"আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক।কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক: ’তোমার চোখ এত লাল কেন?’ "
আপনি যদি এই লেখাটি পড়া শুরু করে থাকেন, তাহলে আপনি নিশ্চিত বুঝে গেছেন 'আমার ছেলেবেলা' বইটি কার লেখা। চেনা বামুনের যেমন পৈতা লাগেনা, তেমনি নাম উল্লেখ না করে সিরফ উপরের লাইন ক'খানা দিয়েই বইটির লেখকের পরিচয় দিয়ে দেওয়া যায়।
নির্মলেন্দু গুণ।
পূর্ব-বাংলার জনপ্রিয় কবি।
আধুনিক, সমসাময়িক কবিতার জন্য গুণ খ্যাতিমান হলেও উনার গদ্যসাহিত্য লেখার হাতও যে বেশ ভালো, তার চমৎকার উদাহরণ 'আমার ছেলেবেলা' বইটি।
বয়স যখন চল্লিশের দশকে, অর্থাৎ যুবাবস্থায়-ই গুণ লিখেছেন তার প্রথম আত্মজীবনী। স্বভাবতই গুণের পুরো জীবনকে এই বইয়ে এক মলাটে পাওয়া যাবেনা, তবে তার শিকড়ের সন্ধান আছে এখানে। গুণ কেন কবি হলেন,শখের বশে হলেও ছবি আকার তাগিদ কোথায় পেলেন, সেসমস্ত কথা এই বইয়ে বারবার উঠে এসেছে প্রত্যক্ষ -পরোক্ষভাবে।
এই বইয়ের ভূমিকায় গুণ ম্যাক্সিম গোর্কীর কথা বলেছেন, গোর্কীর প্রথম জীবনের দুর্দশার সাথে নিজের কিছুটা সাদৃশ্য দেখেছেন। ফলে বইটার শুরু-ই হয়েছে গুণের মাকে হারানো আর প্রথম জীবনের দারিদ্র্যের কথা দিয়ে। গ্রামীন পূর্ব-বাংলায় দারিদ্র্যর সাথে সহবাস করেই জীবনকে উপভোগের কথা আছে, আছে পরিবারের মধ্যে সংকট আর ভালোবাসার কথা। দুঃখের কথার মাঝেও লেখক রম্যের চমৎকার ছোয়া দিয়ে গেছেন পুরো বইজুড়ে। গ্রামীণ কিশোরের দৃষ্টিতে আইয়ুবশাহীর শাসনামল আর যাদু দেখাতে যেয়ে পাওয়া কর্মফলের মজার চিত্রও উঠে এসেছে গুণের লেখায়।
আমার দৃষ্টিতে 'আমার ছেলেবেলা'র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক নির্মলেন্দু গুণের অকপট সত্যবচন। বাঙালি লেখকেরা আত্মজীবনীতে অপ্রিয় বা অস্বস্তিকর সত্য কতোটা তুলে ধরেন সেটা আলোচনার বিষয়, তবে এক্ষেত্রে গুণকে পুরো নাম্বার দেওয়া যায়। বৃহত্তর পরিবারের মধ্যকার বিরোধের কথা সাবলিলভাবে লিখেছেন। স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন দাঙ্গা নয় বরং নানাবিধ প্রচার-প্রচারণা আর নিজস্বস্বার্থে তার এলাকার মানুষের দেশত্যাগের কথা।
'আমার ছেলেবেলা' আশির দশকের শেষভাগে প্রথম প্রকাশিত হয়। আর কাকলী প্রকাশনী থেকে ২০১৭ সালে সম্ভবত সর্বশেষ মুদ্রণটি ছাপা হয়েছে।
বই কখনো পুরনো হয়না, আর এরকম সুন্দর একটি লেখা সবসময়-ই নতুন থাকবে। সুতরাং এখনো যদি না পড়ে থাকেন তবে দ্রুতই পড়ে ফেলতে পারেন বইটি; নিশ্চিতভাবেই আনন্দে কিছুটা সময় কাটবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২০