somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাগ পড়ে এলে আম্মাকে চিনা যায় সহজে

১৩ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৫:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সোজা মসজিদে। এরপর তিলাওয়াত। আম্মা এক মায়াবী লাহজায় পড়ছেন ইয়া-- সী-- ন... মোনাজাতে মকবুল। ইশরাক। ওদিকে আমাদের মুড়ির অপেক্ষা। আম্মা কুরআন বন্ধ করছেন-- যেনো কোন দূর অতীতের মায়াবীকোমল বহুমূল্য কাগজকে ভাঁজ খোলার পর ফের ভাঁজ করছেন। হাত, শরীর ও হৃদয় যেনো গভীর অনুরাগের স্পর্শে অনুভব করছে তিলাওয়াতের সমাপনী অনুষ্ঠান। লাল সুতি কাপড়রের গিলাফে কুরআন রাখছেন। ফিতা মোড়ানো শেষে বুকে ও চোখে কুরআনের পরশ নিচ্ছেন। পুরনো কাঠের তক্তার তাকে কুরআন রাখতে রাখতে ছোট বোনকে ডেকে বলছেন, 'নুন মরিচটা বানাইছো?'

এরপর রান্না আর আমার পড়া এই দুইয়ে ডুবে শেষ হতো ভোর। মন বিদ্রোহ করতো। এতো পড়ে কী হবে! আম্মার হাতের বেত দেখে সেই বিদ্রোহ দমন হতো চিন্তার পৃথিবীতেই। "ভাত হয়েছে। খাওন দিছি..." বলতেই দৌড়...

ততদিনে শৈশব কৈশোরের আম্মা স্মৃতি হয়ে গেছেন। আমি জীবনের লড়াইয়ে। বলা ভালো সংসার সমরাঙ্গণে একজন সফল যোদ্ধা হবার চেষ্টায় ঘর ছেড়েছি। মাঝেমধ্যেই ছুটি দীর্ঘ হয়। বলা ভালো আমার উন্নাসিক মন দু'দিনের ছুটিকে দু' সপ্তাহের বানায়। আম্মা বিরক্ত হোন। আব্বা বাড়ি আসবেন বলে ভয় দেখান। আমার মন পড়ে থাকে উদ্দেশ্যহীন অনেকগুলো বিকেলের মাঠে। নিজেকে বিকেলগুলোর কাছে যেনো ইজারা দিয়েছি। প্রতিদিন বিকেলের মুখোমুখি হই। বিকেলগুলো আপন করে নেয় আমাকে। আচ্ছা আম্মা! বোর্ডিংয়ের বিকেলগুলো এতো রূক্ষ্ম আর নিরস কেনো! আমাকে দেখলেই বিকেলগুলো পাথরের মতো হয়ে যায় কেনো! বলতে চাই আম্মাকে। আম্মার বেতটা হেসে উঠে। আমার পিঠটা কেঁদে উঠে।

ছুটি দীর্ঘ হলে খাবার মানে সব হতে থাকে বিরুদ্ধ আয়োজন। আমার আবার রাগ উঠে। হুট করেই উঠে। সবচেয়ে বেশি রাগ তো উঠে; ভাঁপ উঠা ভাত দেখলেই। আব্বা বলেন, "ওর হাতের চামড়া পাতলা। গরম ভাত ও খেতে পারবে না। ওর জন্য রান্নার পরপর ভাতটা বেড়ে রাখলে কী ক্ষতিটা হয়।" আম্মা ও ছোট প্রায়ই ভুলে যায়। আমি ভুলে যাওয়াটা মানতে পারি না। অথচ তিনটা সদাইয়ের কথা বললে একটা ভুল করে আনি না। সেই ভুল আম্মা মেনে নেন।

একদিন সকালে বিরুদ্ধ রুচির খাবার আর ভাঁপ উঠা ভাত দেখে রাগে গজগজ করতে করতে না খেয়েই ব্যাগ হাতে নিই চলে যেতে। মন বলছে, "চলে যা! এ বাড়ির কেউ তোর না। কারো কাছেই তুই জরুরী না। তোর পকেট ফাঁকা। ফাঁকা পকেটের মানুষের দাম নাই। পুরুষ রাগলে রাজা। রাগ যখন উঠেছেই চলে যা। তাগড়া জুয়ান একটা পোলা। কাজে লেগে যা। একদিন ব্যাগ ভর্তি নোট নিয়ে সবাইকে চমকে দিবি।" এইসব জরুরী মোটিভেশন পাচ্ছি ভেতর থেকে।

বাজার থেকে এদিক-সেদিক করা কয়েকটি টাকা আছে। কয়েকদিন টিউশনি করার পরেও পেয়েছিলাম কিছু টাকা। আছে সেগুলোও। মাটির ব্যাংক ভেঙ্গে পাই ছয় শ টাকা। এবার সাহস বেড়ে যায়। প্ল্যানগুলো ধীরে ধীরে সাইকেল, বাইক হয়ে প্রাভেট কারের দিকে ছূটছে। বহু বহু পেশার ভাবনার পরে টেইলারিং শেখার এরাদা পাক্কা হয়। কোথায় যাবো! সেই প্ল্যানে দেখি ময়মনসিংহ ছাড়া আর কিছুই চিনি না। ওখানে বড় চাচার বাসা। যাওয়া যাবে না। গেলেই ধরা পরবো!

টাকাগুলো পাঞ্জাবীর বগলপকেটে নিতে নিতে পেট দুইবার খিদের ইশারা দিলো। জেদ চেপে বসেছে। আঠারোবাড়ি স্টেশনে যেতে যেতে চারটা আত্মীয়ের বাড়ি আছে। পয়লা বাড়িতে ঢু দেবো। এখন সকাল খাবারটা হয়ে যাবে। কপাল! চার টারটা আত্মীয়ের বাড়িতে ঢু দিলাম কেউ একবারও বললো না, 'খেয়ে যাও'। অথচ এদের বাড়ি গিয়েছি আর তারা জোড় করে খাওয়ায়নি এমনটা হয়নি। পেটের ভেতর খিদের তুফান নিয়েই ছুটছি। জীবন বদলে দেবোই। পড়াশোনা আপাতত বাদ। আগে অভাবকে বিদায়। পরিবারে গুরুত্ব অর্জন। এরপর ভিন্ন চিন্তা...

আঠারোবাড়ি স্টেশনে এসেই সিদ্ধান্ত পাক্কা করে ফেলি; ঢাকা যাবো। ঢাকায় হারিয়ে যাবো। অথবা কাজী নজরুলের মতো প্রথমে রুটির দোকান। এরপর যুতসই মালিক পেয়ে টেইলারিং। ঢাকায় টাকার দরকার হবে। প্রতিদিন বেহিসেবি আমি তখন অনেক হিসেবি হয়ে যাই। পেট চিৎকার করলেও পণ করি এই কয়েক শো টাকা ভাঙ্গবো না। ওদিকে রায়বাজারের প্রতিটি দোকান আমাকে ডাকছে। ব্যাট বলের দোকান। স্টেশনরির দোকানের রঙিন কলম। ব্যাগের দোকান। পাঞ্জাবীর কাপড়ের দোকান। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করছে মিস্টির দোকানগুলো। ওদিকে ভীষণ জেদাক্রান্ত মন এসব মায়াবি হাতছানি উপেক্ষে করে স্টেশনে পৌঁছে যাই। মনে মনে মনকে বলি বাড়িতে ফেরার প্রশ্ন তো আসেই না! পুরো বাড়িতে যখন সবাই কাঁদবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিবে, ফিরে আসো সাইফুল বলে, তখন দূর কোন শহরের দোকানে অথবা ছোট কক্ষে বসে প্রতিশোধের হাসি হাসবো। এইসব নিষ্ঠুরতাও মনে মনে হিসেব করে নিয়েছি।

ব্যাগ হাতে বেরিয়ে অসলাম। ব্যাগ মানে একটু মোটা পলিথিনের ব্যাগ। পাঁচ টাকা দামের তখন। যাতে কয়েকটা কাপড় আর নিজের কারিগরি কয়েকটা স্টেশনরি টুলস। ব্যাগ নিয়ে আসার সময় আম্মা বলেছিলেন, 'আর কত জ্বালাবি!' বোন বলেছিলো, 'কামাই নাই তাও আবার রাগ দেখায়!' আব্বা বলেছিলেন, 'সর্বোচ্চ ছয় মাস। যেতে দে।' একজন বড় ভাই বলেছিলেন, 'সবার জানা। তাও এরে চেতাস কেনো? ছাড় দিতে হয়। থেকে যা।' সবার দিকে একবার তাকিয়ে দেখছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম এবার হয়তো লোকেরা ভয় পাবে। দেখলাম সবার চোখের ভাষায় 'যাস না কেনো! যা দেখি কেমন ব্যাটা তুই!' এই কয়েকটা ধ্বনি রাইস মিলের শব্দের মতো ক্রমাগত ধ্বনিত হচ্ছে। ভালোবাসা তো চিনতামই না। অবশ্য কেউ ভালোবাসলে গলে যেতাম। না চিনেও গলে যেতাম। কিন্তু উপহাসটা ঠিকই টের পেতাম। সেটাই দেখেছিলাম আমার একান্ত আপনের চোখে। এর কতোটা তাদের দায় জানি না। তবে আমার উন্নাসিকতা আর উগ্রতার দায় ছিলোই। অবশ্য আম্মার চোখে পানি ছিলো। তবে সেইটে ভালোবাসার না ছেলেটার উচ্ছন্নে যাওয়ার কষ্টে, বুঝতে পারিনি।

টিকিট করিনি। টাকা সঞ্চয়ের ভুত চেপেছে ঘাড়ে। আর বেকার বলে একটা হেডম তো ছিলোই। ট্রেন ছেড়ে দেয়। আমার গলায় দলা পাকানো কান্না। কিন্তু এতো বছর পরে এসে বুঝি এই কান্না ছিলো আসলে নিজের বৃত্তে নিজেকে তৈরি করতে না পারার সাবকনশাস মনের আন্দোলন! ট্রেন চলছে। নান্দাইল রোড স্টেশনে যাওয়ার আগেই শত্রুর মতো নেভি ব্লু কোটের টিটি এসে হাজির। ডাকের ছোট বাজারের ইজারাদারের মতো অন্য দিকে চেয়ে বলে, 'টিকিট'। হঠাত করে সকল হেডম শেষ। আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই টিটি জরিমানাসহ টিকিট লিখতে শুরু করে। বগলপকেটে হাত দিই। পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। পকেটই নাই। টাকা তো দূর কি বাত! টিটি দয়ালু ছিলেন। নামিয়ে দিলেন। চিরচেনা নান্দাইল রোড স্টেশন। অথচ এই সন্ধ্যায় মনে হচ্ছে গুপ্তধনের মতো কখনোই দেখিনি এই স্থান।

সব ক্ষোভ বাতাস লাগা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো চিমসে হয়ে যায়। ব্যাগ হাতে একা। সন্ধ্যার পথে ভয়ে ভয়ে ফিরছি বাড়ির পথে। ভেতরে পরাজিত কোন সেনাপতির মতো মরুশুষ্কতার অনুভূতি। কীভাবে উঠবো ঘরে! সকল যুক্তি আর লজ্জা তখন পেটের চিৎকারের কাছে পরাজিত। অনেকগুলো চোখের কল্পিত বাঁকা চাহনি অগণিত মাছির মতো বিরক্তি নিয়ে চারপাশে এসে বারবার বিম্বিত হচ্ছে। আমি হাঁটছি। পূর্ব দিকের পথ দীর্ঘ হচ্ছে। মনে হচ্ছে রাতে নয় পরকালে হাঁটছি।

রাত আটটার মধ্যে আমাদের ঘরের আলো নিভে। ঝিঁঝিঁদের ছাড়া কেউ সজাগ থাকে না। রাত বারোটায় খুব সন্তর্পনে ডাকি আম্মা! যেনো নবীজীর অপেক্ষায় আবুবকরের দাঁড়িয়ে থাকার মতো আমার আম্মা দরোজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

রাগ পড়ে এলে আম্মাকে চিনা যায় সহজে। আব্বা তো বুঝতেই দেন না ছেলে পরাজিত হয়েছে। বোধ জাগলে আর কোন অনুযোগ থাকে না। থাকে না অভিমানের কোন শীতলতা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৫:৫৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলমানেরা ভাগ্যন্নোয়নের জন্য পশ্চিমে গিয়ে, পশ্চিমের সংস্কৃতিকে হেয় করে ধর্মের নামে।

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২০



এখন পশ্চিম চাহে যে, মুসলমানেরা যেন "ভাগ্যান্নষন"এর জন্য তাদের দেশে আর না যায়; কারণ, মুসলমানেরা পশ্চিমের সংস্কৃতিকে হেয় করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। একই আব্রাহামিক ধর্মের লোকজন হলেও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অতঃপর সচিবালয়ের সেই পুড়ে যাওয়া কুকুর

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:০০




সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আর পাল্টাপাল্টি দোষারোপের কারণে তদন্ত রিপোর্টে কী উঠে আসে সেটি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল অনেকের। দুই দিকের আলাদা কক্ষে আগুন লাগা, কুকুরের মৃতদেহ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭২-এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ২০২৪-এর অর্জন না

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ ভোর ৫:৩৯


৭২-এর রক্তস্নাত সংবিধান বাতিল করে । নিজেদের আদর্শের সংবিধান রচনা করতে চায় এরা‼️বাংলাদেশের পতাকা বদলে দিতে চায়! বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ভালো লাগেনা এদের!জাতিয় শ্লোগানে গায়ে ফোস্কা পরা প্রজন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আয়নাঘর শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েও ছিল

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, আয়নাঘর শুধু ক্যান্টনমেন্টেই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল এমনকি ব্যক্তিগত বাড়িতেও ছিল। আপনারা শুধু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১১:০০

প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় এখন আর কেউ নিজের মতো হতে চাই না, হতে চাই বিশ্ববরেণ্যদের মতো। শিশুকাল থেকেই শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সব ছাত্রদের মাথায় জিপিএ ৫, গোল্ডেন পেতে হবে! সবাইকেই ডাক্তার,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×