এফবিআই এজেন্ট রবার্ট লাস্টিকের সঙ্গে লেনদেনের ‘খবর’ শফিক রেহমান জানতেন এবং তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছিল বলে স্বীকার করেছেন তার স্ত্রী তালেয়া রেহমান।
ঢাকার ইস্কাটনে তাদের বাসায় পুলিশের তল্লাশিতে নথি জব্দের বিষয়টিও তিনি সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করেছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ডেমোক্রেসিওয়াচের নির্বাহী প্রধান তালেয়ার দাবি, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিক’ হিসেবে নিবন্ধ লেখার জন্যই শফিক রেহমান ওই তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। একই কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এফবিআই এজেন্ট লাস্টিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সোমবার নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নথি পাওয়া গেছে সেটা ঠিক। বাসায় এসেছিলেন উনারা (পুলিশ)। উনি (শফিক রেহমান) অত্যন্ত গোছানো মানুষ। যত লেখা লিখেছেন, সে সম্পর্কে তথ্য তিনি ফাইল করে রেখেছেন, এটাও ফাইল করা ছিল। এটা তিনি ওদেরকে দিয়েছেন।”
প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে এফবিআইয়ের হাতে সংরক্ষিত গোপন তথ্য পাওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়ার অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী জাসাস নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের ছেলে রিজভী আহমেদ সিজারকে ২০১৫ সালে কারাদণ্ড দেয় সে দেশের আদালত।
মার্কিন আদালতে প্রসিকিউশনের নথিতে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে ‘অপহরণ, ভয় দেখানো ও ক্ষতি করাই’ ছিল সিজারের তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য। সিজার কিছু তথ্য বাংলাদেশি ‘এক সাংবাদিককে’ সরবরাহ করেছিলেন এবং বিনিময়ে ‘প্রায় ৩০ হাজার ডলার’ পেয়েছিলেন।
ওই রায়ের পর জয়কে অপহরণের চক্রান্তের অভিযোগ এনে ঢাকার পল্টন থানায় পুলিশ একটি মামলা করে। সেই মামলাতেই গত ১৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় যায়যায়দিনের সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমানকে, যিনি বিএনপিঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার পর গত ১৯ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, জয় সম্পর্কে তথ্য পেতে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় দণ্ডিতদের সঙ্গে ‘একাধিক বৈঠকের কথা’ শফিক রেহমান ‘স্বীকার করেছেন’।
ওইদিনই শফিক রেহমানকে সঙ্গে নিয়ে তার ইস্কাটনের বাসায় তল্লাশি চালানোর কথা জানায় পুলিশ।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ সেদিন বলেন, “শফিক রেহমানের নিজের হেফাজতে রাখা সজীব ওয়াজেদ জয় সংক্রান্ত প্রাথমিক কিছু তথ্য, বাড়ি, গাড়ির নম্বর, কোথায় থাকেন, এসব... আর গোপনীয় কিছু নথিপত্র পাওয়া গেছে। তিনি এসব সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।”
গত সপ্তাহে লন্ডনে শফিক রেহমানের মুক্তির দাবিতে এক সমাবেশে তার ছেলে সুমিত রেহমান দাবি করেন, “আমার বাবা একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রীপুত্রের আয় ও সম্পদের অনুসন্ধান করছিলেন, তিনি হয়ত এক্ষেত্রে অনেক দূর গিয়েছেন।”
শফিক রেহমানের ‘মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, রিমান্ড বাতিল ও মামলা প্রত্যাহারের’ দাবিতে সোমবার ইস্কাটনের সংবাদ সম্মেলনে তালেয়া রেহমানও স্বামীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একই ধরনের ব্যাখ্যা দেন।
শফিক রেহমানের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ হাজার ডলার রিজভীর অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে-পুলিশের এমন বক্তব্য সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তার স্ত্রী বলেন, “উনি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। এই রকম হলে যে অন্য কিছু হতে পারে, এইটুকু জ্ঞান তার রয়েছে। উনি ফিন্যান্সিয়াল... সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। উনার হাত দিয়ে টাকা গেছে এটা আমি বিশ্বাস করি না। উনি টাকা পয়সার সঙ্গে জড়িত নন।
“তবে হ্যাঁ, লেনদেন যে হয়েছে, সেই খবরটা উনি জানতেন।”
এ ঘটনায় আরও কয়েকজন বাংলাদেশির জড়িত থাকার যে দাবি পুলিশের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তালেয়া বলেন, স্বামীর কাছ থেকে তিনি ‘একজনের’ কথা শুনেছেন।
স্বামীর কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যায় তালেয়া বলেন, “এই যে কিছু তথ্যের আদান প্রদান হয়েছে, সেই তথ্যটা ছিল একজন বিশেষ পারসন সম্পর্কে...। নিশ্চই ঘটনার সময় জানতেন বলেই আমেরিকায় গিয়েছিলেন। আমি জেনেছি পরে।”
ওই সময়ই, ‘সম্ভবত ২০১২ সালে’ লাস্টিকের সঙ্গে শফিক রেহমানের সঙ্গে দেখা হয় বলে তালেয়ার ভাষ্য।
তিনি বলেন, “তিনি স্বীকার করেছেন যে হ্যাঁ, ইনফরমেশন নিয়েছেন। সেই ইনফরমেশনের মধ্যে হত্যা নাই, অপহরণ নাই।... সেই ইনফরমেশন কী বলছে? লাস্টিক যে তথ্য দিয়েছেন সে সম্পর্কিত ইনফরমেশন। আমি এর বেশি কিছু জানি না।”
তালেয়া বলছেন, তার স্বামী একজন ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিক’। এ সাংবাদিকতা তিনি শিখেছেন বিদেশ থেকে। কোনো বিষয় ‘খতিয়ে দেখে’ তারপরই তিনি লেখেন, ‘ভাসাভাসা, মনের আনন্দে’ লেখেন না।
“প্রত্যেকটি জিনিসের প্রমাণ তার কাছে থাকে। এখানে তিনি লিখলেনও না, কালেক্ট করে রেখেছেন। উনি লেখেন নাই, তার মানে হচ্ছে লেখার মতো পর্যাপ্ত তথ্য এখানে ছিল না।”
সংবাদ সম্মেলনে তালেয়া রেহমান বলেন, সজীব ওয়াজেদ জয় ‘একের পর এক যেভাবে মিথ্যা স্ট্যাটাস’ দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে শফিক রেহমানের ‘মানহানির’ পাশাপাশি তদন্তকাজ ‘প্রভাবিত হচ্ছে’ বলে তিনি মনে করেন।
অবিলম্বে শফিক রেহমানের মুক্তি দাবি করে তার স্ত্রী বলেন, “তার বয়স, অসুস্থতা ও রিমাণ্ডের নামে নির্যাতনের ফলে তার জীবনহানির আশঙ্কা করছি।”
রিমান্ডে শফিক রেহমানের কাছ থেকে ‘নির্যাতনের মাধ্যমে মিথ্যা স্বীকারোক্তি’ আদায় করা হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তালেয়া।
লিখিত বক্তব্যে মার্কিন আদালতের রায়ের অংশ পড়ে শুনিয়ে তিনি বলেন, “হত্যা-অপহরণের যে অভিযোগ এখানে করা হচ্ছে তাতো আদালত খারিজ করে দিয়েছে।”
এ বিষয়ে কোনো খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে কেবল পুলিশের দেওয়া তথ্য না ছেপে যাচাই করে নেওয়ার আহ্বান জানান তালেয়া।
সূত্র