চলতি দশকে ইসলামিক স্টেট নামীয় জঙ্গিবাদ সিরিয়া-ইরাকে ঘাঁটি গেড়ে সারা পৃথিবীর তরুণ ও যুবকদের তীব্রভাবে আকর্ষিত করে ইসলামের নামে জিহাদের পথে নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়। ইরাকের সুন্নি শাসক সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর আল কায়েদার পেট থেকে জন্ম নিয়ে হঠাত্ করে নাড়ির সংযোগ কেটে মধ্যযুগীয় শুদ্ধ ইসলামকে উপজীব্য করে হিংসার নতুন দর্শনে আবিষ্ট করে মানুষকে পরকালের বেহেশত প্রাপ্তির শর্টকাট পথ দেখাতে শুরু করে।
ইঙ্গ-মার্কিনি শক্তি ইরাকে সুন্নি শাসক বদল করে শিয়া শাসন প্রবর্তন করলে সুন্নিরা নিজেদের উপেক্ষিত ও বঞ্চিত ভাবতে শুরু করে। ইরাকের এলিট বাহিনী রিপাবলিকান গার্ডের চাকরি হারানো সুপ্রশিক্ষিত অফিসার, জওয়ান এবং মরুবাসি সুন্নিদের বঞ্চনাকে ভর করে আবু বকর আল বাগদাদির নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে ইসলামিক স্টেট। ওসামা বিন লাদেনের জঙ্গি সংগঠন আলকায়েদার আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড লিভ্যান্ট নাম নিয়ে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ইরাকের সুন্নি-অধ্যুষিত মরু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। আরব বসন্তকে উসকে দিয়ে পশ্চিমা স্বার্থবিরোধী শাসকদের বদলানোর কৌশলের বলি হয় সিরিয়া। সুন্নি সংখ্যাধিক্যের দেশ সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকার উল্টে ফেলার কৌশল হিসেবে সশস্ত্র প্রতিরোধ তৈরি করতে আসাদবিরোধীদের হাতে ২০১১ সালে অস্ত্র তুলে দেওয়া শুরু করে। মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নের সঙ্গী হয় পশ্চিম ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি বাদশাগণ। মরুপ্রান্তরের নিয়ন্ত্রণ খোয়া যায় সহজেই এবং বেড়ে ওঠে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নামে আসাদবিরোধী সশস্ত্র বাহিনী। তাদের ভেতরে জায়গা করে নেয় আল নুসরা নামের আলকায়েদার জঙ্গি দল। চরম অরাজকতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আবু বকর আল বোগদাদি সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ-শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে দূরপ্রান্তের শহর ও তেল ক্ষেত্রগুলোর একের পর এক দখল নিতে থাকে।
অপরদিকে, ২০১৪ সালের মধ্যভাগে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল আক্রমণ করে দখল নিয়ে বিশ্বকে চমকে দেয় আল বোগদাদি। ২০১১ সালে মার্কিন সেনারা ইরাক ছেড়ে চলে গেলে যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ইরাকের নতুন সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেয়। তারা জঙ্গিদলকে দমন করতে তেমন সক্ষমতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়নি। প্রাদেশিক রাজধানী মসুলকে বিশাল জয়ের প্রতীক হিসেবে রাজধানী করে ইসলামিক স্টেট নামের খিলাফত ঘোষণা করে। আবু বকর আল বোগদাদি নিজেকে নবী করিমের বংশধর দাবি করে খলিফা বনে যান। ইসলামিক স্টেটের অপর রাজধানী ছিল সিরিয়ার রাকা শহর।
বোগদাদি বাহিনী একদিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হতে থাকে, অপরদিকে দখলকৃত তেলক্ষেত্র থেকে চোরাই পথে তেল বিক্রি করে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও সুসজ্জিত জঙ্গি বাহিনীতে পরিণত হয়। ইসলামি খিলাফতের বিজয় কেতনের অনুপ্রেরণা নিয়ে প্রাচ্য ও পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ ও যুবকেরা বিভোর হয়ে দলে দলে জিহাদি যোদ্ধা হিসেবে সিরিয়ায় জড়ো হতে শুরু করে। ইসলামিক স্টেট জঙ্গি দল ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে বাগদাদের উপকণ্ঠে চলে আসে। অন্যদিকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দখলের কাছাকাছি উপনীত হলে ইসলামিক স্টেটের জয় অবধারিত বলে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের নামে হিংসার দর্শন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সোমালিয়ায় আল শাবাব ও নাইজেরিয়া অঞ্চলে বোকো হারামের মতো পৈশাচিক ও বীভত্স জঙ্গি দলের মারাত্মক উত্পাত শুরু হয়।
বাংলাদেশে নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের তত্পরতা গতি লাভ করে। মেধাবী ও বিত্তবান পরিবারের সন্তানেরা জঙ্গিত্ব বরণ করতে শুরু করলে দেশে নতুন ঝুঁকি উত্থিত হয়। জঙ্গি সংগঠনের বাইরেও স্বেচ্ছা আবিষ্ট স্বপ্রণোদিত জঙ্গিরা জিহাদে অঙ্গীভূত হবার লক্ষ্যে অনেক অপ্রত্যাশিত হামলা চালাতে শুরু করলে মুসলিম সম্প্রদায় বিশ্বভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতি ভেঙে পড়তে থাকে। ইসলামোফোবিয়ার জন্ম হয়। ঘৃণার সংস্কৃতি থেকে ঘৃণা সংবলিত অপরাধ পশ্চিমা ও অমুসলিম দেশে বাড়তে থাকে। জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। অনেক মুসলিম নাগরিকও হামলার মুখে পড়ে জীবন হারায় অথবা নির্যাতনের মুখোমুখি হয়।
ইসলামিক স্টেটের জন্ম ও শক্তি অর্জনের পেছনে পশ্চিমা ভূ-রাজনীতির দায় পর্যবেক্ষণের বাইরে রাখা যাবে না। ইরাক থেকে ২০১১ সালে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার অপরিণামদর্শী ছিল বলে অনেকে মনে করেন। সৃষ্ট শূন্যতা ইরাকে বোগদাদিকে বেড়ে ওঠার সুযোগ করেছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে উত্খাতের লক্ষ্যে আসাদবিরোধী বাহিনীকে পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে অবদমিত করে সমাধান খোঁজার কৌশল ইসলামিক স্টেটকে বেড়ে ওঠার অবকাশ তৈরি করেছে— একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ইসলামিক স্টেটের রসদ ও সরবরাহ পথ তুরস্ক, সৌদি আরব, লিবিয়া এমনকি ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। বর্বরতা ও নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। ১ কোটি ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, ২ লাখ ২৯ হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। মানুষ যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বাঁচতে ইউরোপে পাড়ি দিতে মরিয়া হয়েছে। অনেকের সলিল সমাধি হয়েছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ ভয়াবহ জঙ্গি হামলা লক্ষ্যবস্তু হয়েছে এবং অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। হিংসা আঁকড়ে ধরেছে বিশ্বকে।
সিরিয়ায় শান্তি আনতে একদিকে শক্তি প্রয়োগের পথ ধরেছে পশ্চিমা শক্তি, অপরদিকে জেনেভার শান্তি আলোচনা বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। আসাদ বিতাড়নই মূল লক্ষ্য হওয়ায় ঘুরেফিরে শান্তির চেয়ে শাসক বদল গুরুত্ব পেয়েছে। রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ পশ্চিমা পরিকল্পনাকে উল্টে পাল্টে দিলেও আসাদ বাহিনীকে শক্তিশালী করেছে। ইসলামিক স্টেট দ্রুত জায়গা হারিয়ে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পরাজয়ের প্রহর গুনছে। তুরস্ক সীমান্ত-সংলগ্ন উত্তর সিরিয়াতে কুর্দি এসডিএফ ইসলামিক স্টেট বাহিনীকে হটিয়ে দিতে থাকলে তুরস্কের সেনারাও মাঠে নেমে পড়ে। আল বাব শহর দখল নিয়ে নতুন সমীকরণ তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। আলেপ্পো থেকে এগিয়ে যাওয়া আসাদ বাহিনী আইএস থেকে তুরস্কের ফ্রন্ট লাইনকে বিছিন্ন করে দেয়। ফলে তুরস্কের গোপন রসদ সরবরাহের পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। আইএসের পিছু হটা দেখে মানুষ উত্ফুল্ল হয়ে উঠছে। বর্বর শাসন মুক্ত হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। অনেকে সরকারি বাহিনীতেও যোগ দিচ্ছে আইএস উত্খাত ত্বরান্বিত করতে।
অপরদিকে ইরাকের সেনাবাহিনী মার্কিন সহায়তায় পশ্চিম মসুলে অভিযান শুরু করেছে শেষ ঘাঁটি উত্খাত করতে। লড়াই চলছে এবং আইএসের পিঠ এখন শেষ দেয়ালে ঠেকেছে। অপেক্ষা শুধু সময়ের।
সিরিয়ায় চলমান আইএসবিরোধী যুদ্ধে পশ্চিমা সমর্থিত আসাদবিরোধী বাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারছে না। তাদের বাঁচানোর দায় স্বভাবতই তাদের প্রভুদের। কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহারের দায়ে নিরাপত্তা পরিষদে পশ্চিমা উত্থাপিত অবরোধ প্রস্তাব রাশিয়া ও চীনের ভেটোর মুখে পাশ হতে পারেনি। ৯টি ভোট পক্ষে থাকলেও নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাসে ভোটের সংখ্যা সর্বনিম্ন।
পরাশক্তিগুলোর নিজস্ব স্বার্থ ও ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে আইএস নির্মূল বিলম্বিত হচ্ছে। জঙ্গিবাদ রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতির নতুন হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহূত হলে বিশ্বকে নিরাপদ করা দুস্কর হয়ে দাঁড়াবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্যাম্প ক্ষমতায় আসীন হবার পর অতীতের অনুসৃত নীতি ধাক্কা খাচ্ছে, মিত্রদের সঙ্গে গড়ে ওঠা সমঝোতা না ভাঙলেও শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। দোদুল্যমান পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়া ও রাশিয়া সামরিক সমাধানে ব্যস্ত। মদদ দেওয়ায় জড়িত রাষ্ট্রগুলো অবস্থা বেগতিক দেখে নীতি পরিবর্তন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গি সহায়তার সুতোয় টান পড়েছে। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া থেকে সরে এসে পবিত্র হবার চেষ্টা করছে। জঙ্গিনেতাদের সুরক্ষা প্রত্যাহার করে তাদের আইনের আওতায় আনা শুরু করেছে। জঙ্গিবাদের বিশ্ব নঙ্ায় পরিবর্তনের আভাস মিলছে।
হিংসার দর্শন আলিঙ্গন করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের জঙ্গিদলগুলো হলি আরটিসান বেকারির হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নেতৃত্বশূন্য হয়েছে, সাংগঠনিকভাবে ছিন্নভিন্ন হয়েছে, হামলার সক্ষমতা কমেছে, নজরদারির মুখে থাকায় জঙ্গিরা একের পর এক ধরা পড়ছে। পাশাপাশি জঙ্গি হামলার বিচার গতি পেয়েছে। জাপানি নাগরিক হোসিও কুনি হত্যা মামলার রায় হয়েছে। জঙ্গি পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতারা দেশীয়ভাবে চাপের মধ্যে পড়েছে এবং বিদেশি প্রভুরা কিছুটা পিঠটান দিয়েছে। দেশের রাজনীতির গতিপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য অতীতের জঙ্গিনির্ভর রাজনীতির অসফলতা ও হিংসার রাজনীতির অগ্রহণযোগ্যতা শান্তির ভাবনা ভাবতে বাধ্য করেছে।
জঙ্গি হামলা প্রতিহত করতে মানচিত্রের কোথাও জঙ্গি পোষা যাবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে হিংসা বা জঙ্গি দর্শনের প্রসার ঘটতে থাকলে দেশ ঝুঁকিমুক্ত হতে পারবে না। বৈশ্বিক জঙ্গিবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে হিংসার দর্শনের বদলে শান্তি ও সম্প্রীতির সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চা গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামোফোবিয়াকে জিইয়ে রেখে জঙ্গি নির্মূল করা যাবে না। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থাকে পুঁজি করে ধর্মীয় বিদ্বেষকে কবর দিতে পারলে জঙ্গিবাদ নির্মূল হতেই হবে। ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের পরাজয় মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনীতির নতুন সমীকরণ তৈরি করলেও বিশ্ব থেকে জঙ্গি নির্মূলে সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করবে। বাংলাদেশের জঙ্গি দলগুলো হতাশায় পতিত হয়ে নির্জীব হয়ে পড়বে ।
সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১:১৭