ঘর পালানো ঘোর
১. স্থির চিত্রে ডার্ক নেচার
রাস্তার পাশে কংক্রিটের দেয়ালে ঠেস দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে ছেলেটি। মাঘের এই কনকনে ঠাণ্ডার ভেতরে ছেলেটির পরনে একটা মলিন নীল জ্যাকেট আর ধূসর রঙের পাতলা একটা কম্বল বুক পর্যন্ত টেনে রাখা। গরম কাপড়ের আচ্ছাদনে থাকলেও ছেলেটির শীতে কাতর মুখটি দেখে ওর বয়স দিব্যি আন্দাজ করা যায়। এই আঠার-ঊনিশ হবে। মুরাদ ওর স্বভাবজাত কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যায়। ঠাণ্ডার তীব্রতার মাঝেও ছেলেটি দিব্যি ঘুমাচ্ছে। ঠিক ঘুমাচ্ছে না। তন্দ্রাভাব। কারণ ছেলেটি কিছুক্ষণ পর পর ওর অপরিচ্ছন্ন গালে বসা পেটমোটা একটি অবাধ্য মাছিকে ডান হাতে সরিয়ে দিচ্ছে।
রাস্তার পাশের গলির মুখে ময়লার স্তূপ। ময়লা ফেলার বেষ্টনী পর্যন্ত যাওয়ার আগেই বোধহয় মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে তাই সেই বেষ্টনীর ভেতরের বদলে বাইরে জমেছে ময়লার স্তূপ। ছেলেটি সেই ময়লা থেকে গজ দুয়েক দূরে বসা। তাই যতবার ও গালের মাছি তাড়াবার চেষ্টা করছে ততবারই বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মাছি ছেলেটির মুখের উপর বসছে। মিনিট খানেকের মধ্যেই এরা সব দলে দলে এসে হাজির হলো। মাছিদের অত্যাচারে ছেলেটি একটু সোজা হয়ে বসলো। পাশে দাঁড়ানো অপরিচিত মানুষের উপস্থিতিতে তাকে মোটেও বিচলিত মনে হচ্ছে না। ঘোলাটে চোখে মুরাদের দিকে একবার তাকিয়ে সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।
লেন্স কভার সরিয়ে মুরাদ ছবি তোলার প্রস্তুতি নেয়। মুরাদের এই সাথীটি নতুন। ক্যামেরার কাভারে আনকোরা গন্ধ। পুরনো সাথীদের এখনও বিদায় দেয়নি মুরাদ। কিন্তু প্রিয় মানুষের দেয়া নতুন কোনো উপহার ব্যবহারে সে বরাবরই আনন্দ পায়। ক্যামেরা নতুন হলেও ছবি তোলার কাজটা মুরাদের জন্য নতুন নয়। কলেজে উঠে শখের বসে ছবি তুলতে তুলতে এখন মুরাদ হাসান এদেশের অন্যতম আলোকচিত্রী। মফস্বলের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা শহরের বোদ্ধা মহলে মুরাদ এখন প্রিয় এক নাম। গত ডিসেম্বরে দৃক গ্যালারিতে মুরাদের তৃতীয় আলোকচিত্র প্রদশর্নী হয়েছে। খ্যাতনামা দৈনিক আর সাপ্তাহিক পত্রিকাতে যুক্ত থাকার পাশাপাশি আজকাল পোট্রেট, স্ট্রিট ফটোগ্রাফি, ডেইলি লাইফ, ল্যান্ডস্কেইপ, ডার্ক নেচার এসব থিমের ভিডিও চিত্রও তৈরি করছে মুরাদ।
তবে পেশার চেয়ে বেশি নেশার মোহে নিজের পরিচিত পথে দিন রাত মুরাদের ছুটে চলা। কখনো বাসে, কখনো রিকশায়, মোটর সাইকেল কিংবা ভ্যানে করে অবিরাম ছুটে চলা। আবার কখনো দুই পায়েই ক্লান্তিহীন বিচরণ। চলমান চিত্রকে ক্যামেরার মাঝে স্থির করে তবে শান্তি। মাঝে মাঝে সময়ের প্রয়োজনে ক্যামেরার ব্র্যান্ড বদল হলেও গলায় ঝুলানো সাথীর কোনো অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটেনি।
তবে আজকের এই ক্যামেরাটি যথার্থই নতুন সঙ্গী বটে। এসএলআর এর হাই রেজুলেশনের ক্যামেরাটি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে মিতু এনেছে। গত মাসে মিতু দিন দশেকের জন্য ওদের ইন্ট্যারন্যাশনাল আর্গানাইজেশনের হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে কী এক কর্মশালায় ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়েছিল। ফিরে এসে মিতু ক্যামেরাটি মুরাদের হাতে দিয়ে প্রাপকের চেয়েও বেশি খুশি হয়েছিল যেন। মুরাদ হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়ে। সকালে বের হওয়ার সময় মিতুকে বলে আসেনি। কম্বলের ওমে মিতু এত আরামে ঘুমাচ্ছিল যে ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। অবশ্য মুরাদের এই হঠাৎ বের হয়ে যাওয়াতে বিয়ের দশ বছর পর এখন আর বিচলিত হয় না মিতু।
সন্তানহীনতা দু'টি মানুষের নৈকট্যকে বাড়িয়েছে শতগুণ। তাই দুইজনের যাপিত জীবন নিয়ে নিজেদের ভেতর কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই।
মুরাদ ছেলেটির একেবারে পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। এইবার ও ছেলেটির অপরিচ্ছন্ন চেহারা দেখে বুঝতে পারে, ছেলেটি নেশাখোর। তাছাড়া শীতের এই অসহনীয় সকালে এভাবে রাস্তার ধারে বসে থাকার কথা নয়। ঢাকা শহরের ভাসমান মানুষও এই শীতে মাথার ওপরে একটা ছাউনি খোঁজে। উন্মুক্ত আকাশে রাস্তার ধারে নেশাখোর ছাড়া অন্য কারো পড়ে থাকাটাই অস্বাভাবিক। মুরাদের তীক্ষ্ম চোখ ছেলেটিকে ভালোমত পরখ করতেই চমকে ওঠে। ছেলেটিকে কাছ থেকে টোকাই ধরণের কিংবা কোনো পেশাদার নেশাখোর বিকারগ্রস্ত যুবক বলেও মনে হচ্ছে না। বরং ভোরের কুয়াশা ভেদ করে কাছে আসার পর ওর মুখটির ফ্যাকাশে চামড়ার মাঝেও বেশ একটা কোমলভাব চোখে পড়ছে। সেই সাথে চেহারায় কিছুটা মার্জিত ছাপও রয়েছে। নড়েচড়ে এবার ধ্যানমগ্ন ঋষির মত বসেছে ছেলেটি। মুরাদ এবার সময় নষ্ট করে না। সময়ের সাথে পাল্লা দেওয়া মুশকিল। একটু অবনত হলেই যেন পালিয়ে যাবে কোনো অপরূপ সুন্দর বা হারিয়ে যাবে কোনো অন্ধকার অসুন্দরের স্থিরচিত্র।
২. শব্দের অত্যাচারে বিপন্ন ইন্দ্রিয়
মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে শিমুলের। রাতে কী সবুজের সাথে হাতাহাতি হয়েছিল? সবুজ খুব ত্যাড়ামি করছে আজকাল। নেশার যোগান দিচ্ছে বলে অন্যরা সয়ে যাচ্ছে চুপচাপ। শিমুলের সহ্য ক্ষমতা কম। আসলে ওর সহ্য ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে সেটাই বরং বলা ভাল। কাল রাতে কিছু একটা হয়েছিল বটে নতুবা শিমুল রাস্তায় কেন? আবার সেই শব্দের পুনারাবৃত্তি ঘটেছিল কী? যেই শব্দটি শিমুলের মাথায় ভেতর প্রবল যন্ত্রণার জন্ম দেয় আর কানের ভেতর ঢেলে দেয় উত্তপ্ত সীসা সেই শব্দের তাড়নায় কী শিমুল নেশার আসর ছেড়েছিল? শিমুলের কিছু মনে পড়ছে না। এখন কোথায় যাবে? বাড়িতে যাবে নাকি? নাহ। ফেরার জন্য তো বাড়ি ছাড়েনি সে।
কবে বাড়ি ছেড়েছে শিমুল, মনে নেই। গত রাতে ও সবুজের রুম ছেড়ে কি করে রাস্তায় এলো সেটাই এখন মনে পড়ছে না। আর তো ঘর ছাড়ার গল্প! নেশার ঘূর্ণিতে পাক খেতে খেতে আজকাল শিমুল সব ভুলে বসেছে। সেই ভালো। তবু নেশা ছুটে গেলেই পেছনের দিন গুলো কোথা থেকে যেন সব ছুটে ছুটে আসে। মাথা তখন ঝিমঝিম করে। ভারশূণ্য হয়ে যায় গোটা শরীর। তখন কী এক ঘোরে সে ভাসতে থাকে। আর কিছু নোংরা শব্দের অত্যাচারে ওর শ্রবণেন্দ্রিয় ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে। মুক্তি চাই! মুক্তি! ঘর পালিয়ে এবার নিজের ভেতর থেকে পালানো। তাই আবার নেশার মাঝে ডুব দেওয়া। আবার স্মৃতিভ্রষ্টতা!
মাঝে মাঝে স্মৃতিভ্রষ্টতা মাড়িয়ে পুরনো সময়যান যখন মস্তিষ্ক আক্রমণ করে তখন কেবল মনে পড়ে কতিপয় শব্দের অত্যাচার ওর জীবন নরক করে তুলেছিল। আর ও ছিল নরকের কীট। এই যে পাশের ডাস্টবিন ছেড়ে ডুমো ডুমো মাছিগুলো ওর নোংরা গালে-মুখে উড়ে উড়ে বসছে, যখন ও ঘর ছাড়েনি তখনও বসতো। পড়ার টেবিল ছেড়ে ব্যালকনি বা খোলা ছাদে উঠেও সেই মাছির হাত থেকে রক্ষা নেই। গালে, কানে নতুবা শরীরের অন্যান্য স্থানে ওদের নোংরা আক্রমণ শিমুলকে যেন পাগল করে তুলতো। যেন শিমুল কাঁঠালভাঙা আবর্জনা!
থেমে থেমে শব্দের অত্যাচার, বিদ্যাপীঠের গণ্ডিবদ্ধতা আর অভিভাবকময় জীবন খুব ভারি লাগছিল শিমুলের। অথচ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত শিমুলের বিলাসী জীবনে বস্তুগত কিছুর জন্যই তার ধারাবাহিক প্রতীক্ষা করতে হতো না। বিত্তবান বাবার সন্তান হবার সুবাদে না চাইতেই সব পেতো সে। তাই প্রতীক্ষার অভিজ্ঞতা তার নেই বললেই চলে। তবু কী এক শূণ্যতায় যেন দিন দিন ঘিরে ধরছিল শিমুলকে! সেই সাথে ওর কৈশোরের চপলতা নিস্পেষিত হচ্ছিল কতিপয় শব্দের অত্যাচারে।
যে বয়সে ছেলেরা পুরুষসুলভতা দেখাতে যেয়ে ভেতরে ভেতরে দুর্দান্ত উত্তেজনা বোধ করে, সেই বয়সে কী যে হয়েছিল ওর। উপভোগ করা তো দূরের কথা দিন দিন নিজের আভ্যন্তরীণ দুর্বোধ্যতা তাকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। তাই বিশাল ডুপেক্স বাড়ির ড্রয়িংরুমে সাজানো মানুষসম শোপিসের মত নিজের ঘরে নিজেকে অন্তরীণ করে রাখতো শিমুল। কষ্টের ভাগ নিতে ক্ষণে ক্ষণে আসতো মা। মা...মা। বারকয়েক মা ডাকতেই শিমুলের বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। কোনো সুখ স্বপ্নের মাঝখানে ঘুম ভেঙে গেলে যেমন ঐ আধখানা স্বপ্নের জন্য বুকের ভেতর আকুতি থাকে বহুক্ষণ তেমনই মায়ের মুখটি আধখানা সুখ স্বপ্নের মত শিমুলের বুকের ভেতর ভালোলাগার জন্ম দেয়। আচমকা আবার সেই ঘোরগ্রস্ত আচ্ছন্নতা থেকে জেগে ওঠে শিমুল। মা! কতদিন দেখে না মাকে!
শিমুল মায়ের চওড়া সিঁথির দিকে তাকিয়ে থাকতো আর দিনবদলের গল্প শুনতো। দুপুরে খাওয়ার পর থেকে ঘন্টা খানেক চলতো মা ছেলের এই পাঠচক্র। একসময় ক্লান্ত বক্তা মা ঘুমিয়ে গেলে শিমুল মায়ের মাথায় হাত বুলাতো আর মায়ের ছোট মুখটি মনোযোগ দিয়ে দেখতো। শিমুল ঠিকই ধরে ফেলতো ঠিকাদার সফিউদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী তায়েবার মুখে জুড়ে কষ্টের মানচিত্র আঁকা। মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ও টের পেত মায়ের মাথার সিঁথি ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। ও অনেকদিন দেখেছে চুল আঁচড়ালেই এক গাদা করে চুল আসতো মায়ের চিরুনিতে। অন্য সব পয়সাওয়ালা লোকের স্ত্রীদের মতন শিমুলের মা সৌন্দর্য চর্চা জানতো না। তাই মায়ের ভেতর নিজেকে সুন্দর করে তোলার কোনো স্বয়ংক্রিয় আয়োজন ছিল না।
আসলে জ্ঞানের বা সময়ের অভাব ছিল না মায়ের। শিমুল ঠিকই বুঝতো অসুন্দরের ভেতর বাস করতে করতে মায়ের সেইসব বোধের চির মুক্তি ঘটেছিল। যতদিন খেলনা গাড়ি আর প্লেন নিয়ে শিমুল ব্যস্ত ছিল, মায়ের মুখের রেখা গণনা করতে যায়নি সে। একদিন সেই ভুল করতেই সব বিপত্তি! মা যেন ইতিহাসবেত্তা! কত কী জানে মা! মায়ের একাগ্র গল্প বলায় শিমুলের চোখের সামনে দিনদিন স্পষ্টতর হয়ে ওঠে ফেলে আসা সময়। মায়ের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধ আর ঠিকাদার সফিউদ্দিনের ভাষায় গণ্ডগোলের সময়। ছেলেবেলায় শেখা শব্দগঠনের অর্থ যেন মায়ের কাছ থেকে নতুন করে বোঝে সে। ক্রমশ সেই শব্দের অত্যাচার তীব্র হয় আর সেই সাথে মাথায় বাসা বাঁধে ঘর পালানো ঘোর।
৩. ঘর পালানো ঘোর
ঘোরের ক্রমাবর্তে ডুবতে ডুবতে শিমুল ভেসে ওঠে। যেন গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে, সেই তাড়নায় চট করে উঠে দাঁড়ায় ও। পটভূমির পরিবর্তনে মুরাদ চমকে গিয়ে ওর শিল্পী চোখ প্রসারিত করে। পুনরায় ঘোরের গ্রহণে তলিয়ে যাবার আগেই শিমুল মুরাদের সেই অভিজ্ঞ চোখে তাকিয়ে দ্বিধাহীন প্রশ্ন করে,
-তোমার বাপ কি রাজাকার?
অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে মুরাদ চমকে যায়। উত্তর জানা তবু সেই উত্তর বের হয় না মুরাদের মুখ থেকে। এবার ছেলেটির নিষ্প্রভ চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রশ্নকর্তা এবার প্রশ্নের বদলে সরাসরি উত্তর ছুঁড়ে দেয় মুরাদের দিকে,
-আমার বাপ রাজাকার ছিল। এখনো রাজাকারই আছে।
মুরাদ আর শিমুলের থমকে থাকা দৃশ্যপটে এই ঘোর কুয়াশার মাঝেও অদ্ভুত সুন্দর এক স্থিরচিত্রের সৃষ্টি হয়।