আমার আশপাশের সবাই আমাকে বলে ইমোশনাল ফুল। বিচার বিবেচনা কিছু করতে পারি না। দুনিয়ার সবাইকে বিশ্বাস করি। এমনকি আমাদের পাড়ার একটা ভাই ( ইলেভেনএ পড়ে) , তাকে যদি রাখীতে রাখী পড়িয়ে বলি, ' আমি দিদি, প্রণাম কর! ' ও' প্রতিবারই উত্তর দেয় ' তাতে কি? নেক্সট টাইম ভাববো। আমি বেশী ম্যাচিওর। কারণ তোমার বিচারবুদ্ধি কিছু নেই। ' তারপর, আমার অপারগতার ব্যাখ্যা দেয়। যাক, সে কথা।
তবে এসব কারণে শিরোনামের প্রশ্ন গুলো আমায় খুব ভাবায়। সেই ভাবনাটা এবার আপনাদের সাথে শেয়ার করি। সাধারণ মতে সম্পর্ক তৈরী করাটা খুব সহজ নয়। হয়ত ঠিক। বিশেষ করে মানুষ যখন একে অন্যকে শিকার বা শিকারি ভাবে, তখন শত্রু, মিত্র বোঝাটা কঠিন। আর এর কারণটা বোধহয় অহম। ' অহম'ই বলে যে, আমি সবথেকে বেশী নিজের ভালো বুঝি । একমাত্র যখন খুব অসহায় অবস্থা হয়, আর কোনো উপায় থাকে না, তখনই ভাবি অন্য কেউও আমার ভালো করতে পারে আর তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হই! কিন্তু এটা পাশবিক ধর্ম নয় কি? পশুরা নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য অর্থাৎ খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য একে অন্যকে মারে। শত্রু বা মিত্র বিচার করার ক্ষমতা তাদের নেই। মানুষেরও খাদ্য ও নিরাপত্তা দরকার।তবে কিভাবে তা করবে তা বিচার সে করতে পারে। তাদের চিন্তা শক্তি বা কল্পনা শক্তি আছে। আর আছে সহমর্মিতা। অন্যের অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করা নয়। আর মানুষ সেটাই করতে চায়। কারণ সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
এখন বিশ্বাস কি? বিশ্বাসকে মাপা যায়না । প্রমাণ ও করা যায় না। হয় তা আছে নাহলে নেই। এর মাঝামাঝি কোনো জায়গা নেই। বিশ্বাস যদি কোনো জ্ঞান বা ধারণার উপলব্ধি হয়, তবে সহমর্মীতা , অন্যের অনুভূতি বোঝার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। রামায়ণএর সীতা চরিত্রটা বিশ্বাস ও সহমর্মীতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একটু বিশ্লেষণর চেষ্টা করি।
সীতা প্রথম দূর থেকে রামকে দেখেন এবং পছন্দ করেন। তখন তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন যেন , রামই হরধনুতে গুণ পড়াতে পারেন। মানে তিনি দৈবে বিশ্বাস রাখলেন। আর কি অপশন ছিল তাঁর হাতে? ১. সীতা, পিতা জনককে বলতে পারতেন। কিন্তু তখন সয়ম্বরে অংশ নেবেন বলে অংশগ্রহণকারীরা চলে এসেছেন। এই অবস্থায় তাঁকে ( জনককে ) বিব্রত করতে চাইলেন না। ২.রামকে বলতে পারতেন। তাও তিনি বললেন না। এমন নয় যে তাঁর প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় ছিল। যা সাধারণত মানুষর থাকে। কারণ অহম। সে ভাবে প্রত্যাখ্যাত হলে বোধহয় ছোটো হয়ে যাবে! ঋষি বিশ্বামিত্র জনকের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন । আর গুরুর সাথে রাম ও লক্ষ্মণ ছিলেন। রামের বাবা দশরথ জানতেন না যে তিনি মিথিলায়। রামের কাছে বাবার সম্মতি বা অসম্মতি কোনোটাই ছিল না। তাই এখানে সীতা তাঁকে দ্বিধায় ফেলতে চাননি।
আমার পছন্দ যদি অন্যকে অসুবিধায় না ফেলে, তবেই তা হয়ে ওঠে ধর্ম মানে মানবিকতা।
অন্যের অসুবিধার বিনিময়ে যদি নিজের পছন্দ পেতে চাই তবে তা অধর্ম বা অমানবিকতা।
রামকে নিজের ইচ্ছের কথা না বলাটা যে তাঁর সহমর্মীতা, পরবর্তীতে বিশ্বামিত্র সেটা প্রমাণ করেন। রাম সয়ম্বর শুধু দেখছিলেন। যখন কেউ হরধনু তুলতেই পারলো না তখন বিশ্বামিত্র রামকে যেতে বললেন। সাথে এও বলেন সীতা ভূমিজা। জনকের বীর্যশুক্লা নন। তুমি বিবাহ করতে প্রস্তুত তো? উত্তরে রাম বলেন ' আমি ক্ষত্রিয়। ক্ষেত্র বা ভূমিকে রক্ষা করাই আমার কাজ। তাই যিনি ভূমিজা তাঁর দায়িত্ব নিতে আমি প্রস্তুত আছি । '
বিবাহের পর সীতা প্রথম কথাতে রামকে কাব্যগীত শোনাতে বলেন। উত্তরে রাম বললেন ' তুমি যেমন প্রকৃতিকে দেখো, আমি সেভাবে দেখিনা। আমি রাজকুমার। ছোটো থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছি। প্রকৃতিকে দেখলে মনে হয়, কিভাবে অস্ত্র দিয়ে তাকে রক্ষা করবো। তবে আমি সামনের জন্মে অবশ্যই তোমায় গীত শোনাবো। ' এখনকার নায়িকা হলে হয়ত বলতো তবে এখন বাই, সামনের জন্মে হাই বলবো। কিন্তু এটা রামা্যণ , সীতা একথা মানলেন। বুঝলেন তিনি জোড় করে যোদ্ধাকে কবি বানাতে পারবেন না। তারপর রাম বলেন তবে তোমার প্রতি প্রেম স্বরূপ আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আজীবন একম পত্নী ব্রত পালন করবো। দ্বিতীয় বিবাহ করবো না। সীতা একথা আজীবন বিশ্বাস করেছেন । তাই সূর্পনখা যখন রামকে বিয়ের কথা বলেন তখনও তিনি অবিচল থেকেছেন । কিন্তু যখন লক্ষ্মণ সূর্পনখার নাক কেটে দেন তখন সীতা সহমর্মীতা দেখিয়ে তাকে উপাচার লাগান । তখন সীতা ভাবেননি একটু আগেই সূর্পনখা তাঁকে মারতে এসেছিল বা এই সহমর্মীতার মর্ম সে বুঝবে কিনা ! সত্যিই সে বোঝেনি আর ফল ভালো হয়নি । এরপর সন্ন্যাসীরূপী রাবণকে বিশ্বাস করেও তিনি ফল ভালো পাননি । তবে পাত্র যেই হোক না কেনো সীতা বিশ্বাস ও সহমর্মীতার ধর্ম থেকে সরেননি । তাঁর সহমর্মীতা ছিল বলেই পুরো রামায়ণে কোথাও রামকে দোষারোপ করেননি । রামের বাধ্যবধকতাকে বুঝেছেন । তাই রাম যখন তাঁকে বনবাসে পাঠাচ্ছেন তখনও তিনি রামের প্রতি বিশ্বাস রাখছেন আর বলছেন ' আমি পরিতাজ্য হতেই পারিনা ।' কারণ রাম বলেছিলেন যে তিনি ' একম পত্নী ব্রত 'পালন করবেন । অবশ্য সত্যিই রাম পরিশেষে বলেন ' আমি অযোধ্যার রানীকে বনবাসে পাঠিয়েছি । নিজের পত্নীকে পরিত্যাগ করিনি । '
এতো গেলো নীতি গল্প । আমি পরিশেষে আবার ব্যক্তিগততে আসি । কারণ এ গল্প আমার ফ্রেন্ডদের শোনালে বলে এসব শুধুই গল্প । বাস্তবে এসব হয় না । ঈশ্বর এসবের মূল্য দেন না । যারা এসব রাস্তায় চলে না তাদেরকেই উনি ভালোবাসেন । হয়ত ঠিক । আর আমার সাথে ঈশ্বরের সম্পর্কের কথা কি বলবো ? মানে , আমি একের সাথে এক যোগ করতে পারিনা উনি আমাকে দেন ক্যালকুলাস করতে ! এদিকে এমনভাবে আমাকে তৈরী করেছেন যে মাথা দিয়ে ভাবতে পারিনা । আবেগই সর্বস্ব । আবেগী হয়ে কারো ভালো চেয়ে , কষ্টই পাই । তাই ভেবে দেখলাম উনি আমায় ভালোবাসেন না ! তারপরে ভাবলাম , এরকম কষ্ট পেতে থাকলে কি হবে ? কষ্ট যদি অসহ্য হয় তবে মৃত্যু হবে । আর মৃত্যু মানে তো মুক্তি । সব কষ্ট থেকে । তবে কি ঈশ্বর আমাকেও ভালোবাসেন ? তারমানে আবেগ , বিশ্বাস ও সহমর্মীতা থাকাটা নির্বুদ্ধিতা নয় । আপনারা কি ভাবেন ?
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:০৮