তিনবছর পর যখন দেশে আসলাম, কেন যেন এতদিনের ব্যবধানটা ধরতে পারছিলামনা। প্রায় একমাস কেটে গেলো, এখনো পারছিনা। দূরে থাকার জন্য তিনবছর বোধহয় বেশী সময় নয়। আমার কাছে মনে হচ্ছে, কই সব তো আগের মতোই আছে। শুধু পিচ্চিগুলা দৈর্ঘ্যে বেড়েছে বিপজ্জনকভাবে। বাবা-মার চুলে ধূসরের আধিক্য দেখলাম। সিলেটে কিছু নতুন বিল্ডিং, মার্কেট। ঢাকার পরিবর্তন জানিনা কারণ আগের চিত্র তেমন ভালো জানা নেই। মেয়েদের পোশাকের ঢংয়ে বেশ বিদেশ বিদেশ ভাব। এছাড়া সেই আগের মতোই ভীড়বাট্টা, জ্যাম। ধূলার আস্তরণকে বিবর্ণ করে দিয়ে জীবনের রঙ ছলকে পড়া পথে-ঘাটে। শ্রমজীবী মানুষের বলিষ্ঠ পেশী সব প্রতিকূলতাকে উপহাস করছে ভীষণ সাহসে। এ আমার চিরচেনা দেশ।
গোপনে একটা প্রজেক্ট সাজিয়েছিলাম মনে মনে। অতীতকে খুঁজে বেড়াবো এবার, যতটুকু পারি। দু’টো কাজ করতেই হবে। এক, পুরনো সব ছবি স্ক্যান করবো সংরক্ষণের জন্য। দুই, ক্লাস থ্রি থেকে ফাইভ সিলেটের একটা শহরমুখী গ্রামে কাটিয়েছিলাম, সেখানে প্রায় ২১ বছর পর আবার যাবো কয়েক মিনিটের জন্য হলেও। আমি আনন্দিত কারণ দু’টো ইচ্ছাই পূরণ হয়েছে। পুরনো সব এলবামের ভাঁজ থেকে সেঁচে নিয়েছি সাদাকালো আর রঙীন অতীত। আমার শৈশব, কৈশোর। তারুণ্য নিয়ে অতটা আগ্রহী ছিলামনা। বোধহয় এখনো তারুণ্যে আটকে আছি তাই সেটাকে বর্তমানই মনে হচ্ছে। দাদী মারা গেছেন প্রায় দশ বছর। উনার ছবিগুলো যখন ডিজিটাল এক-শূণ্যে পরিবর্তন হচ্ছিলো, আমি ভাবছিলাম উনার মারা যাওয়ার সকালটার কথা। অসম্ভব নরম মনের হাস্যময়ী এক মানুষ ছিলেন। সিলেটের প্রাচীন কিছু প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক দাদী কথায় কথায় বলতেন। একেবারেই অশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু দারুণ রুচিশীলা। গত হয়েছেন নানাভাইও। তাঁর ছবিগুলো মনে করিয়ে দিলো নানাবাড়িতে অসম্ভব আনন্দময় কিছু সময়ের কথা। শেষ বয়সে নানা কোলাহল সহ্য করতে না পেরে খেলায় মত্ত নাতিগোষ্টীকে জোরসে বকা দিতেন। তখন খুব বিরক্ত হতাম। আজ ভীষণ খারাপ লাগলো। আজব সময়। সাদাকালো ছবিতে আমার ৯/১০ মাস থেকে শুরু করে ৫/৬ বছর পর্যন্ত অতীত ঝুলে থাকতে দেখলাম। একটা ছবি আর একটা গল্প। আমি বড় হচ্ছি, ছবিতে রঙ বাড়ছে। বাড়ছে মনে আর পরিপার্শ্বে। চারবোনের এক কানি যৌথসম্পত্তি, পারাবারিক নানা উপলক্ষ্যের একটা এলবাম। এ ছবিগুলো আমার সবচেয়ে মূল্যবান স্থাবর সম্পদ।
কিছুটা সিনেমার মত। সিলেট শহর ছেড়ে গাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ঢুকছে। আমি আর আপা ২১ বছর পর একেকটা জায়গা, প্রতিষ্ঠান, সাইনবোর্ড শনাক্ত করছি। আরে, এটাতো এখানে ছিলোনা, এই দেখ দেখ এই জায়গাটা পুরো বদলে গেছে, আরে ওই রাস্তাটা একদম আগের মত আছে। আমি তখন ডুবে আছি ১৯৮৭ তে, ৮৮ তে। একটা মেঠো পথ ধরে বিকালে আব্বুর সাথে হাঁটতে বের হতাম, সেই পথে আজকের ২০০৯ এর তাজীন, শিরশিরে একটা অনুভূতি। একটা কবরস্থানের পাশ দিয়ে খুব জোরে দৌড়ে পার হতাম, এখন অনেক সাহসী। একটা ঈদগাহ এত পরিষ্কার থাকতো যে খাদেমের বকা খেয়েও খেলতে ঢুকে যেতাম, আজ ঈদগাহের চারপাশে গোলাপী-সাদা অর্ধেক দেয়াল। ওহ এইতো সেই বাসা, লাগোয়া বাঁধানো পুকুর। অজস্র আনন্দময় ক্ষণ কেটেছে এখানে। বাড়িটা কেমন পোড়ো হয়ে আছে। কেউ নেই ত্রিসীমানায়। খুব কান্না আসছিলো ২১/২২ বছর আগের কথা মনে করে। আমার এত আনন্দের জায়গাটা এত মলিন কেনো? কেউ কী জানতোনা অনেক বছর পর একটা মানুষ তার শৈশব খুঁজতে এখানে আসবে। কেউ কী পারলোনা সবকিছু একটু আগের মত রেখে দিতে? ঘাটটা ভাঙ্গা কেনো? পুকুরটা মরে গেছে কেনো? আমি এখানে অনেক অনেকবার সাঁতার কেটেছি। আমার বাবা-মার করা সবজি বাগান কই? আমাদের সেই দোলনা কই? গাছটা উপড়ে ফেলেছে কে? বাড়িটার কেনো কেউ যত্ন করেনি? আমি সেই সময়টা চাই চোখের সামনে। আমার সেই দুরন্ত ছোটবেলার আনন্দ চেখে নিতে এতদূর এসেছি। কেনো আমি আজো সেরকম নেই? হেঁটে হেঁটে পরিচিত এক বাসায় আব্বু ঢুকলেন। পেছনে আমরা দু’বোন। বাড়ির কর্তার নামটা এতদিন পরেও আব্বুর মনের আছে আর সেই মানুষটাও এতদিন পর আব্বুকে দেখে চিনতে পারলেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছিলো সব। সেই মানুষগুলো এখনো একই জায়গায় আছে। কত কাছের ছিলো এ মানুষগুলো। প্রাণভরে দোয়া করলেন চাচা-চাচী। ওই সময়টা আরো কিছু এলাকায় থেকেছি আমরা, সেই বাড়িগুলো দেখতে গেলাম। পরিচিতদের প্রায় কেউ নেই। অনেক কষ্টে দু’একজনকে আব্বু খুঁজে বের করলেন। অনেকে অবিশ্বাসের চোখে তাকালো, কোন কাজ না, দাওয়াত না, শুধু পরিচিত জায়গাগুলো দেখতে এতবছর পর কেউ ফিরে আসে!
আজ কত দ্রুত গতকাল হয়ে যায়। এভাবে একসময় সময় ফুরোবে। যে জীবন নিয়ে এত আয়োজন, সে কতই না ভাবনাহীন! সে কতটুকুই বা জানে আমাদের গল্প?