বাংলা চলচ্চিত্র
বাংলা চলচ্চিত্র যত আধুনিক হয়েছে তত মানুষের ভালবাসা হারিয়ে ফেলেছে । এখন আর আগের মত মন থেকে ভালবেসে কেউ ছবি দেখেনা । এখনকার ছবি মানুষের আবেগ স্পর্শ করতে পারেনা । মানসম্পন্ন ছবি তৈরি হয়না বলে ই আজ ক্রমে ক্রমে বাংলা চলচ্চিত্র দর্শক হারাচ্ছে । যদিও ওপার বাংলা কিছু মানসম্পন্ন ছবি তৈরি করেছে , এমনকি বাংলাদেশে ও কিছু মানসম্পন্ন ছবি তৈরি হয়েছে তবে এর সংখ্যা খুব ই কম । আমরা বেশিরভাগ ই ছবির মানের দিকে নজর না দিয়ে বাজেটের দিকে নজর দেই , যা আমাদের ছবিকে মানসম্পন্ন ছবি থেকে বিরত রাখে । বাংলা চলচ্চিত্রের উৎপত্তিঃবাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় কলকাতার ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানির উদ্যোগে ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল বাকেরগঞ্জ জেলার ভোলা মহকুমার (অধুনা ভোলা জেলা) এসডিওর (অধুনা ডিসি) বাংলোতে। ১৭ এপ্রিল বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় ঢাকায় পাটুয়াটুলীর ক্রাউন থিয়েটারে। ক্রাউন থিয়েটারের অস্তিত্ব এখন আর নেই। এই বায়োস্কোপের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্র ছিল। গবেষক অনুপম হায়াতের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, এই সব চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল মহারানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি মিছিল, গ্রিস ও তুরস্কের যুদ্ধ, তিনশত ফুট উঁচু থেকে প্রিন্সেস ডায়ানার লাফ, রাশিয়ার সম্রাট জারের অভিষেক, পাগলা নাপিতের ক্ষৌরকর্ম, সিংহ ও মাহুতের খেলা, ইংল্যান্ডের তুষারপাতে ক্রীড়া, ফ্রান্সের রাস্তাঘাট ও পাতাল রেলপথ ইত্যাদি। তখনও বায়োস্কোপের মাধ্যমে এই চলচ্চিত্র দেখার জন্য সাধারণ দর্শকের টিকেটের ব্যবস্থা ছিল। টিকেটের দাম ছিল আট আনা থেকে তিন টাকা।[৪]
বাংলাদেশের ঢাকার পাটুয়াটুলী ছাড়াও জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), ভিক্টোরিয়া পার্ক (বাহাদুর শাহ পার্ক), আহসান মঞ্জিল এবং ঢাকার বাইরে তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহকুমার (অধুনা জেলা) বগজুরি গ্রামে, জয়দেবপুরে (অধুনা গাজীপুর জেলা) ভাওয়াল এস্টেটের রাজপ্রাসাদে, ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার (অধুনা শরিয়তপুর জেলা) পালং-এ বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। রাজশাহী শহরের বোয়ালিয়া জমিদার শরৎকুমার রায়ের বাড়িতে বায়োস্কোপ দেখানো হয় ১৯০০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে কয়েক দিন ধরে। স্থানভেদে টিকেটের দামের তারতম্য ছিল। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকায় এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঢাকার আরমানিটোলার পাটের গুদাম থেকে নিয়মিতভাবে বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর গৌরবের অভিযাত্রা সূচিত হয় ১৯১৩-১৪ সালে। পরে এখানেই নির্মিত হয় ঢাকায় বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল পিকচার হাউজ, যা পরে শাবিস্তান হল নামে রূপান্তরিত হয়।[৪]
কলকাতায় যে বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠিত হয়, তার মূল ভূমিকায় বাঙালিরা ছিল না। ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার (অধুনা জেলা) বগজুরী গ্রামের হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭) দ্য রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনী শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে সালে প্রতিষ্ঠিত এই দ্য রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানিই বাঙালির প্রথম চলচ্চিত্র-প্রচেষ্টা। অবিভক্ত বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও হীরালাল সেনের নাম স্বীকৃত। বিভিন্ন স্থানে অভিনীত নাটকের খণ্ডিত অংশের চিত্রায়ণ করে ১৯০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ক্ল্যাসিক থিয়েটারে প্রদর্শন করেন। সেই সময়ের সীতারাম, আলীবাবা, দোললীলা, ভ্রমর, হরিরাজ বুদ্ধ প্রভৃতি জনপ্রিয় নাটক পরিবেশনার গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ বিশেষ অংশ ক্যামেরায় ধারণ ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রদর্শন করে তিনি বাঙালির চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রবল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেন। প্রামাণ্যচিত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র এবং সংবাদচিত্র নির্মাণের পথিকৃৎ হিসেবেও হীরালাল সেন নমস্য ব্যক্তিত্ব। উপমহাদেশে প্রথম পুরনাঙ্গ চলচ্চিত্র ঃ দাদাসাহেব ঢুণ্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে হলেন উপমহাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের নির্মাতা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি দাদাসাহেব ফালকে নামেই বেশি পরিচিত। ১৯১৩ সালে তাঁর নির্বাক চিত্র রাজা হরিশ্চন্দ্র মুক্তি পায়। ১৯১৬ সালে কলকাতায় ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির পক্ষ থেকে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত প্রথম বাংলা নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিল্বমঙ্গল মুক্তি পায়। ১৯১৯ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রের পরিচালকের নাম নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কোনও কোনও গবেষক এই চলচ্চিত্রের পরিচালক হিসেবে মতান্তরে রোস্তমজি দুতিওয়ালার নাম উল্লেখ করেন। পরিচালকের ভূমিকায় যে-ই থাক, এই চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নওয়াব এস্টেটের ম্যানেজারের পুত্র প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি পরে চলচ্চিত্রের প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯২১ সালে কলকাতায় বিলাত ফেরৎ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর প্রযোজক ও অভিনেতা ছিলেন বাংলাদেশের বরিশাল জেলার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
মুসলিম পরিচালক নির্মিত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ঃদুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬), পরিচালকঃ বিশিষ্ট সাংবাদিক ওবায়েদুল হক ।কলকাতায় চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশী কোনও মুসলিম পরিচালকের হাতে নির্মিত এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র।উদয়ন চৌধুরী ছদ্মনামে ইসমাইল মোহাম্মদ নির্মাণ করেন মানুষের ভগবান (১৯৪৭) চলচ্চিত্রটিও। দেশভাগের পরে এঁরা ঢাকায় ফিরে আসেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ সৃষ্টি করেন। ঢাকায় বাংলা চলচ্চিত্রঃ ১৯২৭-২৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ সংস্কৃতিসেবী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সুকুমারী। এর পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ক্রীড়াশিক্ষক অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুস সোবহান। উল্লেখ্য তখন নারীদের অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়নি। নাট্যমঞ্চের নারীচরিত্রেও পুরুষেরাই অভিনয় করতেন।
নওয়াব পরিবারের উদ্যোগে ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়। এর প্রযোজনায় অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত নির্মাণ করেন নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস। খাজা আজমল, খাজা আদিল, খাজা আকমল, খাজা শাহেদ, খাজা নসরুল্লাহ, শৈলেন রায় বা টোনা বাবু ছিলেন এই চলচ্চিত্রের অভিনেতা। তবে এতে নারীচরিত্রে নারীরাই অংশ নেয়। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন লোলিটা বা বুড়ি নামের এক বাইজী। চারুবালা, দেববালা বা দেবী নামের আরও দুই বাইজী এতে অভিনয় করেন। হরিমতি নামে একজন অভিনেত্রীও এতে অভিনয় করেন। ১৯৩১ সালে এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল হলে (অধুনা আজাদ হল)। এর প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০)। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৩৬-১৯৪২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ওবায়েদ-উল হক দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন হিমাদ্রী চৌধুরী ছদ্মনামে। কলকাতায় চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশী কোনও মুসলিম পরিচালকের হাতে নির্মিত এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। উদয়ন চৌধুরী ছদ্মনামে ইসমাইল মোহাম্মদ নির্মাণ করেন মানুষের ভগবান (১৯৪৭) চলচ্চিত্রটিও। দেশভাগের পরে এঁরা ঢাকায় ফিরে আসেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ সৃষ্টি করেন। রাজধানী ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রযোজনা-পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান এবং স্টুডিও নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে নাজীর আহমদ (১৯২৫-১৯৯০) ইন আওয়ার মিডস্ট নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যা বাংলাদেশ-ভূখণ্ডের প্রথম তথ্যচিত্র হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরের বছর বছর সরকারি প্রচারচিত্র নির্মাণের জন্য জনসংযোগ বিভাগের অধীনে চলচ্চিত্র ইউনিট (১৯৫৩) গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে এখান থেকে নাজীর আহমদের পরিচালনায় নির্মিত হয় প্রামাণ্য চিত্র সালামত।
নাজীর আহমদ একাধারে অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বেতারকর্মী ও লেখক। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি শিল্পী হামিদুর রহমান ছিলেন তাঁর সহোদর। ১৯৫৫ সালে নাজীর আহমদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ল্যাবরেটরি এবং স্টুডিও চালু হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রথম নির্বাহী পরিচালক হন। তাঁর কাহিনী থেকে ফতেহ লোহানী নির্মাণ করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র আসিয়া (১৯৬০)। নবারুণ (১৯৬০) নামের একটি প্রামাণ্য চিত্র। নতুন দিগন্ত নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন নাজীর আহমদ।[৪]
১৯৫৪ সালে গঠিত হয় ইকবাল ফিল্মস এবং কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেড। ইকবাল ফিল্মস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ মোদাব্বের, মহিউদ্দিন, শহীদুল আলম, আবদুল জব্বার খান, কাজী নুরুজ্জামান প্রমুখ। ড. আবদুস সাদেক, দলিল আহমদ, আজিজুল হক, দুদু মিয়া, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী খালেক, সারওয়ার হোসেন প্রমুখ ছিলেন কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেডের সঙ্গে। দলিল আহমেদের পুত্র বুলবুল আহমেদ এবং দুদু মিয়ার পুত্র আলমগীর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
১৯৫৪ সালে ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে এই ভূখণ্ডের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর কাজ শুরু করেন আবদুল জব্বার খান। কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্সের ব্যানারে স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্রের আপ্যায়ন-এর কাজ শুরু করেন সারোয়ার হোসেন। ১৯৫৫ সালে জুন মাসে তেজগাঁওয়ে সরকারি ফিল্ম স্টুডিও চালু হয়।
১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি পায়। পরিচালক নিজেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক কিউ.এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু, পরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি) উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। ১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ সালে এদেশে কোনও চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। এফডিসি ছাড়াও পপুলার স্টুডিও, বারী স্টুডিও এবং বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিস্ফুটনে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক যোগ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি, মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড়, এহতেশামের এদেশ তোমার আমার এই তিনটি বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও এ.জে. কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরুর দশকে নির্মিত ৫টি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্পমানে উত্তীর্ণ বলেই চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করেন। অর্থাৎ আমাদের চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শুদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়েই। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। বেবী ইসলামের তানহাও উর্দু ভাষার নির্মিত। এটি ১৯৬০ সালে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় কিন্তু মুক্তি পায় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে।
বাংলাদেশের পূর্বপাকিস্তান পর্বে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শুরু হয়েছে ডাকাতের কাহিনী নিয়ে। আবদুল জব্বার খান রচিত নাটক ডাকাত-এর চিত্রায়নই মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬)। এই চলচ্চিত্রে পেশাদারিত্বের ছাপ থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে এর গুরুত্ব রয়েছে। গ্রামের এক জোতদার বাবার এক সন্তান ঘটনা-পরম্পায় ডাকাতদলের খপ্পরে পড়ে তাদের মতো বেড়ে ওঠে। আরেক ছেলে পড়ালেখা করে পুলিশ হয়। কিন্তু ডাকাতদলের সঙ্গে পুলিশের সখ্য ছিল। ভাই-ভাই পরিচয় না জানলেও ডাকাত-পুলিশ সম্পর্ক ছিল। এক পর্যায়ে ডাকাত ছেলে তার সর্দারকে খুন করে। গ্রেফতার হয় অসৎ পুলিশ। কাহিনীর পরিণতি বাবার কাছে দুই ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে। আবদুল জব্বার খান (১৯১৬-১৯৯৩) জোয়ার এলো (১৯৬২), নাচঘর (উর্দু ১৯৬৩), বাঁশরী (১৯৬৮), কাচ কাটা হীরা (১৯৭০) ও খেলারাম (১৯৭৩) নির্মাণ করে চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁর অবদানের স্বাক্ষর রাখেন। উজালা নামে একটি চলচ্চিত্রও তিনি প্রযোজনা করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান হিসেবে আবদুল জব্বার খান কাজ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনি বাচসাস পুরস্কার, এফডিসি রজত জয়ন্তী পদক, উত্তরণ পদক, হীরালাল সেন স্মৃতি পদক, বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সম্মান পদক, ফিল্ম আর্কাইভ সম্মান প্রতীক ও রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি সম্মান পদক লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃৎ। তাঁর সম্মানার্থে এফডিসি-তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আবদুল জব্বার খান পাঠাগার।
১৯৫৯ সালে আখতার জং কারদার পরিচালিত উর্দুচলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরপদ্মানদীর মাঝির কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পুরস্কৃত ও আলোচিত হলেও বাণিজ্যিকভাবে এটি সাফল্য অর্জন করেনি। এই চলচ্চিত্রের প্রধান সহাকারী হিসেবে কাজ করেন জহির রায়হান। একই বছরে এহতেশাম নির্মাণ করেন গ্রামীণ পটভূমিতে এ দেশ তোমার আমার। ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি এবং মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড় — এই বছরের অন্যদুটি চলচ্চিত্র। কারিগরি মানের দিক থেকে চলচ্চিত্রদুটি ভালো হলেও বোম্বে ও লাহোরের চলচ্চিত্রের সঙ্গে লড়াই করে টিকতে পারেনি। ফতেহ লোহানীর আসিয়া (১৯৬০) এবং এহতেশামের রাজধানীর বুকে (১৯৬০) পঞ্চাশের দশকের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র।রাজধানীর বুকে চলচ্চিত্রটি বেশ জনপ্রিয় হয়। আসিয়া বাবসায়িক সাফল্য না-পেলেও এটি প্রেসিডেন্ট পুরস্কারও নিগার পুরস্কার লাভ করে। গ্রামবাংলার চিরায়ত দৃশ্য নিয়ে জীবনধর্মী এই চলচ্চিত্রটি বোদ্ধা মহলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। কেউ কেউ একে পথের পাঁচালীর অনুকরণ বলে অভিহিত করে। ফতেহ লোহানী (১৯২০-১৯৭৫) বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অগ্রণী অভিনেতা ও চিত্রপরিচালক। চলচ্চিত্রকার বিমল রায়ের হিন্দি চলচ্চিত্র হামরাহী (১৯৪৫)-তে অভিনয়ে করেন কিরণকুমার ছদ্মনামে। তিনি অভিনয় করেন রঙিলা আর্ট করপোরেশন প্রযোজিত উদয়ন চৌধুরী (ইসমাইল মোহাম্মদ) পরিচালিত জোয়ার নাটকে এবং হিমাদ্রি চৌধুরী (ওবায়েদ-উল হক) পরিচালিত দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) চলচ্চিত্রে। ঢাকা থেকে ১৯৪৯-এ মাসিক সাহিত্য পত্রিকা অগত্যা প্রকাশে তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। ঐ বছরই তিনি যোগ দেন করাচি বেতারে, পরে বিবিসি-তে। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় ফিরে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত হন, পাশাপাশি বেতার অনুষ্ঠান, অভিনয় এবং লেখালেখিতেও অংশ নেন। পরিচালনা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র রাজা এলো শহরে (১৯৬৪)। ফতেহ লোহানী অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে মুক্তির বন্ধন (১৯৪৭), তানহা (১৯৬৪), বেহুলা (১৯৬৬), ফির মিলেন্দে হাম দোনো (১৯৬৬), আগুন নিয়ে খেলা (১৯৬৭), দরশন (১৯৬৭), জুলেখা (১৯৬৭), এতটুকু আশা (১৯৬৮)মোমের আলো (১৯৬৮), মায়ার সংসার (১৯৬৯), মিশর কুমারী (১৯৭০), তানসেন (১৯৭০) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ষাটের দশকে সালাহ্উদ্দিনের যে নদী মরূপথে (১৯৬১), সূর্যস্নান (১৯৬২) ও ধারাপাত (১৯৬৩) প্রভৃতি সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। জহির রায়হান এই সময়ের উল্লেখযোগ্য পরিচালক। তাঁর যে নদী মরুপথে ও কখনো আসেনি(১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২, কলিম শরাফী সহযোগে), কাচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (উর্দু ১৯৬৪), বাহানা (উর্দু, ১৯৬৫) এই সময়ের উজ্জ্বল সৃষ্টি। উর্দু চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকেও তিনি আবার চোখ ফেরালেন লোকজ কাহিনীর দিকে। এরপর তিনি আনোয়ারা (১৯৬৭) নির্মাণ করেন। জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), লেট দেয়ার বি লাইট (১৯৭০) (অসমাপ্ত), স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১) ও এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) চলচ্চিত্র গুলো ছিল বহিরবিশ্বের চলচ্চিতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মত।
ষাটের দশকেই কীর্তিমান পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন খান আতাউর রহমান (১৯২৯-১৯৯৭)। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কেবল পরিচালক নন, অভিনেতা, কাহিনীকার, কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে খ্যাতিমান।১৯৫৬ সালে ঢাকায় ফিরে এ.জে কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে প্রধান চরিত্রে রূপদান করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি অনেক দিনের চেনা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক হিসেব আবির্ভূত হন। তাঁর পরিচালিত রাজ সন্ন্যাসী, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী, দিন যায় কথা থাকে, ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), এখনও অনেক রাত প্রভৃতি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃত-স্বরূপ তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও পাকিস্তান, মস্কো এবং তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার লাভ করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী চলচ্চিত্র
স্বাধীনতার পরে আবির্ভূত চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে আলমগীর কবির (১৯৩৮-১৯৮৯) উল্লেখযোগ্য। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র হলো ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্য কন্যা (১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২),পরিণীতা (১৯৮৪) ও মহানায়ক (১৯৮৫)।
স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে এদেশে ৮টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর মধ্যে নজরুল ইসলামের স্বরলিপি, অশোক ঘোষের নাচের পুতুল, আলমগীর কুমকুমের স্মৃতিটুকু থাক এবং খান আতাউর রহমানের সুখ দুঃখ সামাজিক চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৭২ সালে আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা, জহিরুল হকের রংবাজ, সুভাষ দত্তের বলাকা মন, ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশেষ মানে উন্নীত করে। এই সুস্থ ও সৃজনশীল ধারায় ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয় নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল। ১৯৭৫ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার লাঠিয়াল, খান আতার সুজন সখী এই ধারারই প্রবাহ। ১৯৭৬ সালে ছয়টি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ধারণাকেই পাল্টে দেয়। যেমন রাজেন তরফদারের পালঙ্ক, হারুনর রশীদের মেঘের অনেক রঙ, আলমগীর কবিরের সূর্য কন্যা, কবীর আনোয়ারের সুপ্রভাত, আবদুস সামাদের সূর্যগ্রহণ এবং আমজাদ হোসেনের নয়নমনি। ১৯৭৭ সালে আলমগীর কবিরের সীমানা পেরিয়ে, সুভাষ দত্তের বসুন্ধরা পরিচ্ছন্নতা ও সুস্থতার দাবিদার। ১৯৭৮ সালে আমজাদ হোসেনের গোলাপী এখন ট্রেনে এবং আবদুল্লাহ আল মামুনের সারেং বৌ শিল্পসফল চলচ্চিত্র হিসেবে নন্দিত। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে। মসিউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর যৌথ নির্মাণ সূর্য দীঘল বাড়ি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দেয়। আলমগীর কবিরের রূপালী সৈকতেও এই সময়ের উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্র। সত্তর দশক ও আশির শুরুতে সময়ে নির্মিত চলচ্চিত্র জহিরুল হকের রংবাজ (১৯৭৬), প্রাণসজনী (১৯৮২), রুহুল আমিনের বেইমান (১৯৭৪), অশোক ঘোষের নাচের পুতুল (১৯৭১), সিবি জামানের শুভরাত্রি (১৯৮৫), বেবী ইসলামের চরিত্রহীন (১৯৭৫), নজরুল ইসলামের স্বরলিপি (১৯৭১), আবদুল রতিফ বাচ্চুর যাদুর বাঁশি (১৯৭৭), আবদুল্লাহ আল মামুনের সখি তুমি কার (১৯৮০), এখনই সময় (১৯৮০), সৈয়দ হাসান ইমামের লাল সবুজের পালা (১৯৮০) প্রভৃতি । ১৯৮০ সালে আমজাদ হোসেনের কসাই, দিলীপ সোমের স্মৃতি তুমি বেদনা দর্শকপ্রিয়তা লাভ করতে সমর্থ হয়।
১৯৮১ সালে আমজাদ হোসেনের জন্ম থেকে জ্বলছি চলচ্চিত্রের সুস্থ মেজাজ বজায় রাখে। ১৯৮২ সালে চাষী নজরুল ইসলামের দেবদাস, মোস্তফা আনোয়ারের কাজল লতা, আবদুস সামাদ খোকনের বড় বাড়ির মেয়ে, মতিন রহমানের লাল কাজল, আলমগীর কবিরের মোহনা সকল অর্থে সুস্থধারার সামাজিক চলচ্চিত্র। ১৯৮৩ সালে সিবি জামানের পুরস্কার ও এজে মিন্টুর মান সম্মান, সুভাষ দত্তের নাজমা চলচ্চিত্র চলনসই।
১৯৮৪ সালে আখতারুজ্জামানের প্রিন্সেস টিনা খান, কাজী কাজী হায়াৎ-এর রাজবাড়ি, কামাল আহমেদের গৃহলক্ষ্মী, সুভাষ দত্তের সকাল সন্ধ্যা, চাষী নজরুল ইসলামের চন্দ্রনাথ, আমজাদ হোসেনের সখিনার যুদ্ধ ও ভাত দে। ১৯৮৫ সালে শক্তি সামন্ত ও সৈয়দ হাসান ইমামের অবিচার, শেখ নিয়ামত আলীর দহন, রাজ্জাকের সৎভাই ও শহিদুল আমিনের রামের সুমতি দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। আশির দশকের শেষার্ধে সুভাষ দত্তের ফুলশয্যা (১৯৮৬), আলমগীর কবিরের পরিণীতা (১৯৮৬), চাষী নজরুল ইসলামের শুভদা, বুলবুল আহমেদের রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৮৭), নারায়ণ ঘোষ মিতার হারানো সুর (১৯৮৭), আফতাব খান টুলুর দায়ী কে (১৯৮৭), কবীর আনোয়ারের তোলপাড় (১৯৮৮), মহিউদ্দিন ফারুকের বিরাজবৌ (১৯৮৮) এবং নব্বই দশকের প্রথমার্ধে সৈয়দ সালাহ্উদ্দিন জাকীর আয়না বিবির পালা (১৯৯১), এহতেশামের চাঁদনী(১৯৯১) প্রভৃতি চলচ্চিত্র আলোচিত হয়েছে।
চাষী নজরুল ইসলামের হাসন রাজা, তানভীর মোকাম্মেলের লালন (২০০৪), মোরশেদুল ইসলামের দুখাই, লালসালু, আখতারুজ্জামানের পোকামাকড়ের ঘরবসতি, তারেক মাসুদের মাটির ময়না (২০০২), কাজী মোরশেদের ঘানি (২০০৮) উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সামজিক বিষয়কে অবলম্বন করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ-কুশলতায় বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০০৩ সালে তারেক মাসুদ পরিচালিত মাটির ময়না ছবিটি সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কারে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য পেশ করা হয়। চূড়ান্ত পুরস্কারের জন্য মনোনীত না হলেও এটি বেশ গুরুত্ববহ ছিল। কারণ এটিই প্রথম বাংলাদেশী ছবি যা অস্কারে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রেরণ করা হয়। এরপর দুই বছর কোন বাংলাদেশী ছবি অস্কারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে একটি চলচ্চিত্র অস্কারের জন্য পেশ করা হচ্ছে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত পেশ করা সিনেমা তিনটি হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া, আবু সাইয়িদের নিরন্তর এবং গোলাম রাব্বানী বিপ্লবের স্বপ্নডানায়। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত ছবির মধ্যে রয়েছে নাসিরুদ্দিন ইউসুফের গেরিলা, মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর টেলিভিশন, অমিত আশরাফের উধাও এবং দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত ছবি রুবাইয়াত হোসেনের মেহেরজান।
ঢাকার চলচ্চিত্রের মন্দা অবস্থা (২০১১)
ঢাকার চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য গত ৩০ বছরের মধ্যে ২০১১ সালটা ছিল সবচেয়ে মন্দার বছর। এ বছর ১০টি সেরা ব্যবসাসফল ছবিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ৪৭টি বাংলা এবং একটি ভারতীয় ছবি মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছে। কয়েকটি ছবি মোটামুটিভাবে সফল হয়েছে। বেশির ভাগ ছবিই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। যে পাঁচটি ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছে, সেগুলো হলো—তোর কারণে বেঁচে আছি, মাটির ঠিকানা, মনের জ্বালা, টাইগার নাম্বার ওয়ান ও প্রিয়া আমার জান। অন্যদিকে মোটামুটিভাবে ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছে যে ছবিগুলো, তার মধ্যে আছে—বস নাম্বার ওয়ান, এক টাকার ছেলে কোটি টাকার মেয়ে, হৃদয় ভাঙা ঢেউ, জান কোরবান।
ছবি মুক্তির সংখ্যা কমেছে
কাগজে-কলমে একটি ভারতীয় বাংলা ছবিসহ আছে ৪৮টি ছবি। আসলে সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে এমন ছবির সংখ্যা ৩৪টি। গত ৩০ বছরে এত কমসংখ্যক ছবি মুক্তি পায়নি। চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা যদিও দাবি করেছেন, আগামী বছর ছবি মুক্তির সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু নির্মাণাধীন ছবির যে সংখ্যা রয়েছে, তাতে আগামী বছরে ২৫টির বেশি ছবি মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। ছবি মুক্তি কম হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, নির্ভরযোগ্য শিল্পীর সংকটে ছিলেন প্রযোজকেরা। ফলে ছবি কম নির্মিত হয়েছে, তাই ছবি বেশি মুক্তি পায়নি।
আলোচিত কয়েকজন শিল্পী
গত তিন বছরের মতো ২০১১ সালেও চলচ্চিত্রশিল্প ছিল শাকিব খাননির্ভর। ২০১১ সালে শাকিব অভিনীত মোট ১৩টি ছবি মুক্তি পায়। এর মধ্যে সুপারহিট ছিল তোর কারণে বেঁচে আছি, মাটির ঠিকানা, মনের জ্বালা, টাইগার নাম্বার ওয়ান ও প্রিয়া আমার জান ছবিগুলো। তবে শাকিবের অন্য ছবিগুলো ব্যবসা করতে পারেনি। নায়িকাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছবি মুক্তি পেয়েছে অপু বিশ্বাসের। মোট ১১টি ছবির মধ্যে ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে তোর কারণে বেঁচে আছি, মনের জ্বালা ও প্রিয়া আমার জান। মারুফের ব্যস্ততাও ছিল চোখে পড়ার মতো। এ বছর তাঁর ব্যবসাসফল ছবি ছিল এক টাকার ছেলে কোটি টাকার মেয়ে। অপুর পরই নায়িকাদের মধ্যে যাঁর নাম সবার আগে উঠে এসেছিল, তিনি সাহারা। বছরের অন্যতম সেরা ব্যবসাসফল ছবি টাইগার নাম্বার ওয়ান-এ অভিনয় করেছিলেন তিনি। ইমন ব্যস্ত ছিলেন চলচ্চিত্র নিয়েই। এ বছর ইমনের ছবিগুলোর মধ্যেগার্মেন্টস কন্যা আলোচিত ছবি হিসেবেই উঠে আসে। ২০১১ সালটা নিপুণেরও কেটেছে ভালোভাবেই। বছরের সেরা ব্যবসাসফল ছবি ও মোটামুটিভাবে সফল দুটি ছবি টাইগার নাম্বার ওয়ান ও বস নাম্বার ওয়ান দিয়ে নিপুণ সেরা নায়িকাদের দৌড়ে টিকে যান ভালোভাবেই। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মডেলিংয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিরব। ২০১১ সালেই তিনি হাতে পেয়েছেন চারটি ছবি। নতুনদের মধ্যে নিরব নির্মাতাদের দৃষ্টিও কেড়েছেন সফলভাবে। পূর্ণিমা বছরের শুরুতে ভালোভাবেই ব্যস্ত সময় পার করেছিলেন। বছরের দ্বিতীয় সেরা ব্যবসাসফল ছবি মাটির ঠিকানা উপহার দেন তিনি। এরপর ইমপ্রেস টেলিফিল্মসের তিনটি ছবি একসঙ্গে হাতে নিয়ে বেশ আলোচনায় ছিলেন। এর বাইরে ২০১১ সালের সর্বাধিক ছবির অভিনেতা ছিলেন মিশা সওদাগর। ২০১১ সালেই তিনি প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছেন ও এ বছর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন । কথা বলছিলাম আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে । আমরা অনেক ভালমানের ছবি পেয়েছি । জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া , তারেক মাসুদের মাটির ময়না , হুমায়ান আহমেদ এর শ্যামল ছায়া, তউকির আহমেদ এর অজ্ঞাতন্নামা, অমিতাভ রেজা চৌ ধ রির আয়নাবাজি , সহ আরও অনেক। তবে ে ধারা কে ধরে রাখতে ভালমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ এ পরিচালকদের উদ্যোগী হতে হবে । বাজেত নয় ছবির মান নিয়ে কাজ করতে হবে । তবে ই আমরা চলচ্চিত্রে সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারব ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৭ সকাল ১১:০২