ভেনিজুয়েলার বলিভারিয়ান বিপ্লবের দশক পূর্তিতে, অস্ট্রেলিয়ায় ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রদূত নেলসন ডেভিলা আজ এসেছিলেন নিউক্যাসেল ইউনিভার্সিটিতে। 'ভেনিজুয়েলার বিকল্পপন্থা' শীর্ষক তাঁর বক্তৃতায় উঠে এসেছে বলিভারিয়ান বিপ্লবের প্রেক্ষাপট, হুগো শ্যাভেজ এবং তাঁর অনুসারীদের বিপ্লবের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা। বক্তব্যের প্রতিটি শব্দে জ্বলে উঠেছে মার্কিন সরকারের প্রতি বিষোদগার। পুঁজিবাদী বিশ্বের হর্তা-কর্তাদের প্রতি ভেনিজুয়েলার ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ, আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে প্রাণ পাচ্ছিলো নেলসনের কথামালায়। "এক দশকে আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি, ব্যবসা আর মুনাফার বাইরেও কিছু শব্দ আছে। গঠনতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র চর্চা কেবল অলীক স্বপ্ন নয়, ভেনিজুয়েলায় তা বিদ্যমান বাস্তবতা। আইএমএফ আর জাতিসংঘই মানবকূলের ভাগ্য-নির্ধারক নয়। বিকল্প শক্তিও আছে যাদের কাছে সবার ঊর্ধে হল মানুষ। বন্ধুগণ, অন্য পৃথিবী গড়া সত্যি সম্ভব। আমরা তা গড়ে দেখিয়েছি। দীর্ঘদিনের পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা অসীম সাহসী জনগণ প্রত্যাখান করেছে অন্য পৃথিবীর আশায়"। নেলসনের জবানিতে তুলে ধরছি এক দশকের পথচলা।
শাভেজের বাণী বলিভারিয়ান সরকারের মূলমন্ত্র; "সময় স্বল্প। যদি আজই আমরা বিশ্বকে বদলে না দিই, দ্বাবিংশ শতক কখনো নাও আসতে পারে"। ১৯ টি মিশনের আওতায় এক দশক জুড়ে ভেনিজুয়েলায় চলছে 'অন্য পৃথিবী' গড়ার প্রস্তুতি। 'মিলাগোরো মিশন' এর আওতায় নিম্নআয়ের নাগরিকগণ পাচ্ছেন বিনামূল্যে চোখের শল্যচিকিৎসা। এ মিশন দেশের সীমা ছাড়িয়ে সেবা দিয়ে চলেছে ল্যাটিন আমেরিকার অন্য দেশেও। খাদ্যমূল্য কমিয়ে আনার জন্য আরেকটি মিশন খাদ্য উৎপাদন-বিপণন ব্যবস্থার পুরা প্রক্রিয়ায় মধ্যবর্তীদের অংশগ্রহণ কমিয়ে আনছে। বিনামূল্যে সর্বস্তরে শিক্ষার সুযোগ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছে শাভেজ সরকার। আগামী দু'বছরের মধ্যে নিরক্ষরতা ঠাঁই পাবে জাদুঘরে।
সাইমন বলিভারের বিপ্লবী চিন্তাই হচ্ছে ভেনিজুয়েলার বলিভারিয়ান আন্দোলনের ভিত্তি। উনিশ শতকে বলিভার লড়েছেন স্প্যানিশ উপনিবেশ থেকে ভেনিজুয়েলাকে মুক্ত করতে। জয়ী হয়েছেন। একবিংশ শতকে বলিভারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন হুগো শাভেজ। প্রতিপক্ষের শুধু নাম ভিন্ন, চরিত্র একই। শাভেজের আজকের বিপ্লব 'পুঁজিবাদ' আর তার পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে। ভেনিজুয়েলা থেকে দুর্নীতি নির্মূল, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন, সম্পদের সুষম বন্টন- এই স্বপঙ্গুলোই বিপ্লবীদের জড়ো করেছে এক আকাশের নীচে। ১৯৯৮ এ নির্বাচনে জয়ী হয়ে শাভেজ প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত ভেনিজুয়েলা পাড়ি দিয়েছে দীর্ঘ পথ। জাতীয় সম্পদ কুক্ষিগত ছিলো কতিপয় গোষ্ঠীর হাতে। একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন লালশিখা হয়ে জ্বলজ্বল করছিলো কিছু মানুষের মনে। '৮৯ এ আইএমএফ যখন নাটকের পটে ঢুকে গেলো তখন জনগণ মাঠে নেমে সরাসরি বিক্ষোভ প্রদর্শন করলো ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে। কার্লোস সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে রক্তে ভাসিয়ে দিলো রাজপথ। 'বলিভারিয়ান বিপ্লব' এতদিন শুধু একটা ধারণা বা মতবাদের আড়ালে ছিলো। আস্তে আস্তে জনগণের সমর্থন পেয়ে আন্দোলন রূপ নিতে লাগলো জাতীয় বিপ্লবে। ১৯৯২ এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি শাভেজের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একাংশ অভ্যুত্থান ঘটাতে সমর্থ হলো। পরিণতি সফল ছিলোনা। শাভেজ কারাগারে গেলেন, বন্দী হলেন অনেক। গোপনে চলতে লাগলো বিপ্লবী কার্যক্রম। এই বছরের নভেম্বরে দ্বিতীয়বারের মত অভ্যুত্থান পরিচালিত হলো সশস্ত্র বাহিনীর অন্য দু’টি অংশের সহায়তায়। ৯২ থেকে ৯৮- শাভেজ রীতিমত রাজনৈতিক দল নিয়ে মাঠে নামলেন, নির্বাচন করলেন, জনগণের রায়ে নির্বাচিত হলেন।
নেলসন দৃপ্ত কন্ঠে বলছিলেন, "এক দশকের শাসনামলে শাভেজের পথচলা মসৃণ নয়। বিপক্ষ দল, মিডিয়া একদিকে রেখেছে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ঠেকাতে হচ্ছে পশ্চিমা চোখরাঙানি আর 'সন্ত্রাসীর দোসর' খেতাব। ভেনিজুয়েলা 'অন্য পৃথিবী'র স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশে-দেশে। ইরানের সাথে তেলচুক্তি হওয়ার পরে আমেরিকার সন্দেহ তালিকায় আরো একধাপ উপরে উঠে গেছি আমরা। বিপক্ষদল আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বিষোদগার করছে আমাদের বিরুদ্ধে, মিথ্যাচার করছে। আজ আমি এখানে সত্যিটা আপনাদের জানাতে। বলিভারিয়ান সরকার স্বৈরশাসক নয়, যেমনটি বলছে বিপক্ষ দল। ভেনিজুয়েলায় কারো বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়না। আমরা একটি মাত্র টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পুনঃনবায়ন করতে দেইনি যারা সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পক্ষে জনমত তৈরি করতে চাচ্ছিলো। এই উদাহরণ টেনে বহির্বিশ্বে প্রচার করা হয়, আমরা স্বাধীন মতকে রুদ্ধ করে দিয়েছি, যা সত্য নয়। ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ কোন্দলের গোড়ায় কারা আছে, আমরা জানি। কোন দেশের কোন পরিবারগুলো বিপক্ষ দলকে নিয়ন্ত্রণ করছে, আমাদের কাছে সব তথ্য আছে। যে পরাশক্তি আজ বিশ্বময় অশান্তি তৈরি করে রেখেছে, তারা আমাদের চিহ্নিত করেছে সন্ত্রাসীর দোসর হিসেবে। আমরা ঘোষণা করছি, জাতীয় সম্পদ তৈল থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করা যদি সন্ত্রাস হয়, তাহলে আমরা সন্ত্রাসী। অর্থ থেকে মানবতার দিকে জাতির আগ্রহ ফিরিয়ে আনা যদি স্বৈরশাসন হয়, তাহলে আমরা স্বৈরশাসক। বলিভারিয়ান বিপ্লবের মূলকথাই হলো জাতীয় সম্পদে সবার সমান অধিকার থাকবে। সবগুলো তেলক্ষেত্রের মালিকানা আজ জনগণের হাতে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার এ সময়ে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি বেসামাল হয়নি। আমরা কারো দয়ায় বাঁচিনা, কারো গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করিনা। আমরা কারো হাঁড়ির খবর নিতে যাইনা, কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাইনা। তবে মানবতার বিরুদ্ধে হুমকি যদি আসে, আমরা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এজন্যেই ভেনিজুয়েলা পাশে দাঁড়িয়েছে ফিলিস্তিনিদের, পাশে দাঁড়াবে সব নির্যাতিতের"।
শেষ করার আগে নেলসন শ্রোতাদের অনুরোধ জানালেন, তাঁর কথাকে প্রামাণ্য ধরে না থেকে নিজেরা খোঁজ নিতে। তবে অনুরোধ জানালেন, তথ্যসূত্র যেন আমেরিকার ধামাধারী মিডিয়া না হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৪:১৭