আমার নানাভাই মারা গেলেন ক'দিন আগে, ছিয়াশি বছর বয়সে। ওনার ক্যান্সার হয়েছিল, প্রস্রাবের থলিতে।
প্রায় দুই বছর আগে নানাভাইয়ের প্রস্রাবের সাথে রক্ত পড়া শুরু হল। আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হলো।
ক্যান্সার!!
প্রস্রাবের থলিতে ক্যান্সার কোষ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তাজা রক্ত !!
আমরা নানাভাইকে কিছু বললাম না। " নানাভাই, সামান্য ঘা হয়েছে। কয়েকদিন বেশি করে পানি খান, ঠিক হয়ে যাবে। আর....একটা ছোট্ট অপারেশন.....ভয়ের কিছু নেই।"
নানাভাইয়ের মনে অনেক জোর। ভয় পেলেন কিনা মুখ দেখে বোঝা গেল না। ছিয়াশি বছরের জীবনে অনেক কিছুই তিনি দেখেছেন। অনেক ঝড়-ঝাপ্টা পাড়ি দিয়েছেন। তার শৈশব শুরু হয়েছিল মানিকগঞ্জের অসম্ভব সুন্দর এক গ্রামে, ইছামতী নদীর পাড়ে, সবুজ মায়াময় এক জনপদে। বাবা অধ্যাপক, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ পালোয়ানের মত এক মানুষ। মা জমিদারকন্যা !!
সেকালের কোন এক বোকা জমিদার নিজের পরমা সুন্দরী মেয়েকে এই অধ্যাপকের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। রাশি রাশি সোনাদানাও দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন, জানি না। পাত্র হিসেবে অধ্যাপকদের বাজার দর তখন হয়ত জমিদারপুত্রের চাইতেও বেশী ছিল। তবে নানাভাইয়ের বাবা সে সবই বিলিয়ে দিলেন...স্কুল করলেন,দাতব্য করলেন, শেষের দিকে গ্রামে চেয়ারম্যান ছিলেন অনেকদিন...
পাঁচ ভাই এক বোন, তারমধ্যে সবচেয়ে ছোট আমার নানাভাই। এই দীর্ঘ জীবনে মৃত্যু তার পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে বারবার। অনেক মৃত্যু দেখেছেন তিনি। তার সব ভাইবোন একে একে মারা গেছে । স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে, ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই মারা গেছে তার চোখের সামনে। সবসময়ই তিনি শান্ত। কখনও ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি।
এবারও তিনি ভেঙ্গে পড়লেন না।
অপারেশন হলো। কেমোথেরাপি দেয়া হলো। রক্ত পড়া বন্ধ হলো। নানাভাই আমাদের বাসায় কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। বাড়িতে তিনি একমাত্র ছেলের সাথে থাকেন। ছেলেটার সংসারে নানান অশান্তি। বউয়ের সাথে বনিবনা নেই। ছেলের ঘরের বড় নাতি রাতে তার সাথে শোয়। ছোটকাল থেকেই দাদার বড় ভক্ত সে। তাছাড়া তিনি একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুল চালান। সেটা নিয়েও সবসময় ব্যাস্ত থাকতে হয়। নানাভাই জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
এইসময় দুটো ঘটনা ঘটলো। আমার মামী মামাকে ডিভোর্স দিলেন এবং তার ঠিক দুইদিন পরে মামা, মানে নানাভাইয়ের একমাত্র ছেলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলেন পাঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে।
মামা অসুস্থ ছিলেন অনেকদিন যাবৎই। একটু দুর্বল চিত্তের মানুষ। মূলতঃ সাংসারিক নানা অশান্তি এবং অতিরিক্ত কাজের চাপে হঠাৎ করেই ব্রেইন স্ট্রোক করলেন। প্রায় বছর দুয়েক ঠিকমত কথা বলতে পারতেন না। অফিসে কাজ করতে পারতেন না ঠিকমত। এটা সেটা সমস্যা লেগেই থাকত। নানাভাই-ই তাকে সাথে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন। ছেলেকে এমন আলতো করে হ্যান্ডেল করতেন, যেন ছোট্ট শিশু ! আমরা মাঝে মাঝে হাসতাম।
সেই ছেলে প্রায় একমাস বাসায় থাকার পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে অফিসে জয়েন করতে যাচ্ছিলেন। নানাভাইও সাথে গেলেন যথারীতি, মামাকে পৌছে দিতে। মামা মারা গেলেন অফিসের গেটে, নানাভাইয়ের চোখের সামনে।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, এরপরও নানাভাই কেন বেঁচে ছিলেন ? কিসের আশায় বেঁচে ছিলেন ? মানুষ কেন বেঁচে থাকে ? আমাদের জন্মই বা কেন হয়, ঠিক কি উদ্দেশ্যে আমরা জীবন কাটাই, মৃত্যুই বা কেন আসে এত অনন্ত দুঃখ নিয়ে ?
মামার মৃত্যুর পরও নানাভাই ঠিক ভেঙ্গে পড়লেন না। তিনি কখানো ভেঙ্গে পড়েন না। জীবন কখনো থেমে থাকে না। নানাভাই নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত হবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না অবশ্য। আবার প্রস্রাবের সাথে রক্ত , আবার ক্যান্সার, আবার হাসপাতাল, অপারেশন, কেমোথেরাপি.....
এবারও রক্ত পড়া বন্ধ হলো। নানাভাই বাসায় ফিরলেন। প্রতিমাসে আলট্রাসনোগ্রাম করান আর ভয়ে ভয়ে থাকেন। আমি সরাসরি কিছু বলি না।" নানাভাই, আপনার বাড়িঘর সহায় সম্পত্তির একটা ব্যবস্থা করেন। সবকিছু গোছান। মামা নাই, আপনারও বয়স হচ্ছে। হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেলে...আপনার দুইটা নাতি....." নানভাই কি বুঝতে পারেন, কি বলতে চাই ? বোধহয় পারেন।
ডাক্তাররাও এবার মুখ খোলে। " চাচামিঞা, ভয়ংকর ধরনের ক্যান্সার হয়েছে আপনার। ঠিকমত চিকিৎসা করান, তাহলে যতদিন বাঁচবেন, ভালো থাকবেন।"
নানাভাইয়ের মুখের রেখার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না । একজন মানুষ যখন জেনে ফেলে তার সময় শেষ, মৃত্যু চলে এসেছে ঘরের কাছে, তখন তার কেমন লাগে ? মৃত্যুর অনুভুতিটা ঠিক কেমন ? মাঝে মাঝে আমি মৃত্যুর কথা ভাবতে চাই। কবরের মধ্যে মাটির নিচে শুয়ে আছি, এই অনুভূতিটা কেমন, বোঝার চেষ্টা করি। পারি না।
নানভাই কি মৃত্যুর কথা ভাবতেন ? সারাক্ষণ দেখতাম বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। " নানাভাই, কি কথা বলেন সারাক্ষণ ?"
" মাফ চাই, আল্লাহর কাছে মাফ চাই।"
" জীবনটা কেমন ছিল, নানাভাই ?"
" ভালোই। জীবনে সুখ যেমন ছিল, দুঃখও ছিল। " নানাভাই তার জীবন কাহিনী বলা শুরু করেন। ব্রিটিশ আমলের কথা, কোলকাতার কথা, চাকুরী জীবনের কথা। তখনকার দিনের বসদের কথা বলতে খুব পছন্দ করতেন। বসদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল সততা ও শ্রদ্ধার। অসৎ কয়েকজন বসকে কিভাবে শিক্ষা দিয়েছেন সেটাও বলতেন গর্ব করে।
জীবনের শেষ সময়ে মৃত্যুর চাইতে জীবনের কথাই বোধহয় ভাবতেন বেশী। আমি তার বিয়ের গল্পটা আম্মার কাছ থেকে শুনেছি। আমার নানি অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। আমি তাকে দেখেছি বৃদ্ধ অবস্থায়। অনেক পান খেতেন, অনেক আলাপী ছিলেন এবং গায়ের রঙ ছিল গোলাপ ফুলের মত সুন্দর।
নানাভাইও যৌবনে অসম্ভব সুপুরুষ ছিলেন। তার শ্বাশুড়ী এ কারনে তাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেন এবং মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। নানাভাইয়ের শ্বশুড় তখন বার্মায়। তিনি বিরাট কাঠের ব্যবসায়ী। মেয়ের জন্য জাহাজ ভর্তি করে সেগুন কাঠের ফার্ণিচার আর বাক্স বাক্স গয়না পাঠান। নানাভাই সেই গয়না বিক্রি করে....তার বাবার মতই..... স্কুল দেন...এই করেন, সেই করেন, এবং....ব্যবসা শুরু করেন। আমি অনেকবার শুনেছি সেই বিখ্যাত ডায়লগ, নানাভাই যেটা নানিকে বলতেন। " আমি তোমার জন্য কাঁচের বাড়ী বানিয়ে দেব !!"
কাঁচের বাড়ী অবশ্য বানানো হয়নি। গ্রামের সহজ সরল যুবক সব ব্যবসায়ই ব্যর্থ হন। চাকুরীতেও মন বসাতে পারেননি কখনও। কিছুদিন চাকুরী করতেন, তারপর সব ছেড়েছুড়ে বাড়িতে চলে আসতেন। চলত সমান্য জমানো টাকায় সমাজসেবা। তারপর আবার হয়ত নতুন একটা চাকুরী নিতেন।
নানাভাইয়ের শ্বশুর যখন বার্মা থেকে দেশে ফেরেন, নানি প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় নাইওর যান বাপের বাড়ী। সব শুনে বাপ তাকে পরামর্শ দেন এই "ডন্ডকপাইল্যা" ছেলেকে ত্যাগ করতে। নানি বাপের বাড়ী থেকে পালিয়ে স্বামীর বাড়ী চলে আসেন।
জীবনটাই এরকম তাই না !? এই জীবনে হতাশা আর ব্যর্থতা যেমন থাকে, প্রেম আর যৌবনও তেমন তার রঙীন ফাঁগে মনকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ভাবি, জীবন আর যৌবন বোধহয় একই। মানুষের শৈশব আর কৈশোর কাটে যৌবনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আর বার্ধক্য কাটে যৌবনের জন্য হা পিত্যেশ করতে করতে।
এবং এরই ফাঁকে ফাঁকে মৃত্যু ওঁত পেতে থাকে বিষাক্ত নীল বেদনার মত। অভিশাপের মত। খরচক্ষু শকুনের মত। যৌবন, যৌবনের রঙিন স্মৃতি মৃত্যুকে কখনো ছিনিয়ে নিতে পারে না।
ক্যান্সার আবার আঘাত হানে নানাভাইকে। তৃতীয়বারের মত। আবার আপারেশন করা হয়। কিন্তু এবার অপারেশনের পর আর রক্ত পড়া বন্ধ হয় না। আমরা রক্ত দিতে থাকি আর চলতে থাকে বিভিন্ন চিকিৎসা। কেমোথেরাপির পরে রেডিওথেরাপি। আর পেছন পেছন লুকিয়ে লুকিয়ে আরও অনেক কিছু.....হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি....এমনকি পানিপড়া।
একমাস পরে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। নানাভাই সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু এবার আর একমাসও যায় না। আবার রক্ত। নানাভাই সিদ্ধান্ত নেন, আর অপারেশন না। অনেক হয়েছে। এবার হোমিওপ্যাথি করে দেখবেন কিছুদিন। হোমিওপ্যাথির ডাক্তাররাও অনেক বড় বড় আশা দেখান। " চাচামিচ্ঞা, একবার অপারেশন করলে বারবার করতে হয়। অপারেশন করানোটাই ভুল হয়েছে। প্রথম থেকেই হোমিওপ্যাথি করানো উচিৎ ছিল। যাই হোক, কোন ব্যাপার না। আপনি আরও অন্ততঃ বিশ বছর বাঁচবেন।"
নানাভাই আশাবাদী হয়ে ওঠেন। অথবা হয়ত মনে মনে হাসেন। আমি ঠিক জানি ন। তবে বিশ বছর বাঁচা আর হয়ে ওঠে না। পনের দিন পরেই মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শরীর থেকে সব রক্ত বের হয়ে গেছে। হার্ট বাকি সামান্য রক্তটুকু দিয়ে শরীরের চাহিদা মেটাতে পারছে না। সেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিডনির অবস্থাও যাই যাই।
এ অবস্থায় কোন অপারেশন চলে না। কোন সার্জন এ অবস্থায় অপারেশন করবেন না। কোন এ্যানেসথেটিস্ট এ অবস্থায় অজ্ঞান করবেন না। এ সময় শুধু রক্তের বদলে রক্ত দিয়ে মানুষকে কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা। শরীরের ক্যান্সার কোষরা ধিতাং ধিতাং নাচছে। তাদের জয় হয়েছে। তবু আমি বললাম," নানাভাই, দুইটা দিন কষ্ট করেন। তিন চার ব্যাগ রক্ত দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।" নানাভাই তেমন কিছু বলেন না। আসন্ন মৃত্যু তাকে খুব বেশী বিচলিত করতে পারে বলে মনে হয় ন।
এরপর এক মধ্যাহ্নে সে আসে। শান্ত, নির্লিপ্ত, শান্তিময় এক মৃত্যু। প্রস্রাবের থলিতে রক্ত জমাট বেঁধে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বারবার। ব্যথায় শেষের দিকে প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছিলেন নানাভাই। চিৎকার করে একটু শান্তিময় মৃত্যু কামনা করছিলেন আল্লার কাছে।
ঈশ্বর তার কামনা পূর্ণ করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ২:৩০