বর্ষা ঋতুর সাথে যে রান্নাটির নাম ওতোপ্রতোভাবে জড়িত , তা হোলো খিচুরী । যদিও শীতেও তার রমরমা আছে । আর সারা বছর কারনে অকারনে তিনি সাথে থাকেন ।
এই খিচুরীর জন্মক্ষণ সঠিক বলা না গেলেও আলেকজান্দারের সেনাপতি সেলুকাস তাঁর লেখনীতে খিচুরীর উল্লেখ করেন । তাঁর কথায় এই রান্নাটি সাউথ এশিয়ায় জনপ্রিয় ছিল । আবার ইবনবতুতা মুগডাল আর চাল দিয়ে তৈরী খিশ্রীর কথা লিখেছেন তাঁর ভ্রমনকথায় ( ১৩৫০ খ্রীঃ ) । এরপর পনেরশ শতাব্দীতে ভারতে আসা রুশ পর্যটক নিকিতিনের লেখাতেও খচুরী জায়গা পেয়েছে ।
ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে নিম্নবিত্ত ইজিপশিয়ানদের মধ্যে কুশারি নামে যে রান্নাটি জনপ্রিয় হয় সেটিকে খিচুরীরই ভিন্নরূপ বলা যেতে পারে । চাল , ডাল , চানা , ভিনিগার , টমেটো সস , পিঁয়াজ , আদা , রসুন ইত্যাদি উপকরন দিয়ে এটি তৈরী হত । পরে এই রান্নাটি তাদের সৈন্যশিবিরেও স্থান পায় ।
কুশারি
আবার ব্রিটিশ কেডজ্রিও আসলে আমাদের খিচুরীরই সাহেবী সংস্করন । ভিক্টোরিয়ান যুগে দেশে ফেরত ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের হাত ধরে তা ইংল্যান্ডে পৌঁছয় । তখনকার অ্যাংলোইন্ডিয়ানরা রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত , ডাল , ডিম ,মাছ পরদিন নতুনভাবে সুস্বাদু করে রান্না করে ব্রেকফাস্ট করতেন । এটাই কেডজ্রি । তাই অনেকে দাবি করেন , বিলেত থেকেই এই রান্না ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছে । কিন্তু এযুক্তি দোপে টেকে না ।
কেডজ্রি
ভিক্টোরিয়ান যুগের আগেই মুঘল বাদশাহদের খিচুরী প্রীতির জন্য তা শাহী খানার তকমা পায় । তার সাথে জনপ্রিয়তাও । আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী - তে তিন ধরনের শাহী খানার রেসিপি দিয়েছেন । ১ । মাংস ছাড়া রান্না পদ ২ । মাংস ও চাল , মশলা দিয়ে রান্না পদ আর ৩ । মাংস ও মশলা দিয়ে রান্না পদ ।
প্রথোমক্ত মাংস ছাড়া রান্না শাহি মশালা দিয়ে পদগুলোর কথা আছে , তারমধ্যে সাতরকমভাবে তৈরী খিচুরীর উল্লেখ আছে ।
আর মুঘল বাদশাহদের খিচুরী প্রেম বংশানুক্রমিক । হুমায়ুন পারস্যে যখন ছিলেন তখন সেখানকার হেঁসেলেও খিচুরীকে নিয়ে যান ।
আকবর বীরবলের গল্পে খিচুরী কাহিনী তো সর্বজনবিদিত ।
জাহাঙ্গীরের দৌলতে গুজরাটের ভুট্টার খিচুরী মুঘল হেঁসেলে স্থান পায় ।
ভুট্টার খিচুরী
শাহজাহানের পছন্দের খিচুরী তো শাহজাহানী খিচুরী নামেই বিখ্যাত । সবুজ মুগ আর গোটা গরম মশলা এই খিচুরীর প্রধান উপকাণ । কারি , পাঁপড় আর দই এই খিচুরীর সাথে পরিবেশন করা হয় । শাহজাহান এই খিচুরী পর্তুগীজ পর্যটক সেবাস্তিয়ান মানরিখকে খাইয়েছিলেন । আর মানরিখকে এটা খেয়ে খিচুরীকে মণিমাণিক্যের সাথে তুলনা করেছিলেন ।
শাহজাহানী খিচুরী
তবে খিচুরী খেটে খাওয়া মানুষেরও খুব প্রিয় ছিল । এই নিয়ে একটা ঐতিহাসিক গল্প আছে ।
জোধপুরের প্রতিষ্ঠাতা রাও জোধাকে মেওয়ারের রানা কুম্ভ চিতোর থেকে উৎখাত করেন। বিতারিত রাও তখন পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন । নিজের পরিচয় লুকিয়ে ঘুরতে ঘুরতে, রাও জোধা এক জাঠ চাষার বাড়িতে খাবার চান। সেখানে তাঁকে খিচুরী দিলে খিদেয় কাতর জোধা গরম খিচুড়িতে আঙুল ডুবিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। চাষার গিন্নী তাঁকে বলে, ‘তুমি আমাদের রাজা রাও জোধার মতো ভুল করছ। খিচুরীর মাঝখানটা সবচেয়ে গরম থাকে আর ধারগুলো ঠান্ডা। ধারগুলো থেকে খেতে শুরু করো।’ এর পর রাও জোধা সরাসরি চিতোর আক্রমণের চেষ্টা না করে চারপাশের দুর্গগুলো জয়ের দিকে মন দেন। অবশেষে পনেরো বছর বাদে রাজত্ব ফিরে পান তিনি।
পূজার ভোগ হোক বা দৈনন্দীন জীবন সবজায়গায়ই খিচুরীর জয়জয়কার ।
আর বাঙালীর খিচুরী প্রীতির কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই ।
তাই এই বাদলা দিনে খিচুরী আর ইলিশ মাছ ভাজা রইল ।
আর যাদের আমার মতো ভেজ পছন্দ বেশী , তাদের জন্য --
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৫১