটা করে দেখিয়েছেন। মূহুর্তের মধ্যেই তাঁর গল্প ফাঁদার অপরিসীম ক্ষমতা সত্যিই ঈর্ষণীয়। যদিও তিনি বিভিন্ন বইয়ে লিখেছেন তিনি একজন দূর্বল গদ্যকার!
বই পড়া যে একটা নেশা হতে পারে, যে নেশায় পড়ে মানুষ খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে; সেই নেশা আমাদের শিখিয়ে গেছেন তিনি। পাঠককে আটকে ফেলেছেন তাঁর তীব্র মায়াময় লেখাতে। একবার যেই পাঠক তাঁর উপন্যাস খুলে পড়া শুরু করেন, খুব কম সংখ্যক মানুষই তাঁর এই মায়াময় লেখা শেষ না করে উঠে যেতে পারেন।
অসম্ভব গুণী এই ঔপন্যাসিক যখন ধীরে ধীরে সুনিপুণ চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে উঠছিলেন ঠিক তখনই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। আগুনের পরশমণি, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা ইত্যাদি খুব চিত্তাকর্ষক চলচ্চিত্র এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্রে ঘেটুপুত্র কমলাতে তিনি একজন আদর্শ পরিচালকের প্রমাণ রেখে গেছেন। একজন মানুষের দ্বৈত সত্তার কি অপূর্ব নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন! পুরো ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে ছবির শুরুতে যে হাওর ভরা পানি দেখিয়েছেন, শেষও করেছেন সেই হাওরেরই পানি শুকিয়ে যাওয়া দিয়েই। সত্যিই অবিশ্বাস্য! বোধ করি, সিনেমাটি বানানোর সময়ই তিনি বিধাতার ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। তাইতো ছবিটির শেষে গান ছিল, “সুয়া উড়িল উড়িল জীবের জীবন, সুয়া উড়িলরে...”
অন্য কার জীবনে কি হয়েছে জানি না, আমার গল্পের বই পড়ার হাতে খড়ি হয়েছে তাঁর লেখা বই দিয়ে। কৈশোরের সবচেয়ে আনন্দময় দিনগুলো পার করেছি তাঁর লেখা বই পড়ে। বই পড়া যে নেশা তা আমি বুঝতে পেরেছি তাঁর লেখা বই পড়ে। জীবনে অনেক লেখকের বই পড়েছি। শরত, মানিক থেকে শুরু করে চার্লস ডিকেন্স অনেকের। শ্রীকান্ত পড়ে শ্রীকান্ত হতে ইচ্ছে হয়েছে, পুতুল নাচের ইতিকথা পড়ে শশী হতে ইচ্ছে হয়েছে কিংবা চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্ট পড়ে অলিভার টুইস্ট হতে ইচ্ছে করেছে। কিন্তু আমার কাছে অন্য সব লেখকদের সাথে আপনার পার্থক্য একটাই। সেটা হল আপনার উপন্যাসের চরিত্র পড়ে কেন জানি ওই চরিত্রের মত হতে ইচ্ছে করে না। কেন জানি মনে হয় ওই চরিত্রটা আমি নিজে। কেন জানি মনে হয় শুধু আমার জন্যই ওই চরিত্রটা! আপনার বই আমাকে তীব্র ঘোরের ভেতর নিয়ে যায়। সেই ঘোরের রহস্য কি আজও ভেবে বের করতে পারি নি। ঘোর মুক্তির কত চেষ্টাই না করেছি। কিন্তু কোন চেষ্টায়ই কোন কাজ হয় নি! কতবার যে নিজেকে “মন্টু” ভেবেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। কতবার যে মিসির আলী হয়ে আমি নিজে বইয়ের ভেতরের রহস্য সমাধান করেছি তারও কোন ইয়ত্তা নেই। যখন কোন কারণে প্রবল দুঃখ পাই তখন হিমু হয়ে যাই। কোন দুঃখবোধই আমাকে স্পর্শ করে না। কতবারই ভাবি রূপা নামে প্রবল মায়াবতী কেউ একজন আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে! মাঝেই মাঝেই নিজেকে সাইকেল ডাক্তার মনে হয়! প্রবল ঘোরের মধ্যে নিজেকে বাকের ভাই ভাবি না তাও না! আবার হঠাত হঠাত কেন জানি মনে হয় হিমু, বাদল, আনিস, মন্টু ওরা আমার বন্ধু। খুব খুব কাছের বন্ধু। যাদের সাথে জীবনের সব কষ্টের কথা বলা যায়, যারা আমার সব নিঃসঙ্গতা দূর করেছে আজ তারা কেউ আমার কাছে নেই! তাই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে- “জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবছি।”
আমার খুব ইচ্ছে ছিল একটি বার এই মহান লেখকটির পদধূলি নেব। শুধু একটিবার তাঁর হাতকে ছুঁয়ে দেখব, যে হাত দিয়ে তিনি রচনা করে গিয়েছেন উপন্যাসের পর উপন্যাস। জীবিত অবস্থায় তাঁকে কোনদিন ছুঁয়ে দেখতে পারি নি। যখন তাঁর কফিন ছুয়েছি আপনাতেই চোখ অশ্রুসজল হয়ে গিয়েছিল। আমি তাঁর কফিনের পাশে অনেক মানুষের চোখের অশ্রু দেখেছি, এ অশ্রু মেকি নয়। এ অশ্রু ভালবাসার অশ্রু। এ অশ্রু তাদের প্রিয় লেখকের প্রতি অকৃত্তিম ভালবাসার স্বরূপ।
এখনও জ্যোৎস্না হয়। আকাশ ফেটে যায় চাঁদের আলোতে। কিন্তু সব এরকম উলটপালট কেন! এরকম তো হবার কথা ছিল না। প্রবল জ্যোৎস্নায় রূপা বারান্দার রেলিঙে দাঁড়িয়ে নেই, চাঁদের আলোতে হিমুও তো গন্তব্যহীন যাত্রা দিতে পারছে না! জ্যোৎস্না আছে, কিন্তু জ্যোৎস্নার সেই মায়ার সুর কেটে গেছে। হিমু, রূপা, আনিস, মাজেদা খালা, বাদল, ধানমণ্ডি থানার ওসি, নীলু, বিলু, মৃন্ময়ী, আসমানী, বাকের ভাই, মুনা, গ্রীন ফার্মেসীর চেংড়া ডাক্তার মনসুর, সাইকেল ডাক্তার কোথাও কেউ নেই। স্যার, আপনি মনে হয় জানেন না, আপনাকে ছাড়া ওরা কতটা নিঃসঙ্গ। জানলে কখনই এভাবে চলে যেতে পারতেন না। কখনই না।
হুমায়ুন স্যারের দেহ হয়ত এই নশ্বর পৃথিবীতে নেই কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন কালো জাদুকরের জাদুর মায়াতে, বেঁচে আছেন ঠিক সেখানে যেখানে কোথাও কেউ নেই! তিনি বেঁচে আছেন সব হিমুদের মাঝে, বেঁচে আছেন মেঘের ওপর বাড়িতে। তিনি বেঁচে আছেন লক্ষ কিশোরের এলেবেলে দিনগুলোতে, বেঁচে আছেন উড়ে যাওয়া বকপক্ষীর মায়াতে। তিনি বেঁচে আছেন লিলুয়া বাতাসে কিংবা মাতাল হাওয়াতে, বেঁচে আছেন মধ্যাহ্নে। তিনি বেঁচে আছেন বহুব্রীহিতে, বেঁচে আছেন শূন্যের মাঝে। তিনি বেঁচে আছেন তাঁর সাজঘরে। বেঁচে আছেন এইসব দিনরাত্রিতে। হুমায়ুন স্যার বেঁচে আছেন তাঁর প্রিয় জ্যোৎস্না ও জননীর গল্পে। তিনি বেঁচে আছেন হিমুর সবচেয়ে প্রিয় নদী ময়ুরাক্ষীর তীরে, বেঁচে আছেন নীল অপরাজিতার মাঝে, বেঁচে আছেন উড়ালপঙ্খীর মাঝে, বেঁচে আছেন রূপার মাঝে। তিনি বেঁচে আছেন অসম্ভব মায়াময় লীলাবতীতে, বেঁচে আছেন আকাশ জোড়া মেঘে। তিনি বেঁচে আছেন চমৎকার দারুচিনি দীপে কিংবা রূপালী দীপে, বেঁচে আছেন রোদনভরা এই বসন্তে, বেঁচে আছেন কৃষ্ণপক্ষের মাঝে। তিনি বেঁচে আছেন বৃষ্টি বিলাসের মাঝে কিংবা অন্ধকারের গানে। তিনি বেঁচে আছেন তেতুল বনের অপূর্ব মায়াময় জোৎস্নায়, বেঁচে আছেন মন খারাপ করা মৃন্ময়ীর মাঝে। তিনি বেঁচে আছেন শ্যামল ছায়ায়, বেঁচে আছেন তাঁর সব অনন্য সুন্দর সৃষ্টির মাঝে।
বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে, বাংলা সাহিত্যের একজন পাঠক যতদিন জীবিত থাকবেন ঠিক ততদিন হুমায়ুন স্যার বেঁচে থাকবেন। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন নন্দিত নরকে কিংবা শঙ্খনীল কারাগারে।
শুভ জন্মদিন হুমায়ুন স্যার।
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ তুমি নয়নে নয়নে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন