ভার্সিটির জুনিয়র ফ্রেন্ড নাইয়ার (ব্লগার মুহম্মদ জায়েদুল আলমের স্ত্রী) এর সাথে আলাপের সুবাদে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের কেন্দুরবাগ এলাকায় “প্রান্তিক উন্নয়ন সোসাইটি” নামে একটা এনজিও-র ব্যতিক্রমধর্মী স্কুলের কথা জানলাম। ইচ্ছা চাপলো স্কুলের কার্যক্রম স্বচক্ষে দেখার। ঢাকা থেকে এ প্রতিষ্ঠানের পীযূষদা' সঙ্গী হলেন আমার আগ্রহের কথা শুনে। ভোরে বাসে করে ঢাকা থেকে গিয়ে আবার সেদিন বিকালেই ফিরে এলাম। বাস ছাড়ার পরেই পীযূষদা’ সাগ্রহে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস, কার্যফ্রম, শিক্ষানীতি, মোটিফ এসব খুব গুছিয়ে বললেন। খুলনার তরুণ পীযূষ, সবে ডিগ্রী পাশ করেছে। মাহমুদ হাসান নামের বিলাত প্রবাসী কর্মঠ, উদ্দ্যমী এক ব্যক্তি আশির দশকে খুলনার গ্রামে ঘুরে ঘুরে কৃষকদের অধিকারের কথা বলে, তাদের বোঝায় কীভাবে পরিশ্রমের ফসলে ভাগ বসাবার দাবী জানাতে হয়। পীযূষ তখন পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। মাহমুদ হাসানের মনে ধরলো অল্পবয়স্ক এই যুবকটির জীবনভাবনা আর সাংগঠনিক ক্ষমতা। তিনি আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর প্রতিষ্ঠান “গণ সাহায্য সংস্থা”-য় (জি এস এস) যোগ দেয়ার জন্য। যে আয় হতো ব্যবসা থেকে সেটাই পারিশ্রমিক হিসেবে পাওয়া যাবে আবার দেশসেবারও সুযোগ পাওয়া যাবে। পীযূষের মত আরো কিছু যুবককে নিয়ে মাহমুদ হাসান মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের সংগঠিত করে তুলতে লাগলেন। দেশের নানা অংশে তাদের কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়লো। পীযূষ জানালেন সে সময়ে তাদের উন্মাদনার কথা। কী বিপুল মনোবল নিয়ে গ্রামের শিক্ষিত তরুণরা কৃষকদের বাড়ি বাড়ি পোঁছে তাদের সমস্যা আর সম্ভাবনার কথা শুনছে। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কৃষকরা ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছে আর এদিকে এনজিও-র কর্মীরা মাহমুদ হাসানের সাহচর্যে সমাজ, জীবন, দর্শন, রাজনীতি নিয়ে রাজ্যের বই পড়ে জানার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য ছিলো “উন্নয়ন” এর প্রকৃত অর্থ বুঝে নিয়ে সেটা নিয়ে কাজ করা, সেবা আর ব্যবসাকে এক না করা।
নব্বই এর দশকে জিএসএস থেকে কিছু কর্মী আলাদা হয়ে “প্রান্তিক উন্নয়ন সোসাইটি” এর যাত্রা শুরু করেন। কৃষি এবং ঋণ কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষার অসারতা অনুধাবন করে এই প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার ফকিরাপুল এবং বেগমগঞ্জে (যেখানে আমি গিয়েছিলাম) স্কুল চালু করে। মুখস্থবিদ্যা থেকে বের হয়ে আসা, ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই কল্পনাশক্তি বিকাশের প্রচেষ্টা, ক্লাসে বাস্তবধর্মী এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোর দেয়ার চেষ্টা থেকেই এই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রচলিত ধারানুযায়ী আগে বর্ণ, পরে শব্দ শিখা- এর পরিবর্তে দৈনন্দিন জীবন থেকে বিভিন্ন পরিচিত শব্দ এবং প্রাসঙ্গিক ছবি ও উপকরণ দিয়ে প্রথমে শব্দ গঠন শিখে পরে বর্ণ আয়ত্তের পদ্ধতি অবলম্বন ছিলো পাঠ্যক্রমের একটা বিশিষ্ট দিক। এছাড়া, প্রচলিত নিয়মে শিক্ষাবর্ষ দিয়ে এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার সময়কাল নির্দেশ না করে “প্রান্তিক” এর নিয়মানুসারে গবেষণালব্ধ কিছু বাছাইকৃত যোগ্যতা অর্জনই কেবলমাত্র পরবর্তী ধাপে পা দেবার নিয়ামক হতে পারে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এরকমভাবে শ্রেণী বিভাজন এই প্রতিষ্ঠানের নিয়মের বাইরে। এ ধরণের কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষাদর্শন গ্রামের অভিভাবকদের কাছে শুরুতে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সবাই জানতে চায় তার সন্তান বছর শেষে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হলো কিনা বা এখন কোন শ্রেণীতে পড়ছে। বর্ণ এবং শব্দ শেখার বিশেষ পদ্ধতিও শুরুতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলো। অনেক চেষ্টার পরে অভিভাবকদের প্রমাণ দেখানো সম্ভব হয় যে, শুরুতেই অ আ শেখা শুরু না করলেও বিকল্প পদ্ধতিতে তিনমাসের মাথায়ই শিশুরা বর্ণ আয়ত্ত করতে পারঙ্গম হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির শ্রেণীবিষয়ক বিকল্প ধারণা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং বাধ্য হয়েই প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করতে হয়েছে। পীযূষদা’ জানালেন “প্রান্তিক” পুরোপুরি বিদেশী সাহায্যনির্ভর সংস্থা নয় এবং শিক্ষা কার্যক্রমকেও তাই অবৈতনিক রাখা সম্ভব হয়নি। শ্রেণীভেদে ৩০০ থেকে ৩২৫ টাকা মাসিক হারে বেতন নেয়া হয়।
প্রায় সাড়ে ছ’ঘন্টা বাসভ্রমণের পর স্কুলে পৌঁছে দেখলাম দিনের কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে। দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস চলছে। ক্লাসরুম এবং ছাত্রদের দেখে প্রথমেই আমার মনে হলো শিক্ষাকার্যক্রম কিন্ডারগার্টেন-এর আদলে পরিচালিত হচ্ছে। স্কুলের নামেও বাই-লিংগুয়াল শব্দটা আছে। ছাত্ররা আমাকে ইংরেজীতে অভিবাদন জানালো এবং আমার সব বাংলা প্রশ্নের উত্তরই সমস্বরে ইংরেজীতে দিলো। পীযূষদা’র সাথে আসার পথে যতটুকু আলাপ হয়েছে তা থেকে আমার উপলব্ধি হলো, ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রদানের উদ্দেশ্যে স্কুলটা চালু হলেও ব্যয়নির্বাহের জন্য স্কুলটিকে কিছুটা বাণিজ্যিক আদলে গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছেন উনারা। আশেপাশে আরো কয়েকটা সরকারি এবং বেসরকারি স্কুল রয়েছে। প্রতিযোগিতার প্রশ্নটা স্বভাবতই এসে যায়। ২০০৩ সাল থেকে স্কুল চালু হয় এবং প্লে-গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র ভর্তি করা হয়। প্রধান শিক্ষক শংকরদা’ জানালেন প্লে-গ্রুপ এবছর থেকে শুরু হচ্ছে। নার্সারি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রসংখ্যা সন্তোষজনক। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিবন্ধন না পাওয়ার কারণে উপরের ক্লাসে অভিভাবকেরা বাচ্চাদের পড়ানোর ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নন। ২০০৯ সালে তিনজন ছাত্র নিয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস শুরু হয় এবং নিবন্ধন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে অন্য একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে এই তিনজনকে ভর্তি দেখানো হয় যাতে তারা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। বছরের প্রায় শেষদিকে এনজিও স্কুলগুলোকেও নিবন্ধনের আওতায় আনার ঘোষণা এলে এই তিন ছাত্র নিজের স্কুল থেকেই সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং খুব ভালো ফলাফল করে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সরকারি স্কুলের বইগুলোর পাশাপাশি বাড়তি অনুশীলনের জন্য বাইরের কিছু পাঠ্যবই রয়েছে। সকালের শিফটে সাড়ে নয়টা থেকে বারোটা প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত এবং দুপুরে বারোটা থেকে তিনটা দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়।
প্রতিটি শ্রেণীকক্ষের দেয়ালে শিশুদের আঁকা ছবি এবং বর্ণনা, বর্ণ এবং শব্দ শেখার জন্য চার্ট, ফুল-ফল, ঋতু, দিন ও মাসের নাম, সংখ্যাজ্ঞান লাভের জন্য সচিত্র পোস্টার এসব চোখের পড়লো। একজন শিক্ষক একটা শ্রেণীর সবগুলো বিষয়ের দায়িত্বে থাকেন তবে অন্য স্কুলের মতো সময় হিসাব করে বিষয়ভিত্তিক বিভাজন করা হয়না। একটা ক্লাসে গোলাকার কিছু টেবিল রয়েছে যার চারপাশে বাচ্চারা বসে। এই ধরণের শ্রেণীসজ্জার উদ্দেশ্য হলো দলগত কাজকে সহজতর করা এবং সবসময় সহপাঠীদের সাথে চিন্তা এবং অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির সুযোগ দেয়া। একই সময়ে বিভিন্ন টেবিলে সমান্তরালভাবে বিভিন্ন বিষয়ের শিখন চলে এবং শ্রেণীশিক্ষক পুরোটা সময় সবগুলো টেবিল ঘুরে তদারকি করেন। শিক্ষকরা জানালেন দৈনন্দিন কার্যক্রমের শুরুতেই “নিউজ রিডিং” এর আওতায় ছাত্ররা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা ক্লাসে শেয়ার করে। এর উদ্দেশ্য হলো বাস্তবজীবনের কোন ঘটনাকে সুবিন্যস্তভাবে উপস্থাপনের কৌশল আয়ত্ত করা। প্রজেক্ট এর আওতায় প্রতিমাসে কোন একটা নির্ধারিত বিষয়ের উপর (প্রধানত মৌসুমী ফুল, ফল, ফসল ও ঋতু) ছাত্র এবং শিক্ষকরা চিত্রাঙ্কন ও উপকরণ তৈরি করে ক্লাসে সেটা প্রদর্শন করেন। সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য নিয়মিতভাবে সব শ্রেণীর শিক্ষার্থী বিষয়ভিত্তিক লেখালেখির চর্চা করে এবং মুখস্থের প্রবণতা থেকে বের করে আনার জন্য শিক্ষকরা সচেষ্ট থাকেন। ছাত্রদের সাথে আলাপে স্কুলবিষয়ে তাদের অনুভূতির কথা জানলাম। সবাই জানালো, বন্ধুসুলভ শিক্ষকরা সবসময় চেষ্টা করেন প্রতিটা বাচ্চাকে আলাদা করে সময় দিতে এবং তার সমস্যাগুলো মেটাতে। শিক্ষকরা কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। তাঁদেরকে শেখানো হয় কখনোই কোন বাচ্চাকে তিরস্কার করা যাবেনা, তার শিখনক্ষমতা নিয়ে কোন তীর্যক মন্তব্য করা যাবেনা, কখনোই কল্পনাশক্তি বিকাশে বাধা দেয়া যাবেনা এবং ক্রিয়েটিভিটিকে সর্বোতভাবে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এই ব্যাপারগুলো আমার কাছে দারুণ আশাব্যঞ্জক মনে হয়েছে এবং শিক্ষকরা আন্তরিকভাবেই এই মূলমন্ত্রগুলো পাঠদানের সময় প্রতিফলনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে এই স্কুলের কার্যক্রম কতটুকু প্রভাব ফেলছে সেটা নিয়ে উপসংহারে পৌঁছার চেয়েও আমার আগ্রহের কেন্দ্র ছিলো বিকল্প ধারার কার্যক্রম বাস্তবে কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং ছাত্রদের কাছে সেটার গ্রহণযোগ্যতাই বা কেমন। সে বিচারে বেগমগঞ্জের এই স্কুলের একদিন আমার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে অনন্য সংযোজন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:৩৫