স্থানীয়রা শহরটিকে ‘দ্য সিটি অফ ডেড’ নামেও অভিহিত করে থাকনে। এটি এমন এক শহর যেখানে কোনো মানুষ বসবাস করে না। অনেকে একে ভূতুড়ে শহরও বলে থাকে। গুয়াংজি ঝুং চীনের এক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এই অঞ্চলেরই দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি শহর ‘বেইহাই’, চীনা ভাষায় যার অর্থ ‘উত্তরের সমুদ্র’। শহরের উত্তর দিকে রয়েছে গাল্ফ অফ টনকিন সমুদ্র বন্দর। চীনের একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
চীন সরকারের ধারণা ছিল, শহরটি ২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। আর এই কারণে সমাজের ধনী শ্রেণীর জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল বিলাসবহুল বাড়ি। আশা করা হয়েছিল, সরকারের এই রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের ফলে সরকার আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান হবে।
আর এ লক্ষ্যেই পুরো শহরজুড়ে বড় বড় চওড়া রাস্তা, ফুলের বাগান, পার্ক, নান্দনিক লেক, অত্যাধুনিক ফোয়ারা, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাথরের মূর্তি, আর রয়েছে মার্বেল পাথরে তৈরি বাড়ি। সাজানো-গোছানো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন বাড়িগুলোতে রয়েছে নানা রকমের আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা। অট্টালিকাগুলোর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন বেশ আকর্ষণীয়।
শহরের কোনো কোনো বাড়ির মূল্য চীনা মুদ্রায় প্রায় ৩ মিলিয়ন ইয়েন, বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। আবার কিছু কিছু বাড়ির মূল্য তারও বেশি। তাছাড়া কোনো কোনো আবাসনের সাথে জলধারাসহ ছোট ছোট লেকেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার মূল্য সবচেয়ে বেশি। শহরটি বছর ছয়েক আগে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মানুষ সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করেননি। আর এভাবেই নৈসর্গিক ভূদৃশ্যসম্পন্ন এক শহর নির্জনতায় রূপ নিয়েছে।
এসব অট্টালিকা, পার্ক থেকে নানা অত্যাধুনিক বিনোদন ব্যবস্থা তৈরিতে বিনিয়োগকারীরা যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তা ফেরত না আসায় বিনিয়োগকারীদের অবস্থা তথৈবচ। আজ পর্যন্ত একটি অট্টালিকাও বিক্রি করা যায়নি। ফলে খালি অবস্থায় পড়ে রয়েছে এই বিশাল বিশাল আবাসনগুলো। বিনিয়োগকারীরা এসব আবাসনগুলো তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি, শহরের অধিবাসীরা শহরেই নিজের থাকার ব্যবস্থাসহ শহরের আশেপাশেই যাতে নানা কাজকর্মের সুযোগ-সুবিধা পায়, তার জন্য শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছিল নানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা মনে করেছিলেন এর ফলে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ স্থান সহ বিভিন্ন সম্পদের মূল্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে এবং এর মাধ্যমে তারা ব্যবসায়িকভাবে বেশ লাভবান হবেন। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। কিছু অর্থবান ব্যক্তি কয়েকটি বাড়িসহ প্লট কিনলেও পরবর্তীতে এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বেশি হওয়ায়, সে স্থান ত্যাগ করেন। ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য এক ভয়ার্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীরা এই শহরের উন্নয়নের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
চীনে ১.৩ বিলিয়ন লোকের বাস। এতো বিশাল জনগোষ্ঠী থাকার পরেও এই বাড়িগুলো বিক্রি না হওয়া এক কথায় অবিশ্বাস্যও বটে। চীনে নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। আবার বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলো বিভিন্ন জায়গায় খালি পড়ে থাকা জায়গার মালিকদের এসব কনস্ট্রাকশন হাউসগুলো বরাদ্দ দেয়ার জন্য বাধ্য করেন। স্থানীয়দের মতে, এটা একধরনের পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ চীনের সাধারণ জনগণের পক্ষে এই বাড়িগুলোর ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব কিনা তা-ও ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করেন তারা। আর তা না হলে এভাবে বিভিন্ন নগরীতে সুন্দর সুন্দর আবাসন ও বাংলো তৈরি করা যাবে বটে, কিন্তু তা থেকে যাবে বিক্রয়সীমার বাইরে।
কিন্ত কেন এই বিলাসবহুল অট্টালিকাগুলো বিক্রি হচ্ছে না? এর পেছনে জট বেঁধে দাঁড়িয়েছে অনেক প্রশ্ন। কারো স্থায়ী নিবাস হিসেবে কি এই জায়গাটি পছন্দ হচ্ছে না? তার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নানা তথ্য।
এই আবাসিক এলাকার প্রধান সমস্যাই হলো, প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা থেকে এই আবাসিক শহর অনেক দূরে অবস্থিত। দৈনন্দিন জিনিসপত্র ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে গেলেও মূল বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে অধিবাসীদের যাওয়ার প্রয়োজন হয়। অত্যধিক দাম, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অপ্রতুলতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা- এসব কারণেই এখানকার বাংলো বিক্রি হয়নি। ফলে অত্যাধুনিক সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ছয় বছর ধরে ফাঁকাই পড়ে রয়েছে এই এলাকা। তবে বাইরে থেকে দেখতে সাজানো-গোছানো মনে হলেও ক্রেতার অভাবে ভেতরের কাজ এখনো কিছুই শেষ করতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা।
স্থানীয়দের কাছে অবশ্য এই শহর ‘দ্য সিটি অব ডেড’ অর্থাৎ ‘মৃতদের শহর’ বলেই পরিচিত। একটাও বাংলো বিক্রি না হওয়ায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
চীনা নাগরিকদের বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য সরকার থেকে কোনো অনুমতি দেয়া হয় না এবং সরকার তা কঠোরভাবে মনিটর করে। চীনা নাগরিকদের তাদের যেকোনো ধরনের বিনিয়োগ নিজের দেশেই করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চীনের অর্থনীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রচুর টাকা অনেক বিত্তশালী ও ব্যবসায়ীদের রয়ে যায়। ফলে সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করতে চান এমন ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন শহরে বড় বড় অট্টালিকা, মহাসড়ক, শপিং মল, পার্কসহ নানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে থাকে। তাদের লক্ষ্য থাকে এসব খাত থেকে নানাভাবে আর্থিক লাভবান হওয়া। কিন্তু এসব আবাসনস্থানগুলো মূল ব্যবসায়িক কেন্দ্র হতে বেশ দূরে হয়ে যায় এবং ঐসব জায়গার জীবনযাপন ব্যয় অত্যাধিক হওয়ায় সাধারণ বা মধ্যবিত্ত নাগরিকরা স্থানগুলো এড়িয়ে চলেন।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে শহরটি লোকশূন্য অবস্থায় রয়েছে। আধুনিক এসব অট্টালিকাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এসব অট্টালিকা আর রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হচ্ছে শহরটি। অনেক নগরবিদের বক্তব্য, বর্তমান চীনের এই আধুনিকায়নই হচ্ছে, ‘বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নগরায়নের গল্প’। এরূপ চলতে থাকলে বেইহাই শহরের মতো চীনের আরো অনেক মহানগরই এরূপ পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে।
এটি সত্যি হতাশাজনক ঘটনা যে, একজন ব্যক্তি কোনো নিশ্চিত রিটার্ন ছাড়া তার জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে পরিবারের জন্য একটি বাড়ি কেনার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে। কিন্তু এ ধরনের বিনিয়োগে পরবর্তীতে যে জীবনধারণের ব্যয়ভার বৃদ্ধি পায় তা সেই ব্যক্তি বা পরিবারের টেনে নিয়ে যাওয়া খুব একটা সহজ হয়ে ওঠে না। আর আবাসন জনগণের চাহিদার কথা চিন্তা না করে শহরের পর শহর বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করা একধরণের বিলাসিতা ও পাগলামি বৈ আর কিছুই নয়। তাই আবাসন ব্যবসায়ীদের এ ধরনের বিনিয়োগ থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে না পারলে বেইহাই শহরের মতো আরো অনেক শহরই পরিত্যক্ত হয়ে পড়বে বলে নগরবিদ এবং অর্থনীতিবিদদের অভিমত।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:৪৭