দ্বিপেশ্বর বাজারে যেদিন হোল্ডিং নাম্বার পড়া শুরু হলো সুনীল বাবুকে বিড়বিড় করে কি যেন ব লতে শুনে ছোট ভাই নারায়ন জিজ্ঞেস করলো ও দাদা কি বলো?
ভগবানের বোধহয় আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার
স ম য় হ য়ে এসেছে রে নারায়ণ। আর দশটা ক্ষেপাটে কথার মতো দাদার এই কথাটাও হেসে উড়িয়ে দেয় নারায়ন।
বাজারের চাকচিক্যর সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিটি দোকানে টিনের ঝাপি ছেড়ে সাটার লাগানো শুরু হ লো, সুনীল বাবুর ভাড়া নেয়া দোকান টাতেও যেদিন সাটার লেগে গেলো সেদিন মালিক মদন বাবু ইনিয়ে বিনিয়ে সুনীল বাবুকে বুঝিয়ে দিলেন দোকানের চুক্তি উনি আর বাড়াতে চাচ্ছেন না, সানের আশ্বিনমাস এ চুক্তি শেষ, সুনীল বাবু যেন অন্য ঘর দেখেন।
নিজের দোকান ঘরের দিকে তাকান সুনীল কাকু, দীর্ঘ ১৮ বছরের সময় কাল বাধা এই ঘরের সাথে, ভিতর থেকে কি তার এক্টা দীর্ঘ শ্বাস বের হয়ে আসে? মাঝারী আকারের এই ঘরটাতে বিপত্নীক সুনীল বাবু কত রাত থেকে গেছেন। দোকানের সামনের দিকে সাজিয়ে রাখা ঝাপিতে নিমকি, বাতাসা, আর গুড়ের চিনির জন্য লাইন দেয়া পিপড়ের দলটাকেও আজ তার বড্ড আপন মনে হয়, আর সিলিং বেয়ে নেমে আসা টিক টিকি গুলো জন্য তার বুক্টা খালি হয়ে যায়। সুনীল কাকু বুঝতে পারেন ভগবান উনাকে আবার পরীক্ষায় ফেলেছেন!
গদীর উপর হাত দিয়ে ঝেড়ে কল্পিত ময়লা যেন ফেলে দিতে থাকেন সুনীল বাবু।আর বারবার সামনের রাস্তার দিকে তাকাতে থাকেন, বেলা হয়ে এলো নারায়ন এখনো এলো না? বড্ড অস্থির হয়ে উঠেন ভিতরে ভিতরে।
সেই সাথে হেচকি তুলেন। সুনীল বাবুর পুড়ানো রোগ, টেনশন এ হেচকি উঠে, কত হোমিওপ্যাথি দেখিয়েছেন, কোন লাভ হয়নি। সবারিই অই একিই কথা, এ তোর মনের রোগ রে সুনীল, মন থেকে না চাইলে ভালো হবার নয়।
গুড়ের ঝুড়িতে হাত বাড়িয়ে এক্টু গুড় ভেংগে নিতে গিয়ে কল্যানীর কথা মনে পড়ে যায়। তার হেচকি উঠলে গুড় আর পানি নিয়ে হাজির হতো, আর আচলে মুখ টিপে হাসতো। আহা! কল্যানীর কথা বহুদিন পড়ে আবার মনে পড়ে গেলো, বড্ড পাগলি ছিলো তার বউ টা, শুধু হাসতো, কথায় কথায় খালি হাসি, কত রাগ করেছে সুনীল, তোর সাথে কথাই কমু না, কোন ভাবের কথাই তুই বুঝোস না, খালি হাসোস!!
কিরে তুই? এতো হাসি তোর কই থ্যাইকা আসে,????
ছোড বেলায় আমি নাকি খালি গুড়ের ঢেলা খাইতাম, তাই খালি হাসি.....হিহিহিহি......
কইসে তোরে গুড়ের ঢেলা খাইলে মাইনসে হাসে, এবার সুনীলের মুখেও হাসির রেখা ফুটে। সেই বউ টা তার সাতদিনের জ্বরে মরে গেলো, আহারে মরার পড়েও তার মুখে হাসি ছিলো। চিতায় তোলার সময় সুনীল লুকিয়ে পাটালিগুড়ের এক্টা ঢেলা চিতার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো; বড্ড ভালোবাসতো যে তার বউ টা গুড় খেতে!
বাজার যখন বেড়ে যেতে লাগলো তখন নারায়নের মুদি দোকানটা বড্ড বেমানান হয়ে দাড়ালো বাজারের আধুনিক হয়ে উঠার জন্য।
তাই বাধ্য হয়েই নারায়ন আর তাই বড় ভাই সুনীল বাজারের এক অন্ধ গলীর ভিতর ছোট্ট এক্টা দোকান ভাড়া নিয়ে চলে গেলো। তিন ভাইয়ের সংসারে এখন বৃদ্ধ মা বাবা নিয়ে তারা চারজন। সবার ছোট ভাইয়ের মৃত্যুকে তারা আজ অব্ধি সহজ করে নিতে পারছেনা, কারন এই ভাইটাকেই তারা পড়াশোনা শিখিয়ে ভার্সিটিতে পাঠিয়েছিলো। কাল জ্বরে তাদের সেই স্বপ্ন নিভে গেছে এক ফুৎকারে।
অনেকটা হেটেছি আজকে, আমার জন্য অনেক্টাই।পা টা টন টনই করছে। বাজারে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কোন চা এর দোকান যদি খোলা পাই।
শহুরে অভ্যাস দ্বীপেশ্বর রপ্ত করেছে পুরোটাই। রাতের এক প্রহর পর্যন্ত জেগে থেকে বেলা অব্ধি বাজার নিস্তব্ধ। আর এই রাত জাগার রসদ জোগায় চা এর দোকান গুলোই।
বাবু কবে আসছো তুমি?আসো বাবু ভিতরে আসো। ঘুরে দেখি সুনীল কাকু। হাতে কাসার গ্লাস, সোনা রুপার পানি নিশ্চয়, হুম দোকানে ছিটিয়েছেন। শুদ্ধ ব্রাক্ষন তারা। সব গিয়েছে কিন্তু ওই যে অহং আর আত্ন মর্যাদা এ নিয়েই বোধ হয় টিকে আছেন এখনো।
কাল রাতে এসেছি কাকা, আপ্নি কেমন আছেন?
আমাদের আর থাকা বাবা, ভগবানের নাম জপে টিকে আছি বাবা। আসো বাবু ভিতরে আসো।
মজার ব্যাপার হচ্ছে একমাএ সুনীল কাকুই আমাকে বাবু ডাকে, কেনো ডাকেন জানিনা, তবে ভালো লাগে উনার মুখে বাবু ডাক শুনতে।
পুড়ানো কাঠের একমাএ চেয়ার টার দিকে কাকু এগিয়ে গিয়ে কাধ থেকে গামছা নামায় পানির ছিটে গুলো মুছে দেয়ার জন্য ; কাকু কি করছেন আপ্নি, আমাকে দিন না, মুছে নিচ্ছি।
না বাবু মাঝে মাঝে ছেলের জন্য কাজ করাতেও বাবার সুখ আসে।