যাবো যাবো করেও বহুদিন ধরে কোনো কনসার্টে যাওয়া হচ্ছিল না। অবশেষে এল সেই সুযোগ! দেশের স্বনামধন্য ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট সেবাপ্রদানকারী এক প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে চার দশকের ১২টি ব্যান্ড নিয়ে কনসার্ট। প্রতিষ্ঠানটির ইন্টারনেট সেবার মান ততোটা মনঃপুত না হলেও এধরনের হাই কনসার্ট লাইনআপের প্রতি লোভ সামলাবার মত মহাপুরুষ হবার চেষ্টাতেই গেলাম না। দোস্ত রনির আইডি নিলাম, তৎক্ষণাৎ রেজিস্ট্রেশন, পাস কালেকশন অতপর ২রা জুলাই মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়াম গমন। কনসার্টের বহু ভেন্যু দেখলেও এখানকার কোনো শো তে ইতিপুর্বে আসা হয়নি। বাড়তি একটা নতুনত্ব তো ছিলই। যাইহোক, বাঁধভাঙা ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে দেড় ঘণ্টা লেট করে দেশের অন্যতম পুরনো ও প্রয়াত আযম খানের ব্যান্ড "উচ্চারন" এর পারফর্মেন্স দিয়ে শুরু হল শো। এরপর এলো সোলস। যদিও আমার জন্মেরও বহু আগের ব্যান্ড কিন্তু "মন শুধু মন ছুঁয়েছে", "নিঃসঙ্গতা" কিংবা "এ এমন পরিচয়" গানগুলোর প্রজন্মান্তরের পথে বাঁধা হয় সে সাধ্যি কার? লিড ভোকাল পার্থ না আসলেও গিটার হাতে পুরনো সদস্য আইয়ুব বাচ্চু সে অভাব বিন্দুমাত্র বুঝতে দেননি। এরপর ফিডব্যাক ও মাইলস। হামিন, শাফিন, তূর্যদের মত পঞ্চাশোর্ধদের স্টেজ পারফর্মেন্স দেখে বুঝলাম যে শুধু বয়স বাড়লেই বুড়ো হয়না যদি মনটাকে তারুণ্যের মাঝে আটকে রাখা যায়। পুরো ইনডোর স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে দিয়ে মাইলসের প্রস্থানের সাথে সাথেই ওয়ারফেজের আগমন। লিড গিটারিস্ট কমল দেশের বাইরে। তাতে কি? মিজান, শামস, অনি, টিপু এঁরা আছেন না? "বসে আছি" দিয়ে শুরু, "মহারাজ" দিয়ে শেষ। এর মাঝে কখন যে সবার উত্তেজনার পারদ শেষ বিন্দুও ছাড়িয়ে গেছে সে খবর কে রাখে! রেনেসাঁর গানগুলো আগে কখনো মন দিয়ে শুনিনি। এবার শুনে বুঝলাম কেন ২৫ বছর পরও এই ব্যান্ডের নাম মানুষের হ্রদয়ে ভাসে। এবার কে? "মন চাইলে মন পাবে, দেহ চাইলে দেহ .............." পঞ্চান্ন বছরের এক তরুন আইয়ুব বাচ্চু! এল.আর.বি.!! গিটার হাতে একজন শিল্পী যে কি করতে পারেন তা অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আমরা কয়েক হাজার দর্শক! "সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে?" শুধু গাইলেনই না, স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষকে নষ্টালজিয়ায় ভাসালেনও। যারা একটু সফট গান ভালবাসেন বিশেষ করে মেয়েদের সবচেয়ে ফেভারিট ব্যান্ড দলছুট! সুরের মুর্ছনার তালে তালে বাপ্পার সাথে গাইলাম "তুমি আমার বায়ান্ন তাস, শেষ দানেও আছি/তোমার নামে ধরছি আমার সর্বস্ব বাজি"। ক্রিপটিক ফেইটের যে এতদিন পরেও এতটা ফ্যান সাপোর্ট দেখবো ভাবতেই পারিনি। বাংলাদেশে প্রথমাবস্থায় মেটাল গান কাভার করা অন্যতম এই ব্যান্ডটি হেডব্যাঙের মুড জাগিয়ে দিল সবার। ব্ল্যাকের গিটারিস্ট জাহান হসপিটালে থাকায় তাঁদের পারফর্ম করার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু কোনো গিটারিস্ট ছাড়াই ব্ল্যাক যখন স্টেজে চলে আসলো বুঝলাম এতক্ষণ ধরে যে "ম্যাজিক অব মিউজিক" চলছিল তাতে শুধু আমাদের রক্তই নাচেনি, নেচেছে বাংলা অল্টার রক মিউজিকের পথিকৃৎ এই ব্যান্ডের সদস্যদেরও। একপ্রকার খালি গলায় গেয়ে চললেন জন। ভুল বললাম, গাইলাম আমরা কয়েক হাজার রকপ্রেমী। কোথায় যেন শুনেছিলাম যে ঢাকায় যত কাক আছে, আর্টসেল ফ্যানসংখ্যা তার চেয়েও বেশী। এতদিন পর অন্তত এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার লোক পাওয়া যাবে না। শিডিউল অনুযায়ী ব্ল্যাকের পরই আর্টসেল। হেডব্যাঙ করার প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে সবাই। হায় হায়!! উপস্থাপিকা লরা(
) এসে বলে, "সারপ্রাইজ! এখন গাইবেন মাকসুদ!"। কি যন্ত্রণা!!
এর তো আসার কথাই না। কয়েক হাজার মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করে গাইতে থাকলেন মাকসুদ। একটা গান শেষ। বিরক্তি দ্বিগুন কারন মহাশয় তাঁর দ্বিতীয় গান ধরেছেন। সে কি গান!! না আছে কোনো লিরিক, না আছে কম্পোজিশন, না আছে ঐ গানের কোনো কোয়ালিটি!! এই গানও শেষ। যাক বাবা, ভাবলাম এখনই দূর হবে এই বিরক্তি উৎপাদকটা। এ কি!! আবারও লরা। এবার বলে, "এখন হবে মাকসুদের দ্বিতীয় পর্ব"। মজা নিল নাকি? উপস্থিত সবার বিরক্তি চরমসীমা অতিক্রম করে যাওয়ায় "ভুয়া!ভুয়া!" চিৎকারে কেঁপে উঠলো ইনডোর স্টেডিয়াম। এক চিলতে হেসে মাকসুদ বললেন, "আপনারা ভুয়া বলে আমার গান বন্ধ করতে পারবেন না"। এত বড় বেহায়া!
যাইহোক যন্ত্রণাসৃষ্টির রেকর্ড গড়ে বাবাজী বিদায় নিলেন।
ততোক্ষণে "আর্টসেল! আর্টসেল!!" চিৎকারে কাঁপছে স্টেডিয়াম! এলো আর্টসেল। "অন্যসময়", "দুঃখ বিলাস", "চিলে কোঠার সেপাই"! সীমাহীন হেডব্যাঙ। উল্লাসে মাতাল সঙ্গীতপ্রেমীর দল। শেষ ব্যান্ড সর্বাপেক্ষা জুনিয়র - নেমেসিস। অনুজদের উৎসাহে জাগিয়ে তুলতে স্টেজে আসলেন আইয়ুব বাচ্চু স্বয়ং! নার্ভাস নেমেসিস ভোকাল, মাতোয়ারা দর্শক। গান শেষে উঠে এলেন সকল ব্যান্ড সদস্যগণ। সংক্ষিপ্ত কিছু অনুভূতিও শেয়ার করলেন সবার সাথে। দুঃখও প্রকাশ করলেন যে আমরা দশ-বিশ হাজার খরচ করে শীলার জওয়ানি দেখতে যাই কিন্তু একশো-দু'শো খরচ করে নিজ দেশের ব্যান্ডদের সমর্থন দিতে যাই না।
শীলার অনুকরণে নেচেও দেখালেন একটু!
সর্বশেষে সব ব্যান্ডের অংশগ্রহনে আযম খানের সেই অমর গান "বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!!"
বাসায় পৌঁছলাম ১২.৩০ এ। আসার পথে বন্ধু নাবিল শুধু বলল, "একটা কনসার্ট জোস্ হইতে এর বেশী কিছু লাগে না।" অমত করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ঘুরেফিরে বারবার মাথায় ঘুরছিল বাচ্চুর সেই শীলা বিষয়ক কথাটা। সত্যিই তো! বড্ড অবিবেচক আমরা। সেই স্বাধীনতার পর আযম খান যখন ব্যান্ড গঠন করলেন, ক'জন সমর্থক-পৃষ্ঠপোষক ছিল তাঁর? ব্যান্ড বস্তুটা সম্পর্কে ধারনাই বা ক'জনের ছিল? অথচ সেখান থেকে ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফুয়াদ নাসের বাবু, মাকসুদ, লুলু, আইয়ুব বাচ্চু, নাসিম আলি খান, শাফিন আহমেদ, হামিন আহমেদ, ফারিদ রশীদ, সেলিম হায়দার, কমল, টিপু, জেমস, রাসেল, বিপ্লব, জুয়েল, সাকিব, হাসান, পঞ্চম প্রমুখের হাতে হাতে গড়ে ওঠে এদেশের ব্যান্ড সাম্রাজ্য। তারপর এলো সেই সর্বনাশা অ্যালবাম "স্টারস" যার মাধ্যমে প্রতিভাবান শিল্পীরা ব্যান্ড ছেড়ে সলো অ্যালবাম আর খ্যাতির পিছনে ছুটতে থাকে। প্রায় বিলুপ্তির মুখ থেকে ব্যান্ড সাম্রাজ্যকে টেনে তোলে আর্টসেল, ব্ল্যাক ও অর্থহীনের মত ব্যান্ডগুলো। বেসবাবা সুমনের তত্ত্বাবধানে আণ্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডগুলো পায় নতুন মাত্রা। এত ঝড়, সংগ্রামের পর আজ ব্যান্ডজগতের এই যে সুসংহত অবস্থান তা ধরে রাখার জন্য আমাদের দায়িত্ব কিন্তু নেহাত কম নয়। আমরা যতই শীলার যৌবনের পিছনে দৌড়াই না কেন দেশীয় শিল্পীদের ওপর থেকে সমর্থন যেন সরে না যায়। এখন তো আবার পাইরেসির যুগ। আমরা অন্তত দেশীয় অ্যালবামগুলোর পাইরেটেড কপি ডাউনলোড না করে কিনে শুনতে পারি। আমরা অ্যালবাম কিনলে কি হবে জানেন তো? আমাদের দেশের শিল্পীরা টাকা পাবে। দেশে একদল স্বাধীনচেতা পেশাদার সংগীতশিল্পী সৃষ্টি হবে। মুক্ত চিন্তাধারার বিকাশ ঘটবে, যেটার অভাবে আজ আমরা স্বাধীন হয়েও পরাধীন।
বিঃদ্রঃ কনসার্টের ছবি দেখতে
ক্লিক করুন ।
মাকসুদ আসলেই একজন গুনী শিল্পী। তৎকালীন পরিস্থিতির কারনে কিঞ্চিৎ পচাতে হল। ব্যাপারটা তিনি এবং তাঁর ভক্তগন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
এই পোস্ট টি দিয়েছিলাম প্রায় ৭ মাস আগে। যখন সামুতে আমার পোস্ট প্রথম পাতায় আসতো না। ব্লগার
রাইসুল জুহালা ভাইয়ের পরামর্শে পোস্টটি রিপোস্ট করলাম। ওনার অনেক লেখাই সামুতে আসার অনুপ্রেরনা ছিল আমার। এই পোস্টটি উৎসর্গ করলাম ওনাকেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১০:১৯