শিলিগুড়ি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং শহর। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় এর অবস্থান। উত্তরে হিমালয় পর্বত, মহানন্দা নদীর তীরেই ভারতের স্বপ্নের শহর শিলিগুড়ি। মাত্র ৪৮.৩ বর্গ কিলোমিটার নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শহরটি বিস্তৃত। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত প্রাচীন বাষ্পীয় ইঞ্জিনে টানা একটি টয় ট্রেন পাহাড় বেয়ে খাড়া পথ ধরে চলাচল করে, যা ভিনদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। প্রকৃতির বিস্ময়রূপ দর্শন আর শীতের অবকাশে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে ভাসানোর জন্য শিলিগুড়ি অন্যতম।
শিলিগুড়ি শহর; খুব বেশিদিন হয়নি, এই তো ১৯৩১ সালে শহরের মর্যাদা লাভ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু শরণার্থীর আশ্রয়স্থল ছিল প্রাচীন ঐতিহ্যের শিলিগুড়ি।
উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার শিলিগুড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। শহরটির উত্তর-পূর্বে হিমালয় পর্বত ও পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলের মাঝে অবস্থান। শহরের ভিতরে প্রবাহিত মহানন্দা নদী শহরটিকে দুই ভাগে বিভিক্ত করেছে। প্রকৃতির অপরূপ বৈচিত্রের সঙ্গে এখানকার ঋতুবৈচিত্র্যও অসাধারণ। গ্রীষ্মে ৩৫ ডিগ্রি ও শীতে ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এখানকার প্রকৃতি সেজে ওঠে। শীতের এ সময়ে হিমালয়ের পাশে ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা নেমে আসে। পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম আর দ্রুত উন্নয়নশীল আধুনিক শহর, তাও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, কালিম্পং এবং ডুয়ার্স অঞ্চল ছাড়াও গ্যাংটক ও সিকিমের মতো বিখ্যাত পর্যটনস্থানগুলো পাশাপাশি হওয়াতে ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণ ভারতের শিলিগুড়ি। ভ্রমণের পাশাপাশি কেনাকাটার জন্য শিলিগুড়ি একটি আদর্শ পর্যটনস্থান। শীতের অবকাশে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শিলিগুড়ি শহর থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
► কীভাবে যাবেন : শিলিগুড়ি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান শহর। শিলিগুড়ি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু বলা হয়ে থাকে। ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি সরাসরি বিমানে করে যেতে পারবেন। শহর থেকে মাত্র ১৭ কি.মি. দূরত্বে রয়েছে বাগডোগরার বিমানবন্দর। এ ছাড়া শিলিগুড়িতে রেলযোগে পৌঁছানোর জন্য ঢাকা থেকে কলকাতার ট্রেন ধরতে হবে। কলকাতা জংশনে শিলিগুড়ি টাউন, শিলিগুড়ি জংশন এবং নিউ জলপাইগুড়ি জংশন নামের তিনটি ট্রেন পাবেন। শিলিগুড়ি সড়ক দ্বারা ভারতীয় রাজ্য গ্যাংটক ও নেপাল এবং ভুটান দেশের সঙ্গে সংযুক্ত। ঢাকা থেকে কলকাতাগামী বাসে করে কলকাতা হয়ে শিলিগুড়ি যেতে পারবেন।
► ভিসা প্রসেসিং : শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য ভারতের ভিসার প্রয়োজন। বিমানপথ, রেলপথ বা সরকপথ; যে পথই হোক না কেন, শিলিগুড়ি ভ্রমণে ভারতের ভিসা সংগ্রহ করতে হবে। অনলাইনের মাধ্যমে ভারতীয় ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন। ভারতীয় ওয়েব অ্যাড্রেস-http://www.ivacbd.com. ভিসা হতে বেশি সময় নেয় না। শুধু ই-টোকেন পেতে একটু সময় নেয়। ঠিকানা : ভারতীয় ভিসা প্রসেসিং সেন্টার, গুলশান-১ ঢাকা। ফোন : ৯৮৯৩০০৬, ৮৮৩৩৬৩২। সাধারণ বীমা ভবন, ২৪-২৫ দিলকুশা রোড, মতিঝিল, ঢাকা। ফোন : ৯৫৫৩৩৭১।
► কখন যাবেন : ভ্রমণের জন্য সবসময়ই শীতকাল ভালো। খুব গরমে বা বৃষ্টির দিনের ভ্রমণ সুবিধার হয় না। তবে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস ভারতের যে কোনো অঞ্চল ভ্রমণের আদর্শ সময়।
► প্রয়োজনীয় কাগজপত্র : সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি, পাসপোর্টের ফটোকপি ও মূলকপি। বিমান টিকিটের কপি। বাচ্চাদের তিন কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ মায়ের পাসপোর্টের ‘সি’ ফরমে সংযুক্ত করতে হয় (যদি প্রয়োজন হয়)। জাতীয় পরিচয়পত্রের দুই কপি ফটোকপি এবং আবেদনকারী পেশার পরিবর্তন করতে চাইলে চাকরিরত প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক প্রদত্তপত্র, সঙ্গে ব্যাংক সলভেন্সি স্টেটমেন্ট।
► থাকা-খাওয়া : হিমালয়ের পাদদেশে শিলিগুড়ি পর্যটন কেন্দ্র সারা বিশ্বেরই ব্যাপক সমাদৃত। দার্জিলিংয়ের পাশে পৃথিবীর পর্যটন রাষ্ট্রের অন্যতম স্বপ্নরাজ্য হওয়ায় এখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। বর্তমানে অনলাইনের যুগে দেশে বসেই অনলাইনে আপনার পছন্দমতো একটি হোটেল বা রিসোর্ট ভাড়া করতে পারবেন। পুঞ্জীভূত মেঘের কণা ভেদ করে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের ধারে পুরো শিলিগুড়ি শহরে রয়েছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেলে প্রতিদিনের থাকা এবং খাওয়াসহ জনপ্রতি ভাড়া প্রায় ৮৫০-১২০০ রুপি। খরচের দিকে তাকালে হবে না, কথায় বলে না শখের তোলা আশি টাকা।
► দর্শনীয় স্থান : শিলিগুড়িতে দেখার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান রয়েছে। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার আর দার্জিলিং এই তিনটি জেলার কয়েকটি বিশেষ বিশেষ দর্শনস্থান রয়েছে। শিলিগুড়ি, ভারতীয় রেলের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলের মধ্যে পড়ে এবং এখানে মিটার গজ সংযোগ ও পাশাপাশি সংকীর্ণ গজ রেল লাইনও রয়েছে। রেল লাইনটি শিলিগুড়িকে দিল্লির পাশাপাশি, আসামের ডিব্রুগড় ও গুয়াহাটির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। শিলিগুড়ি থেকে কেউ ইচ্ছা করলে শখ করে ‘টয় ট্রেনে’ দার্জিলিং যেতে পারেন। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ‘ন্যারো গেজ’ রেল লাইন পাহাড় বেয়ে সাত হাজার ফুট (২২০০ মিটার) উপরে উঠে গেছে। শুধু শৌখিন যাত্রীদের নিয়ে দিনে একটি ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছেড়ে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং পৌঁছে এবং অন্যটি দার্জিলিং থেকে ছেড়ে নিউ জলপাইগুড়ি আসে। মিরিক হচ্ছে একটি ট্যুরিস্ট স্পট, তাই কোলাহল এবং মানুষের আধিক্যে এখানে বাজার, হোটেল ইত্যাদির ভিড়ের স্থান। বনের ভিতরে অথবা চা বাগানের ঢালে সূর্যের সোনালি আলোতে যে কেউ নস্টালজিক হতে বাধ্য এবং প্রকৃত প্রস্তাবে কেউ যদি এই এলাকার সৌন্দর্য আরোহণ করতে চান তাহলে মিরিকের পরে উপরে কিছু সুন্দর জায়গায় লজ/টি হাউস আছে ওখানে থেকে যেতে পারেন। পর্বতের সৌন্দর্য পর্বতেই পাবেন, একাকী বা কোলাহলমুক্ত নাগরিক সুবিধা থেকে কিছু দূরে গিয়ে পাবেন যেখানে আছে পাইন গাছের উঁচু সারি আর ঢাল বেয়ে নীলাভ সবুজের চা বাগান এবং উপত্যকার ফাঁক দিয়ে বিকালের সোনালি আলোর রাশি। এ ছাড়া শিলিগুড়ির কোচবিহারের রাজ বংশীয়দের মধ্যে ২১ জন মহারাজার ইতিহাস পাওয়া যায়। এদের মধ্যে মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ উল্লেখযোগ্য। কোচবিহারের দ্বিতল বিশিষ্ট রাজ প্রাসাদটিতের নিচতলায় রয়েছে দরবার কক্ষ, তোষাখানা, তোরণদ্বার সমেত চব্বিশটি কক্ষ এবং ছয়টি স্নানাগার। দোতলায় পনেরটি শয়ন কক্ষ, তিনটি বৈঠকখানা, একটি বিলিয়ার্ড কক্ষ, তোষাখানা চারটি, স্নানাগার এগারোটি, মহিলাদের দেখার জন্য গ্যালারি একটি ও তোরণদ্বার একটি। প্রাসাদটি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টে গাঁথা লাল ইট দিয়ে তৈরি। প্রাসাদটির দর্শনীয় এবং লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে লৌহ ধাতু নির্মিত গম্বুজ। রাজ প্রাসাদটি ১৮৭২ সালে তৈরি করা হয়। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৮৭ সালে। জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত ময়নাগুড়ি উপশহরটিতে আনাগোনা ঘটে অত্র অঞ্চলের অনেক লোকজনের। ময়নাগুড়ি এসে দেখা হলো শতবর্ষ পুরনো একটি গ্রন্থাগার। এখানে রয়েছে কয়েক হাজার বিরল বইয়ের সম্ভার। এখানে পেয়ে যাবেন পুরনো ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক বইসমগ্র। সিকিমের পাহাড় থেকে বরফ গলা জলই এই নদী দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পাথর রয়েছে নদীর তীরে। অপূর্ব দেখতে মসৃণ পাথরগুলো। হিমশীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে বনের ভিতর দিয়ে। উঁচু উঁচু গাছের ছায়ায় ঢেকে গেছে বিশাল বনভূমি। সুউচ্চ শাল-সেগুনের এক বিশাল অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি মালবাজারের দিকে। মালবাজারের পরেই পাহাড়ি রাস্তার শুরু। আমাদের গন্তব্য গরুবাথান। আর শহরকে দ্বিখণ্ডিত করা মহানন্দা নদীর রূপ আরও অপরূপ। নদীবক্ষে নৌভ্রমণে বের হয়ে পুরো শহরই ঘুরে দেখতে পারেন।
► কেনাকাটা : শিলিগুড়ি শুধু একটি পর্যটন গন্তব্য নয়, এখানে রয়েছে আধুনিক শহর বাণিজ্যিক কেন্দ্রও বটে। শিলিগুড়িতে রয়েছে কেনাকাটার চমত্কার সুযোগ। এই এলাকার প্রধান ব্যবসা হলো ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প। নান্দনিক ডিজাইনের হস্তশিল্পের জন্য শিলিগুড়ি সারা বিশ্বেই সেরা। খাঁটি দার্জিলিং চা কেনার জন্য শিলিগুড়ি অবশ্যই একটি আদর্শ জায়গা। শহরের যে কোনো স্থানে তিব্বত বা ভুটানের হরেক রকমের পশমি বস্ত্র পাবেন। এ ছাড়াও শিলিগুড়িতে কেনাকাটায় এখানকার ঐতিহ্যবাহী কিছু হস্তশিল্প ও অলঙ্কৃত ক্ষুদ্র মূর্তি কিনতে পাবেন। হিল কার্ট রোড এবং সেবক রোডে বহু কেনাকাটার স্থল, শপিংমল থেকে অনেক কিছু কেনাকাটা করতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:৪৪