স্বপ্ন দিনের কথোপকথন!
তখন ক্লাস টেনে পড়ি। নাকের নিচে সদ্য গজানো গোঁফের রেখা। উড়ু উড়ু রঙিন মন। পাঠ্যবইয়ের চাইতে বাইরের গল্পের বই-উপন্যাসের (তখনকার মুরুব্বিদের ভাষায় "আউট বই") দিকেই ঝোঁক বেশি। তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা আর কুয়াশার ঘোর কেটে গিয়েছে। হুমায়ুন-ইকবালের সংগ্রহে সবে হাত দিতে শুরু করেছি। বড় ভাইদের সুবাদে একটা দুটো সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দুতেও হাত পড়ছে।
এমনি সময় এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে চোখে পড়ল নতুন একটা বই; নাম লোটাকম্বল।
দুই খন্ডের বই। সে সময় আমাদের বন্ধু মহলে প্রত্যেকেরই একটা না একটা কিঞ্চিত অশ্রাব্য উপনাম ছিল। সুমন নামের এমনই একজনের উপনাম দিয়েছিলাম "লোটা"। ফলে লোটাকম্বল অর্থ না জানা থাকলে ও আমার মাথায় নামটা ধাক্কা দিল। বন্ধুকে বলে সেদিনই বাসায় নিয়ে এসে পড়তে বসলাম (বসলাম বলা ঠিক হলো না! গল্পের বই আমি সারা জীবনই শুয়ে শুয়ে পড়েছি)। কিন্তু, একী! এ সব কী ছাই পাশ লিখেছে! কিছুই তো বোঝা যায় না! দুই-তিন পৃষ্ঠা কষ্টে-সৃষ্টে এগিয়ে ক্ষান্ত দিলাম। পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য কোন বই হাতে আসার পর চেষ্টা পড়তে না পারার প্রথম ও শেষ উদাহরন হয়ে রইল এই বই।
এরপর গুনে গুনে আটটি বছর চলে গেলো। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে বেকার জীবন শুরু করলাম। এই সময়ে কত কত বই পড়ে ফেলেছি। মাঝে মাঝে "লোটাকম্বল" টাও হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। কিন্তু, অবস্থা তথৈবচ। দুই থেকে তিন পৃষ্ঠা যাবার পরই ফুয়েল খতম!
তারপর একদিন। রাত গভীর হয়েছে। হাতে নতুন কোন বই নেই। ডিভিডি কালেকশন ও শেষ। কী মনে করে হাতে তুলে নিলাম বইটা। এবার, কী যাদু ভর করলো কে জানে! পাতার পর পাতা উড়ে চলল। কী দারুন কাহিনী। এটাই কি আমি এতদিন না পড়ে বসেছিলাম! মনে পড়ে গেলো বনফুলের "পাঠকের মৃত্যু" গল্পটার কথা। আমার ক্ষেত্রে বুঝি উল্টো পুরান!
দুই খন্ডের বই। প্রায় আটশ' পৃষ্ঠা জুড়ে এর কাহিনীর বিস্তার। বইয়ের নিজের ভাষায়, "ভেঙে যাওয়া যৌথ পরিবারের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ এক পৌঢ়, হিমালয়ের মত যাঁর ব্যক্তিত্ব, অসম্ভব যাঁর আদর্শনিষ্ঠা, আপাত কঠোর যেন প্রুশীয়ান জেনারেল অথচ ভেতরে ভেতরে কুসুম কোমল। আর সেই মানুষটির একমাত্র মাতৃহারা যুবক সন্তান, মাঝে দুই পুরুষের ব্যবধান। পূর্বপুরুষ উত্তর পুরুষে সঞ্চারিত করতে চায় জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ আর মূল্যবোধ। মানুষের মত মানুষ করে তুলতে চায়।....দুই পুরুষের মূল্যবোধ আর দৃষ্টিভঙ্গির ঠোকাঠুকির মধ্যে আর এক পুরুষ। তিনি বৃদ্ধ মাতামহ। আধ্যাত্মিকতার বাতিটি তুলে যিনি খুঁজে পেতে চান সেই চির-চাওয়া পরমপুরুষটিকে..."
হ্যাঁ, উপন্যাসের মূল চরিত্র বিশোর্ধ্ব যুবকের পলাশ চট্টোপাধ্যায়। পিন্টু নামে পরিচিত এই যুবকের জবানিতেই গল্প এগিয়ে চলেছে। শৈশবে মাতৃহারা এই পরিবারে মৃত্যু একের পর এক আঁচড় মেরে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে এক একজন কাছের স্বজনকে। পাত্রের তলানিতে এসে রয়ে গিয়েছে পিন্টু আর তদীয় পিতা হরিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। হরিশঙ্কর একজন ম্যান অফ ওয়ার্ড। কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী মানুষ। কর্মফল ছাড়া আর কিছুই বিশ্বাস করেন না, এমনকি ঈশ্বরকে ও নন। অন্যদিকে, পিন্টুর মাতামহ রাজনারায়ন মুখোপাধ্যায় একজন কঠোর ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ। ভাগ্যের লিখনের উপর সবকিছু সঁপে দিয়ে চলতে চান।
এই দুইয়ের মাঝে পড়ে স্যান্ডউইচের দশা পিন্টুর। পিতার কঠোর অনুশাসন তার মাঝে তৈরী করে প্রবল সংসারবিরাগ। সে সন্ন্যাসী হতে উদ্বুদ্ধ হয়। অন্যদিকে, উঠতি বয়সের টান তাঁকে জাগতিক লোভ-লালসার দিকে, রিপু তাড়নার দিকে টেনে নিতে চায়। তারই পথ ধরে তার জীবনে একের পর এক আসে ছায়া, মায়া, কণক, উষা, অপর্ণা, সুরঞ্জনা, মুকুলিকা সহ আরো অর্ধডজন নারী চরিত্র। কারো সাথে তার এক পলকের সম্পর্ক আর কারো সাথে সারা জীবনের। স্বভাবজাত ভীতু প্রকৃতির পিন্টু চায় বন্ধু দীনুর মত ডাকাবুকো হতে কিংবা সুখেনের মত পাড়া কাঁপানো প্রেমিক হতে, কিন্তু পারে না। মনের একাংশ চায় সাধু সংসর্গে থাকতে আর অদৃষ্ট বারে বারে তাকে সরিয়ে নিয়ে যায় আরো দূরে। এ যেন পিন্টুর ভেতর দিয়ে ঐ বয়সের আমার নিজের মনস্তত্ত্বকেই তুলে ধরা হচ্ছে।
এর মাঝেই আছেন মাতুল জয়নারায়ন মুখোপাধ্যায়। অসাধারণ প্রতিভাধর সংগীতজ্ঞ। সংসারে থেকে ও সংসারবিরাগী মানুষ। ভীষন আবেগী। ভাগ্নেকে প্রতি মূহুর্তে সংগীতের মাঝে ডুবিয়ে দিতে চান। কণ্ঠের অক্ষমতায় পিণ্টু সেটিও ঠিকমত পারেনা। এমনি করেই নানান ঘাত-প্রতিঘাতে এগিয়ে যায় জীবন। ভাল-মন্দে নানামুখী অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয় পিন্টুর জীবন। অবশেষে, মুকুলিকাই (মুকু) হয়ে ওঠে তার ঠিকানা। মুকুর মাঝেই সে খুঁজে পায় জীবনের আস্বাদ। সংসার বিরাগী মন নিয়েই শুরু হয় তার গৃহী জীবন।
এই সাধারণ একটা গল্পই লেখকের বর্ণনাগুণে, তাঁর স্বভাবসুলভ হাস্যরসের মিশ্রনে তীব্র শ্লেষ আর ব্যঙ্গ ঢেলে হয়ে ওঠে অসাধারণ। এখানে তিনি জীবনদর্শণের গল্প বলেছেন। মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বনের কথা বলেছেন। বলেছেন সমাজচেতনার কথা। তুলে এনেছেন সমাজের ভালোমন্দ সকল শ্রেনীর মানুষের কথা। ভালোর মাঝে মন্দ দিক কিংবা খারাপের মাঝে ভালো দিক তুলে ধরতেও কার্পণ্য করেন নি। আরো বলেছেন নৈতিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তা; পাতায় পাতায় দিয়েছেন কবি-সাহিত্যিকদের উদ্ধৃতি। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কথায় কথায় টেনে আনছে প্রবাদ-উদ্ধৃতি-গল্প। এ যেন এক উপন্যাসের ভেতরে ছোট ছোট অনেকগুলো গল্প। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো এতোকিছুর পরেও একে অতীব জ্ঞানের কচকচানি মনে হয় না। অদ্ভুত এক আবেশ জড়িয়ে থাকে।
এসব কিছুর মাঝে ও একটু খটকা রয়ে যায়। লেখকের অদৃষ্টবাদী চিন্তা-চেতনার প্রভাব খুব বেশী চোখে পড়েছে, বিশেষ করে দ্বিতীয় খন্ডে। কাহিনীর বিস্তৃতিকে একটু ছড়িয়ে দিয়ে হুট করে গুটিয়ে এনেছেন তিনি এ খন্ডে। এছাড়া ছোটদাদুর চরিত্রটিকে ও বেশ আরোপিত মনে হয়। এ ছোট্ট চরিত্র হরিশঙ্কর আর পিন্টুর চরিত্রের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে শেষ পর্যন্ত।
যাই হোক, সব কিছুর পরেও বাঙলা ভাষায় এটি একটি অবশ্যপাঠ্য উপন্যাস। চাঁদের ও তো কলঙ্ক আছে, সে কলঙ্ক কি চাঁদের সৌন্দর্য্যকে আটকে রাখতে পেরেছে? যিনি এখনো পড়েন নি, তিনি জানতেই পারেন নি যে, তিনি কী মিস করে চলেছেন। পড়ে ফেলবেন আশা করি।
শেষ কথাঃ গত সপ্তাহে ব্লগের পুরনো পোষ্ট ঘাঁটতে গিয়ে সনামধন্য ব্লগার জটিলের এই পোষ্টটি পড়েই লোটাকম্বলের কথা মনে পড়ে গেলো। গত কয়েকদিনে আবার গোগ্রাসে গিলেছি ঐ দুই খন্ড। জটিলকে ধন্যবাদ।
বইটি হতে আমার প্রিয় কয়েকটা উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি-
১."কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে
তাহাতে নাহিক দুখ,
তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার
গলায় পরিতে সুখ।"- চন্ডীদাস।
২."There are only three things to be done with a woman. You can love her, suffer for her, or turn her into literature"-. Lawrence Durell
৩."নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায়না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।"- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪. "There is an eye that never sleeps
Beneath the wing of night;
There is an ear that never shuts
When sink the beams of light."- James C. Wallace
৫. "Every man is a volume, if you know how to read him."- William Ellery Channing
জীবনে যা পড়েছি-১ (ভিক্টর হুগোর "লা মিজারেবল")
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০০৯ রাত ১:৫১