১.
'সময় পাল্টেছে' এই কথাটা শুনি সকাল, বিকাল। 'মেয়েরা পুরুষের সমান তালে কাজ করছে', 'নারী পুরুষের সচেতনতা বাড়ছে' 'ছেলে অার মেয়ে সন্তানের বৈষম্য নেই' এই কথাগুলো বলার সময় চকচকে চোখ দেখেছি অনেকের, অাড়ালে তাদের কটাক্ষ দেখেছি। এসব বিষয়ে দুলাইন যতবার লিখেছি বা বলেছি ততবার নানা বিশেষণের তকমা পেয়েছি। বলা বাদ দিয়ে অামি এক সময় স্রোতে মিশে গেছি। ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিয়েছি কথার বাহার। তবু নিজের সনাতন চরিত্র বদলাতে পারিনি। খালি মানুষের জীবনের অানন্দ-কষ্ট ফেরি করে বেড়ালে হয় না, দুকলম লিখতে পারার দায়ও অাছে। নিজেকে জলসিক্ত হাঁসের মতো ঝেড়ে নিয়ে দুকলম লিখতে মন চাচ্ছে।
সকালের অাবেগগুলো সতেজ থাকে। রাতের স্বপ্ন না দেখা গভীর ঘুম ভেঙে উঠে মোবাইলে মেইল, নোটিফিকেশন চেক করার এক ফাঁকে প্রিয় স্বজনদের খোঁজ নেই। একটা ফোন পেলে মা, বোনেরা কেমন অাপ্লুত হয়ে যায়। যেনো রথের মেলায় হারিয়ে ফেলা অামাকে রোজ সকালে খুঁজে পায়। অাজ হঠাৎ নিজে খুঁজতে গিয়ে দেখি তাদের নিয়ে কত কথা হয়নি বলা যা অন্যদের জানা দরকার, জানানো দরকার।
অামাদের মেয়েদের শরীর বড় অদ্ভুত। মহান সৃষ্টিকর্তা অদ্ভুত এক শরীর দিয়েছেন যাতে স্তরে স্তরে গর্ত করে ফেললেও অাবার তাল তাল মাটি এসে ভরাট করে দেয়। একটা মেয়ের নিপাট ভাঁজের অাকর্ষণীয় শরীরটায় প্রথম ক্ষত হয় তার মাতৃত্বে। মা হবার শুরুর অানন্দের সাথে সাথে মেয়েটা বিস্ময় নিয়ে দেখে তার তলপেট, বাহু, উরুসন্ধির মতো সবচেয়ে স্পর্শকাতর অার অাকর্ষণীয় স্থানগুলোতে ফাটল ধরে। মনে হয় শরীর চিড়ে চিড়ে স্বপ্নরেখা ফুটছে। অামার নানী বলতেন, এই দাগরে বলে যৌবনফাটা দাগ। এই যে ফাটল, দেখবা যৌবন অার নাই।
এই নাযুক্তি মাতৃত্বকে সাদরে মেনে নিয়ে মেয়েরা মা হয়ে যায়। অধিকাংশ মা মাতৃত্বের সাথে সাথে শরীরের পেলব ভাঁজ হারিয়ে ফেলেন। কোনো এক দুপুরে খন্ডিত অবসরে অায়নার সামনে নিজের শরীরের স্থূলতা দেখে কাতর হন।
অামার পরিচিত একজন মায়ের কথা বলি, অামাকে দেখলেই তিনি বলবেন, তিন তিনটা বাচ্চা হলো, পেটটা দেখেছো কেমন অামার? থলথলে, মনে হয় ভিতরে অারো একটা অাছে, অাহারে কত সুন্দর ছিল এই পেট! সেলাই অংশের উপরে বেখাপ্পা ঝুলে থাকা পেটের উপর হাত রেখে তিনি যখন কথাগুলো বলেন, অামি মাঝে মাঝে তাকে প্রশ্ন করি, অাপা, অাফসোস লাগে? 'অারে নাহ্, অামি মা না?' অাপার মুখের ভুবনজুড়ানো হাসি দেখে অামিও ভুলে যাই নিজের শরীরের কথা।
২.
মা-বাবাকে অার কিছু না হোক রূপকথার গল্প জানতে হয়। রাজা-রানির গল্প। দত্যিদানোর গল্প। তবে ঘুঁটেকুড়ানি মায়ের গল্প, মায়ের পেটে সাপ-ব্যাঙ হবার মতো কল্প-গল্প অাজকালকার ছেলে-মেয়েকে শোনানো যায় না। তর্কে হেরে যেতে হয়। ঘুঁটেকুড়ানি মায়ের দুর্দশার গল্প বাচ্চাদের নিদারুণ অপছন্দের। অাপনি একবার পরীক্ষা করেই দেখুন না, যেই বলবেন এক রাজার ছিল সাত রাণি....দেখবেন অাপনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিবে। অামরা যেসব ফ্যান্টাসিতে ভুলতাম তারা সেসবে ভোলে না। অামাদের ফাঁকি দেয়া সহজ ছিল। এখনকার বাচ্চাদের ভোলানো সহজ না।
যাহোক এই অংশে ভূমিকার কারণ হচ্ছে একটা গল্প দিয়ে শুরু করছি। বাবা-মায়ের কাজের ভাগাভাগিতে সকালে ছেলে স্কুলের জন্য তৈরি হয়। বেখেয়ালে টিফিনবক্স ঢোকানো হয়নি। সন্ধ্যায় অভিযোগ,
-মা, অাজ তুমি অামার টিফিন দিতে ভুলে গেছো।
-তাপ্পর।
-মিস, টিফিন এনে দিলো।
-মিস টিফিন কোথায় পেলো! জাদু করে অানলো? নাকি পরী দিলো মিসকে?
ছেলের বিস্মিত চোখে তাকিয়ে অামি হাসি। ছেলের সেই পরীটা যে তার মা সেটা বুঝে অামার ছেলে অামাকে জড়িয়ে ধরে। বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য কত কসরৎ অামাদের। সেই খাবারের কথা ভুলি কি করে!
অামি জানি, কম বেশি অামরা বাবা-মায়েরা ছুটি বাচ্চাদের পেছনে, এট্টু দুধ খা সোনা। দুধের মতো বোরিঙ পানীয়কে অাকর্ষণীয় করতে হরলিক্স, কর্নফ্লেক্স ব্যবহার করি। নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু হাড়ের যাতনা অাড়াল করতে করতে বলি, খেয়ে নে, হাড় মজবুত হবে, শরীরে বেড়ে উঠবি।
অামাদের মা-বোনের চওড়া সিঁথি থেকে শুরু করে হাড়ের ক্ষয়টা পর্যন্ত তাদের মাতৃত্বের চিহ্ন বহন করে। পুরনো অ্যালবামের সোঁদা গন্ধে লেপটে থাকা মায়ের পুরনো ছবিতে খেয়াল করলে দেখবেন, পরচুলার মতো মাথা ভরা চুল ছিল। প্রতিবার সন্তান জন্মদানের সাথে সেই চুলের গোছা পাতলা হয়েছে। নিজের যত্ন নেয়া অপ্রয়োজনীয় ভেবে নিজের দিকে ফিরে তাকায়নি।
ঠিক একই ভাবে অাজো পরিবার অার বাচ্চাদের পথ খুঁজে দেবার সাথে সাথে দুদন্ড জিরিয়ে নেয়াটাও যে জরুরি সেটা বেশিরভাগ মায়ের মনে থাকে না। নিজের সুস্থতার জন্য, তারুণ্যের জন্য যে অবসরটুকু মেলানো জরুরি তা তারা খুঁজে পান না। সংসারের যাবতীয় কাজ করার সময় থাকে কিন্তু নিজেকে ফিট করার জন্য সময় থাকে না।
নিজের অজান্তেই একদিন অামি, অাপনি সেই পুরনো কাতারেই দাঁড়িয়েছি। পার্থক্যটা হলো, হাল ফ্যাশনের অাড়ালে চুলের স্টাইলে সিঁথির প্রসারতা কায়দা করে ঢেকে রাখি। ঠিক যেভাবে যুগে যুগে মায়েরা তাদের অন্তর্গত বেদনাগুলো ঢেকে রেখেছে।
৩.
অামি যখন কলেজে পড়ি তখন প্রথম জানলাম মেয়েদের কিছু অসুখ হয়। যা মেয়েদের শরীরের সাথেই যায় যেমন স্তন ক্যান্সার (পুরুষেরও হয়, সম্প্রতি জেনেছি), জরায়ু ক্যান্সার, ওভারি-ইউট্রাসে জটিল ধরণের সিস্ট বা টিউমার বা ক্যান্সার ইত্যাদি। স্পর্শকাতর অঙ্গের জটিল অসুখগুলো নাকি শেষ পর্যায়ে টের পায় রোগী। তখন শরীরের আট কুঠুরি নয় দরজার জটিলতার সব কিছু মাথায় রাখার মতো বয়স না আমার। তবু মনে আছে একদিন পত্রিকায় অার্টিকেল পড়লাম স্তন ক্যান্সার বিষয়ে সতর্কতা আর নিজের স্তন পরীক্ষা করার পদ্ধতি।
অামি সেই সময়ে অবাক ভেবেছিলাম অামার পরিবারে অতগুলো মেয়ে সদস্য কোনোদিনও তো অামাকে সেই বিষয়ে সতর্ক করেনি! যেই মেয়ের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের দিকে মা দিনরাত দরজায় চোখ রাখে, যেই মেয়েকে নিজ হাতে চুল বাঁধা থেকে ঘরকন্না, পড়াশুনো শেখায় সেই মেয়েকে কোনোদিনও তো মা শেখায়নি এই বিষয়টা! মায়ের উপর রাগ করা যায় কিনা বুঝতাম না। নাকি মায়ের অজ্ঞতায় করুণা করা যেতো তাকে বুঝতাম না। তবে কালে কালে জগতের ফিসফাসে কান পাততে পাততে বুঝলাম এসব বিষয় শরীরের নাজুক অংশের মতো ঢেকে ঢুকে দিনকাল পার করেছে মায়েরা।
অামরা যারা এগিয়ে চলেছি তাদের ভেতর ঠিক কত সংখ্যক মা বাবা অাছেন যারা নিজের মেয়ে সন্তানকে নিজের স্তন পরীক্ষা করতে শেখান, সচেতন করেন, অামি জানি না। তবে অামি করতে চাই। স্তন ক্যান্সার, স্তন টিবি, সন্তান জন্মদানের পর দীর্ঘ বছর ধরে বুকে দুধ জমে থাকার পরে সৃষ্ট হওয়া পিন্ড, এসব অসুখগুলো ঘুণপোকার মতো অামার মেয়ের, মায়ের, বোনের, পরিচিতের শরীরটা যেনো গোপনে ঝাঝরা না করে ফেলে সেজন্য মুখের দুয়ারটা অালগা করবো। জ্বরজারি থেকে শুরু করে ক্যান্সার হয়েছে প্রকাশে সংকোচ না থাকলে স্তনের অসুখেও থাকবে না। তাকিয়ে দেখুন অামাদের চারপাশে অনেক ব্রেস্ট ক্যান্সার সারভাইভর অাছেন। নাহ্, বিশেষভাবে তাকানোর দরকার নেই। তিনি জগতের সামনে নিজেকে বিশেষ করে দেখানো পছন্দ করেন না। যতোটা অামরা করি।
সেদিন একজন স্কুল শিক্ষিকা অাপার সাথে জুতার দোকানে দেখা। বললেন, ভালো অাছি অাপা। সেই অাপার শরীরের কমতিটুকু তার স্নিগ্ধ হাসি পূরণ করে দিলো। অাশেপাশের অনেককেই দেখলাম, পাশ দিয়ে যাবার সময় গা টিপাটিপি করছে, অাপার স্তনহীন শরীর যেনো তাকে দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত করেছে। কিন্তু অাপার সঙ্গী হাজবেন্ড, মেয়ের প্রাণোচ্ছল খুশিতে বুঝলাম ক্যান্সারের মতো অনেক জীবাণুকে তারা ঝেঁটিয়ে তাড়ান।
'অ্যাই চুপ, এসব বিষয় থাক, থাক' এসব বলার দিন কি অাসলেই ফুরিয়েছে? বুকে হাত রেখে বলুনতো! ফুরায়নি। আমরা বলি এখনো। এখনো এসব রোগের কথা উঠলে গলার স্বর নিচু করি। জরায়ু ক্যান্সার, ওভারি-ইউট্রাসে জটিল ধরণের সিস্ট বা টিউমার বা ক্যান্সার ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার মতো জ্ঞানের বিস্তৃতি আমার নেই। তবু আমি এখন জানতে চাই। জানাতে চাই আরো পড়তে চাই। বুঝতে চাই। সংকোচ ঝেড়ে ফেলে সবার সাথে বিষয়গুলো ভাগাভাগি করতে চাই।
আর কিইবা করতে পারি? আপনি বা অামি কি শরীরের অংগ হারানো মানুষের বেদনাটা নিজের শরীর দিয়ে বুঝতে পারবো? পারবো না। শব্দের রিফুতে মানুষের মনের ক্ষতে প্রলেপ দেয়া যায় কিন্তু ক্ষতের কষ্টটা বোঝা যায় না।
(২০ অক্টোবর, ২০১৬, মেয়ে পেইজে প্রকাশিত)