' নেটিভ ' শব্দটা যাঁরা তাচ্ছিল্য ভরে উচ্চারণ করতেন, তাঁরা বহুকাল আগেই চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাচ্ছিল্য দেখিয়ে ভ্রূ কুঞ্চিত করার মানুষের অভাব নেই। যেমন ধরুন আপনি কোন কেতা দুরস্ত নৈশ ভোজ গেছেন আর সেখানে হয়ত সবাই বাঙালী! তবু যদি সেখানে হাত দিয়ে খেতে যান তবে বাদবাকি চোখগুলো আপনাকেই দেখবে। সে চোখের ভাষা স্পষ্ট -'ইশ হাত দিয়ে খাচ্ছে? ' তারমানে সভ্যতার ' স ' ও শেখেননি। কিন্তু কাটলেরির সাথে সভ্যতার কি সম্পর্ক? এটা তো পাশ্চাত্যরীতি। তবে সভ্যতা মানে কি শুধুই পাশ্চাত্য সভ্যতা?
অথচ অস্ট্রেলীয় উপজাতি বা আফ্রিকানরা হাত দিয়ে খায়। মধ্য যুগে ইওরোপিয়ানরা খাওয়ার খেতে প্রথমে শুকনো ব্রেডের ও পরে কাঠের ট্রেঞ্চার ব্যবহার করত। আর ছুরি প্রথমে খাওয়ার সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হত না। পুরুষরা নাকি ভোজ সভায় ছুড়ি দিয়ে কে কত ভালো করে খাওয়ারের স্লাইস কাটতে পারে তার প্রতিযোগিতা চালাতো। যার পুরোটাই মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষনের উদ্দেশ্যে ।
ব্রেডের ট্রেঞ্চার
কাঠের ট্রেঞ্চার
আবার গ্রীকদের মধ্যেও কাটলেরির চল ছিল না। আর রোমানরা ও ছুরি বা কাঁটা চামচ ব্যবহার করত না। এমনকি ওল্ড টেস্টামেন্টএ দেখছি প্রভু যীশু হাত দিয়ে ব্রেড টুকরো করছেন।
এছাড়া কেতাদুরস্ত ফ্রান্সেও কাটলেরির চলন ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীতে ইটালির রাজকুমারী ক্যাটেরিনা মারিয়া বা ক্যাথরিন দি মেডিচি, হেনরী 2 এর সাথে বিবাহ সূত্রে ফ্রান্সের রানী হয়ে এলেন তখন তাঁর সাথে ছিল নিজস্ব শেফ এবং একটা কাটলেরি বাক্স। শোনা যায় তিনিই নাকি প্রথম কাঁটা চামচটি নিয়ে এসেছিলেন ও ফ্রান্সকে ছুরি, কাটা, চামচের সদ ব্যবহার শিখিয়ে ছিলেন!
ধীরে ধীরে তা প্রচলিত হয় এবং বিত্ত ও সম্ভ্রান্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। এরপর ঔপনেবিশকতার সাথে বিস্তৃতি লাভ করে।
ক্যাটেরিনা মারিয়া বা ক্যাথরিন দি মেডিচি
তবে আমাদের এই হাত দিয়ে খাওয়ারও একটা ব্যাখ্যা আমার জানা আছে । বৃদ্ধাঙ্গুলি - অগ্নি, বায়ু - মধ্যমা, আকাশ - তর্জনী,জল - অনামিকা আর বসুন্ধরা বা মাটি - কনীষ্ঠার প্রতীক। এই নিয়ে জীবন। তাই হাত দিয়ে খাই।।
যাক, ব্যাখ্যা না হয় বাদ দিলাম। আমার মনে হয় খাদ্যাভ্যাস আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে । ঠাণ্ডার দেশে চামচ দিয়ে খাওয়াই সুবিধেজনক। মানলাম । কিন্তু আমাদের এখানে তো খাওয়ার গুলোই হাত ব্যবহারের জন্য তৈরি। ভাতটা নাহয় স্টিকি বলে চামচ চলে। কিন্তু রুটি বা লুচিতে তো হাত লাগাতে হবে। আর এখন গরমে আমের আচারের কথা ভাবুন! চামচ দিয়ে খেলে মন ভরবে? আমার তো একেবারেই না।
এদিকে গ্লোবালাইজেসন খাদ্যের সীমানা ভেঙে দিয়েছে । চাইনিজও বাঙালিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় । যেমন নুডলস এমন খাওয়ার যা খেতে চামচ লাগে । কিন্তু চপ স্টিক? এখন দেখি অনেকেই চপ স্টিক দিয়ে চাইনিজ খাওয়াটাকে কৃতিত্ব মনে করে। আমরা বাঙালীরা কি অন্যের রঙে একটু বেশীই রঙিন হতে যাই? এক্ষেত্রে একটু ব্যক্তিগত কথা বলি। আমার দাদা আমায় চপ স্টিকের ব্যবহার শেখাতে গিয়ে ফেল করে গেছে। আমিও দাদাকে পাশ করানোর কোনোরকম চেষ্টা করিনি!
চপ স্টিক দিয়ে নুডলস ভক্ষন । দেখতে সোজা , কাজে করতে গেলে সত্যিটা টের পাওয়া যায় ।
আমার মতে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে যে কোনো জায়গায় খাওয়ার খেতে গর্বের সাথে হাতই ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধু হাতটা পরিষ্কার হলেই হোলো। আপনি ও কি একমত?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৭ রাত ১১:৩৭