শীতল জ্যোৎস্নার সাগরে দাঁড়িয়ে ছিলেন আপনি! গাঢ় মধ্য নীশিথে!
এক আঁজলা রোদ নিয়ে হাতে!
ক্লিওপেট্রা নিজে কাজল এঁকেছিল আপনার চোখে! ভ্রূ -বিভঙ্গে লুকিয়ে ছিল রহস্যময়ী নেফারতিতি!
আর মুখের আদলে ভরা ছিল রাধিকার বিরহ।
আপনার চোখের জলশিল্পে যখন মুগ্ধ বাতাস বইতে ভুলে যেত ।
ঠিক তখন দ্বিধা -জর্জর আপনি একা, একা, ব্যথার অলঙ্কার গুলো খুলতেন খোলা বাতায়নের পাশে!
আর পালিয়ে যেত আপনার নার্সিসাস প্রেমিকের দল!
কিন্তু, জানেন কি হে মহীয়সী?
আপনার হাতের নিহত রোদের ভেতরেও জীবিত ছিল উষ্ণতা?
যে উষ্ণতাকে কুর্ণিশ জানায় এইসব নার্সিসাসেরা
ইন হি লোগো নে.........
হুম।ইন হি লোগো নে এই সব মানুষরা যারা তাঁকে সাম্রাজ্ঞী বানিয়েছে আর যারা দুঃখ সাম্রাজ্য উপহার দিয়েছে প্রত্যেকেই তাঁকে কুর্ণিশ জানায়। আর আমরা যারা সেই যুগের স্পর্শ থেকে বহুদূরে তারাও শিল্পের আঙিনায় পা দিলেই তাঁর উপস্থিতি টের পাই। তিনি হলেন অসামান্যা অভিনেত্রী এবং নিভৃতচারীনি কবি ' মীনা কুমারী '।
মাত্র কয়েকদিন আগে ১আগস্ট তাঁর জন্মদিন চলে গেলো। তাই আমার স্বল্প জ্ঞানের বৃত্তের মধ্যে থেকে তাঁকে নিয়ে এই লেখাটা লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না! ১৯৩২ সালে স্টেজ শিল্পী আলী বক্স, বাবা ও মা ইকবাল বেগম ( যিনি আবার জন্মসূত্রে বাঙালি ছিলেন) এর ঘরে জন্মান, তাঁদের দ্বিতীয়া কন্যা মেহজাবীন। মীনা কুমারী। তবে এই কন্যার প্রবেশে যে কতটা আলো ঢুকেছিল ঘরে তা তাঁর পরিবার ঠিক সে সময়ে ততটা হয়ত বুঝতে পারেনি। কারণ বাবা তাঁর এই মেয়েকে প্রথমে অনাথ আশ্রমে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু মায়ের অনুরোধে সে চিন্তা ত্যাগ করেন। মায়ের হাত ধরেই মীনা বলিউডএর প্রথম সোপানএ পা দেন, মাত্র ৪বছর বয়সে। শিশু শিল্পী হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ হয়' লেদার ফেস ' নামক মুভিতে। সেই সাথে সমস্ত পরিবারের সৌভাগ্যর চাকা হয়ে উঠলেন বেবি মীনা! যে চাকা জীবনের শেষ পর্যন্ত ঘুরেই গেছে।
তাঁর জীবনীকার বিনোদ মেহেতা জানাচ্ছে নায়িকা হওয়ার আগে তিনি বহু মিথোলজিকাল চরিত্রে অভিনয় করতেন। অভিনয় এতোটাই নিপুণ ছিল যে এক সুন্নি মুসলীম মেয়েকে সেটেরই অনেকে হিন্দু ভেবে ভুল করত। বৈজু বাওরাতে প্রথম নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯৪০সালেই তিনি পারিশ্রমিক নিতেন ১০০০০ টাকা। যেটা তাঁকে ফিল্ম দুনিয়ায় নিজের পছন্দমত চলার স্বাধীনতা দিয়েছিল।
এক সাধারণ মেয়ে থেকে সিন্ডারেলা হয়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।
কামাল আমরোহি ও মীনা কুমারী
তিনি ছিলেন সাহিত্য অনুরাগিণী। এই পথেই স্বপ্নের রাজকুমারের সাথে দেখা হোলো তাঁর। কামাল আমরোহি। শিক্ষিত, রুচীবান, লেখক, ফিল্ম ডিরেক্টর এবং বলিষ্ঠ কবি। বাড়ি থেকে পালিয়ে তাঁকে বিয়ে করলেন মীনা! কারণ পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মেয়েকে তাঁর বাবা কারো সাথেই বিয়ে দিতে চাননি। তবে , এবারে বলা যেতেই সিন্ডেরেলার জীবন, সুখে সাছন্দে কাটতে লাগলো। কিন্তু নাহ! জীবনকথার গল্প বোধহয় এমনটা হয় না ! কিছু দিনের মধ্যেই সুখের ঘরে জমা হোলো অসুখ।কামাল আমরোহি কবি থেকে প্রায় মেল শভিনিস্টে পরিনিত হলেন। নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকলেন তাঁর উপর। অবশেষে এক যুগ যেতে না যেতে ঘর ছাড়লেন মীনা। গুলজার এই প্রসঙ্গে বলেছেন “She was a great admirer of intellectual poets that’s primarily the reason why she fell in love with her husband Kamal Amrohi, who was a proficient poet and filmmaker. But due to marital discord she abandoned Kamal Sahab and lived in solitude.”
তবে এই সময় তিনি রূপালী পর্দায় তিনি চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করেন । ১৯৬০ সালে তিনি সাফল্যের শিখর স্পর্শ করেন । পরিনীতা , দিল আপনা প্রীত পরায়ি , সাহেব বিবি আউর গুলাম একের পর এক সফল হয় ছবিগুলি ।
সাহেব বিবি আউর গুলামে গুরু দত্ত তাঁর সৌন্দর্য্য ও অভিনয় দক্ষতার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন । এই ছবি সম্পর্কে মীনা তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন যে এই চরিত্রটার সাথে তিনি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন । এখানে আর একজন নারীর কথা বলতেই হচ্ছে । তিনি হলেন এই ছবির গায়িকা গীতা দত্ত । বড়ই অদ্ভূত সমাপতন এই দুজনের জীবনের । এই ছবিটা তৈরীর সময় দুই নারীরই তাঁদের প্রেমিক তথা স্বামীর সাথে সম্পর্ক তলানীতে গিয়ে ঠেকে । ' না যাও সাঁইয়া ছুড়াকে বাঁইয়া কসম তুমহারে ..............' চিরস্মরণীয় গানটির লিরিক শুনলে মনে হয় যে এই গান বোধহয় তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের কথাই বলছে । তাই কি গায়কী আর অভিনয় এতো সজীব লাগে আজও ?
একাকিনী
ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড হাতে যা তিনি ৪ বার পেয়েছিলেন ।
ধর্মেন্দ্রর সাথে স্পটে
দিল-সা-সাথী যব পায়া , বেচয়নী ভি সাথ মিলি -- মীনা কুমারী
সে সময়ে মীনা কুমারীর সাথে কোনোভাবে যদি একবার নাম জড়ানো যেত তবে তার বলিউডের রূপকথায় প্রবেশ ছিল অবধারিত । একথাটা খুব ভালোভাবে অনুধাবন করেছিলেন ধর্মেন্দ্র । মীনাজী ধর্মেন্দ্রকে ফিল্মের টেকনিক্যাল দিক থেকে অভিনয় পর্যন্ত , অনেক কিছুই শিখিয়েছিলেন । শুধু তাঁকেই নয় আরো অনেককেই শিখিয়েছিলেন তিনি । কিন্তু সুযোগ নেন ধর্মেন্দ্র । কিন্তু প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর ফিরে তাকাননি তাঁর দিকে । এমনকি তাঁর জীবনীকার বিনোদ মেহেতা যখন ধর্মেন্দ্রর সাক্ষাৎকার চান , তখন এক মিনিটও সময় দেননি তাঁকে । মেহেতা তাই বলেছেন , ' Dharmendra —the man who had callously used and discarded her' ।
এবার দুঃখ তার সহ্যসীমা অতিক্রম করলো। অ্যালকোহলিক হয়ে পড়লেন তিনি! আনন্দ পাওয়ার জন্য নয়। দুঃখ ভোলার জন্য। ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন সেই সাথে । লিভার সিরোসিসএ।
পাকিজা
এসবের মাঝে তাঁর অনবদ্য ফিল্ম ' পাকিজা 'র ঘোষণা করে ফেলেছিলেন তাঁর স্বামী কামাল আমরোহি । যা তৈরী হতে সময় লেগেছিল ১৪ বছর। কারণ এই ছবিটা যখন শুরু হয় তখনই মীনা দূরে সরে গেছেন স্বামী কামালের থেকে! যদিও তিনি বলেছিলেন যে তিনি পেশাদার শিল্পী! ব্যক্তিগত সম্পর্কের ছাপ অভিনয়ে পড়বে না! কামাল আমরোহি আবার কবি মানুষ । তিনি বললেন যে , মীনার জন্য মীনা কে ভেবে তিনি এই ছবির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন , সেই মীনাই যখন আর তাঁর জীবনে থাকল না তখন ভাঙা মন নিয়ে কিভাবে প্রেমের ছবি বানাবেন তিনি ? তাই চাপা পড়ে গেলো ছবির কাজ ।
নার্গিস ও মীনা কুমারী
তবে সৃষ্টিশীল মানুষেরা বেশীদিন সৃষ্টির থেকে দূরে থাকতে পারেন না । আমরোহিও পারলেন না ।প্রায় দশ বছর পরে নতুন করে ' পাকিজা ' তৈরীর কথা ভাবতে লাগলেন । তবে এবারে আর মীনা নয় । শুরু হোলো নতুন নায়িকার খোঁজ । কিন্তু কাউকেই আর তাঁর পছন্দ হয় না । বললেন মনজু ( মেহজাবীন - মীনা কুমারী ) ছাড়া এই চরিত্র কেউ করতে পারবেন না । অবশেষে নার্গিসের মধ্যস্থতায়
আমরোহি চিঠি লেখেন মীনাকে ও শুরু হয় পাকিজার কাজ ।
পাকিজার সেটে
ভাগ্য মীনাজীর সাথে বারবারেই নিঠুর খেলা খেলেছে । এতো কান্ডের পর ফিল্মটা রিলিজ হোলো তখন সব বড় সংবাদপত্র গুলো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাল । উর্দু সংবাদপত্র গুলো প্রশংসা করলেও , বলা হোলো ,সেগুলো পক্ষপাত দোষে দুষ্ট । যদিও এর কিছুদিন বাদে তাঁর মৃত্যুর পর এই ছবিটাই হয়ে ওঠে দর্শকদের কাছে শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলী ।
দুই বোনের সাথে ।ডান দিকে
ঐতিহ্যশালী সৌন্দ্যর্যের প্রতিচ্ছবি
এবারে একটু নিভৃতচারীনি কবি । এখন যখন একটু আলো পাওয়ার মানুষ সীমা পেরোতে দ্বিধা বোধ করছে না , তখন কেউ আলোকবৃত্তের মধ্যে থেকেও নিভৃতে কবিতা লেখে , একথা অবিশ্বাস্য শুনতে লাগবে । তবুও একথা সত্যি । তিনি কবিতা লিখতেন নাজ নামের নিকে । তাঁর অভিনেত্রী সত্বাকে কবি সত্বার উপর চাপাতে চাননি । এতোটাই ছিল তাঁর কবিতার উপর প্রেম , নিষ্ঠা । তাঁর কবিতাগুলো তিনি দেখাতেন বিখ্যাত উর্দু কবি কাইফি আজমিকে । যাঁকে তিনি গুরু মানতেন । আর পরম বন্ধু গুলজারকে । জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বন্ধুত্ব অটুট ছিল । মৃত্যু শয্যায় তাঁর সমস্ত ডায়েরী গুলজারকে দিয়ে যান । পরে গুলজার সেই কবিতা প্রকাশ করেন ।
তাঁর লেখা আমার একটা প্রিয় কবিতা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম --
Zindagi Yeh Hai
Subh se sha’m talak
Doosro’n ke liye kuch karna hai
Jisme’n khud apna koi naksh nahin
Rang us paikare-tasweer hi mein bharna hai
Zindagi kya hai, kabhi sochne lagta hai yeh zehan
Aur phir rooh pe cha jate hain
Dard ke saye, udasi ka dhuan, dukh ki ghata
Dil mein rah-rah ke khayal a’ta hai
Zindagi yeh hai to phir maut kise kahte hain ?
Pyar ik khwab tha, is khwab ki ta’bir na pooch
Kya mili jurme-wafa ki hame’n ta’zir na pooch
This is Life
From morning to night
We must do things for others,
That living picture must be vivified
In which there is no trace of one’s self.
What is life, the mind sometimes wonders
And then the soul
Is overcast by shadows of grief
The smoke of despondency
( ইংরেজি অনুবাদ Noorul Hasan )
আপনে অন্দর মেহেক রহা থা প্যায়ার
খুদ সে বাহার তালাশ করতে রহে ! -- মীনা কুমারী
অনেকে বলে থাকেন বাস্তবিকই তিনি দুঃখ-সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী ।সত্যিই এই শ্রাবণী কন্যার চোখে শ্রাবণ ধারা বয়েছে । কিন্তু আজকের তারিখে বসে তাঁর জীবনী পড়ে আমার সেকথা একথা মনে হয়নি । উল্টে মনে হয়েছে প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও এক নারী জীবনে পছন্দ মতো বাঁচতে চেয়েছেন এবং বেঁচেছেন, সে সময়ের পুরুষ শাষিত বলিউডে ।তাঁর ডান হাতের কড়ি আঙ্গুলটা কাটা ছিল । কিন্তু সেটাকে ঢেকে তিনি এমনভাবে অভিনয় করেছেন যে দর্শক কখনো তা বুঝতেই পারেনি । চমৎকৃত হয়েছি একথা জেনে । মার্সিডিস প্রেমে আমি সফলতা দেখেছি । কোনো রকম প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও , তাঁর কবিতা , ভাষার উপর তাঁর দখলদারী আমায় মুগ্ধ করেছে । তাঁকে উদ্দেশ্য করে এলেখা শুরু করেছিলাম । পরিশেষে তাঁকে উদ্দেশ্য করেই তাঁর প্রতি আমার মনের অনুভব ব্যক্ত করলাম --
যতটা দৃষ্টি সীমানায় আবদ্ধ হতে পারে
তার চেয়ে ঢের বেশী বিস্তৃত ছিল আপনার সাম্রাজ্য! আপনারই অগোচরে।
আপনি তো নিছক দর্শনীয়া নন! স্বপ্নহীন বিরান উপত্যকার আপনি স্বপ্নিকা!
অমাবস্যার নিগূঢ় অন্ধকার চিরে, মোহিনী আপনি, চন্দ্রকলার মতো প্রতিভাসিত হন!
আর এই স্বপ্নর জাদুকরীকে দেখে বারবার মুগ্ধ হয়েছে, হবে আপনার অদেখা পৃথিবী!
বিরহ যাপন যারা সহেনি কখনো। পায়নি প্রেমের সন্ধান!
তারাও আপনার বিরহ নদীকে স্পর্শ করে প্রেমের ছোঁয়া পেয়েছে!
আর মুগ্ধ বিস্ময়ের পুষ্পাঞ্জলিতে ভরে উঠেছে আপনার আঁচল!
আপনি হয়ত দাঁড়িয়ে ছিলেন, সবুজহীন লোহিত মরুভূমিতে !
কিন্তু হে মহীয়সী, আজ আপনার আঁচল ছাপানো ফুল পড়ে সেই মরুভূমিই হয়েছে মরুদ্যান!
বি.দ্র -- তাঁর কোনো ফিল্ম আমি দেখিনি । তবে ইউ টিউবে গান গুলো শুনেছি বহুবার । তাই ,আশা রাখছি ভুল ত্রুটি আপনার নিজগুনে ক্ষমা করবেন ।
তথ্য ঋণ --
গুগুল , মিড ডে , 'Meena Kumari the Poet: A
Life Beyond Cinema' , Meena Kumari: The
Classic Biography ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:২৫