পেশাগত কাজে যেতে হয়েছিল দেশের শুরুর বিন্দুতে। গত পনেরই মার্চ। বাংলাদেশের শুরু দেশের উত্তর থেকে। জাতীয় সংসদের এক নম্বর আসন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, সদর ও আটোয়ারি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনটিতেই দেখা মিলবে দেশের প্রথম বিন্দুটির।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে দেশের প্রথম বিন্দু বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট। আমরা যখন পৌঁছাই তখন কয়েকজন ওপার থেকে আসছেন। তাদের একজন মোবাইল ফোনে কাকে যেন জানাচ্ছিলেন সে কথাই।
এরমধ্যে আরো কয়েকজনকে এপারে এলেন। দুজন বয়স্ক দম্পতি এলেন। এক নারী ভ্রমণকারী সীমানা পার হয়ে এলেন । মুখে মাস্ক । পাথর বোঝাই বড় বড় ট্রাক দেশে ঢুকছে। তবে কাউকে এপার থেকে সীমান্তের ওপারে যেতে দেখলাম না৷করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ভারতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানা সম্ভব না হলেও সীমান্তের আমাদের অংশে কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি সেদিন, যে যার মত এপারে আসছেন এবং চলে যাচ্ছেন দেশের আনাচে-কানাচে। তবে করোনা জেকে বসতে পারে এদেশে, এমন কোন আভাস তখনো পাওয়া যায়নি সেটাও ঠিক। এরপর আমরা চলে এলাম তেঁতুলিয়ায়। মহানন্দা নদীর পাড় ঘেঁষে তেঁতুলিয়া শহর। মহানন্দা নদীটি বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝ বরাবর সীমান্ত রেখা টেনেছে।
নদীতে নুড়ি পাথর তুলতে দেখা গেল স্থানীয়দের। উৎসাহী পর্যটক নদীতে সাঁতরে নিলেন, স্নান সেরে নিলেন। নদীতে তখন স্রোত বেশি নেই; তবে জল স্বচ্ছ অনেকটাই। নদীটির পাড়েই জেলা পরিষদের ডাক বাংলো। প্রথাগত প্রাচীন ডাকবাংলো। এই ডাক বাংলো চত্বরেই তেঁতুলিয়ার পিকনিক স্পট। এই চত্বরেই 'বেরং কমপ্লেক্স'। বেরং কমপ্লেক্সেই দেখা মিললো ইতিহাসের দুই মহানায়কের; ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ খ্যাত মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আর পৃথিবীর মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী কন্ঠ মহান বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার
কমপ্লেক্সে দেখা পেলাম জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত চিত্রকর্মের রেপ্লিকারও।
প্রান্তিক এই শহর নামের ছোট্ট লোকালয়টিতে লুথার কিংয়ের উপস্থিতি চমকে দিলেও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। তবে অবাক করেছে আর্নেস্তো চে গুয়েভারার উপস্থিতি। এই কমপ্লেক্সেরই তথ্যফলক থেকে জানলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত) শীর্ষক কর্মসূচির অর্থায়নে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য গৃহীত আয় বর্ধক প্রকল্প এই ‘বেরং কমপ্লেক্স’। চে অথবা মার্টিন লুথার কিং অথবা জয়নুল; সব মিলিয়ে রুচির দারুণ গভীর ছাপ এই কমপ্লেক্সে। মনে হলো যে আমাদের সবকিছু এখনও নষ্টদের দখলে যায়নি।
তেঁতুলিয়ায় দুপুরে ডাল-ভাত খেয়ে রওনা হলাম পঞ্চগড়ের পথে। তেঁতুলিয়া থেকে বের হতেই ভারতের চা বাগান। চা বাগানে পানির ফোয়ারা থেকে উছলে উঠে ঝরে পড়ছে জল। দেখলাম বাগানের ভারতের অংশে সেখানকার কর্মীরা চায়ের পাতা তুলছেন। ভারতের অংশের গাছগুলো বিশেষ স্টিকার দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। বাগানটা একেবারেই আমাদের রাস্তা লাগোয়া।
সমরেশ মজুমদারের কালবেলা-কালপুরুষ পড়ে যারা বড় হয়েছেন তাদের কাছে চা বাগান, হাড়িভাসা, ডাহুক নদী বিশেষ কিছু হয়ে আছে। দারুণ রোমান্টিসিজম। বাংলাবান্ধা আর তেতুঁলিয়ায় এলে সেই স্বাদ বঞ্চিত হবেন না কেউ।
পঞ্চগড় ফেরার পথে রয়েছে সেই ডাহুক নদী। মনে মনে আনন্দ জাগবে কালবেলা ও কালপুরুষ উপন্যাসের তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র মাছ বাবু অনিমেষ আর মাধবীলতার স্মৃতি বিজড়িত ডাহুকের সংস্পর্শে আসতে পেরে। তবে স্রোতহীন আর অস্বচ্ছ জলের ডাহুক দেখে যে কারো মনে কষ্ট জাগাবে।
তেঁতুলিয়া জুড়ে চা বাগান আর এখানে ওখানে ছড়ানো পাথর। তবে এখানেই না থেমে আরেকটু এগুলেই পড়বে পচাঁগড়; মানে পঞ্চগড়। পঞ্চগড়েই পাবেন হাড়িভাসা যাবার পথ।
ইতিহাসের দু্ই মহানায়কের দেখা পেতে আর নস্টালজিক হতে চাইলে যে কারো অবশ্যই ঘুরে আসতে হবে ডাহুক, তেঁতুলিয়া আর বাংলাবান্ধা।
কিন্তু এটুকুতেই মন ভরবে না আর৷ ভরার কথাও না। এই একটানা করোনাবাসের কারনে মন তো খুবই বিক্ষুব্ধ। বেড়িয়ে পড়তে চাইছে। উপায় নেই তাই আটকে থাকতে হচ্ছে৷ করোনাবাস শেষ হলে। যদি বেঁচে থাকি তাহলে কী হবে?
মাছবাবু অনিমেষ আর মাধবীলতা বোলপুরে নেমে শান্তিনিকেতনের কোথাও উদ্দাম হয়েছিল প্রথমবারের মত। অর্ক এসেছিলে মাধবীলতার কোল জুড়ে। সেই বোলপুর, শান্তি আর শ্রীনিকেতনে যেতেই হবে। মাছবাবু বড় হয়েছে জলপাইগুড়িতে, সেখানেও যেতে হবে। যেতে হবে চা বাগানে। হাড়িভাসা ডাহুক কত কত জায়গা। কালিংপং, দার্জিলিং, গ্যাংটক, সিকিমও। কলকাতার সেই কফিহাউজ। ট্রাম। বস্তির গলি ঘুপচিতে বাকি জীবনটা কাটাতে হয়েছিল। সেসবও বাদ দেয়া যাবে না। পকেটে টাকা কোন কালেই ছিল না৷ হবেও না নিশ্চিত। কিন্তু করোনায় বেঁচে গেলে ইচ্ছাগুলো পূরণ করতেই হবে এবার। শুরু হোক অনিমেষদের দিয়েই। টাকা নেই তো কী হয়েছে। ইচ্ছে তো আছে..
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০২০ রাত ২:০২