মা, তুমি নেই ভাবতে পারিনা কিছুতেই। তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবে অবশেষে আমি ফিরে আসি বাস্তবে। আমার সেই বাস্তব তোমাকে হারানোর বাস্তব। আমার সেই পৃথিবী তুমিহীন শূন্যতার হাহাকারে ভরা। তোমাকে ছাড়া সেই গহীন শূন্যতায় আমি নিজকে হারিয়ে ফেলি বার বার। আবার ফিরে আসি বাস্তবতার কঠিন কঠোর আলিঙ্গনে। ডুবে যাই সময়ের ব্যস্ত টানাপোড়েনে। সেখানে নিজকে জাগিয়ে রাখার একমাত্র আশ্রয় তুমি মা। তোমার কড়িকাঠের দেহটাকে আমি আর ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারবনা জানি, তোমাকে মা বলে ডাকতে পারিনা। তাতে কি হয়েছে? তুমি তো রয়েছো আমার চারপাশটা জুড়ে। কেন ভাববো তুমি নেই। কেন নিজকে পৃথিবীর এক নিঃস্বতম মানবের ছায়ায় বিসর্জন দিব?
মা, পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তুমি একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবে-এ তো জানাই ছিল। তখন ভাবতাম তুমিহীন পৃথিবীতে আমি হয়তো নিজকে হারিয়ে ফেলবো। ভাবতাম, আমার চোখের সামনে আমার মা মারা যাবে এ কেমন করে হয়? অথচ দেখো! তোমাকে কবরে শুইয়্যে দিয়ে কেমন বেঁচে আমি! হেসে-খেলে আগের মতই জীবনের চাকায় গতি সঞ্চার করে যাচ্ছি। তোমার চলে যাওয়ায় আমার প্রতিদিনের পথ চলায় এতটুকু স্থবিরতা নেমে আসেনি মা। তার কারণ, তুমি নেই একথাটা আমি ভাবতে পারিনা কিছুতেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সন্তানকে ছেড়ে একজন মা বেশীদিন বেশী দূরে থাকতে পারেনা। তুমিওতো সেই চিরায়ত মা। কোথায় আর যাবে? রয়েছো আমার কাছে কাছেই। তোমার নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় আমার বিশ্বাসের ভিত শক্ত হয় মা। তুমি যদি না-ই থাকবে তাহলে এই বিরুদ্ধ পৃথিবীতে আমি আমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছি কিভাবে? তোমার আশীর্বাদ ছাড়া সেটা কি কখনও সম্ভব? বলো মা। আমি আজও তোমার আশীর্বাদের ছায়াতলে নিজেকে সব সময় নিরাপদ ভাবি। তাই তো মা তুমি নেই-একথাটা ভাবতে পারিনা কিছুতেই।
বাড়ি ফিরে তোমাকে দেখতে পাবোনা-একথাটা আজও জোড় দিয়ে ভাবতে পারিনা। মনের ভিতর কোথায় যেন ক্ষীণ একটা আশা উঁকি দিয়ে যায়। বাড়ি গিয়ে যদি দেখতে পেতাম আগের মতো আমার ফেরার অপেক্ষায় বসে আছো তুমি! মাকে হারিয়ে এমনি বুঝি হয় সন্তানের! মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়ার নানা প্রলোভনে এমনি নানা আশা-নিরাশার দোলে সে। কিন্তু ঘরে ঢুকা মাত্রই কঠিন সত্যটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় আমাকে। তুমি নেই! কোথাও নেই! নিজকে ধাতস্থ করি। চারপাশে ভালো করে তাকাই। তোমার স্মৃতির হাজারো প্রজাপতি মুখর হাতছানিতে আমাকে কাছে ডাকছে। এদের কাছে গিয়ে আমি তোমার শরীরের গন্ধ পাই। তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। আমি ভুলে যাই তুমি নেই। আনমনে মা বলে ডেকে উঠি। তুমি যেন সেই ডাকে সাড়া দাও। আমি ষ্পষ্টত শুনতে পাই। তাহলে তুমিই বলো মা! কি করে মেনে নিব তুমি নেই। তুমি আগের মতই আমাকে ভালোবাসছো, কাছে টানছো।
শুধু আমার কথাই বা বলছি কেন? তোমার ভালোবাসা দিয়ে যাদেরকে তুমি মায়ার বন্ধনে জড়িয়েছিলে ওরা সবাই তোমাকে লালন করছে মনে মনে। যারা বিভিন্ন সময় সাহায্যের আশায় তোমার কাছে আসতো, তুমি তাদেরকে আমার কথা বলে অপেক্ষায় রাখতে। তারা ঠিক সময় হিসাব করে আমার বাড়ি যাওয়ার দিনটিতে চলে আসতো। তোমার প্রতিশ্র“তিমতো আমি তাদের দাবী পূরণ করতাম। জানো মা, আমার বাড়ি যাওয়ার সময় হিসেব করে ওরা আজও আসে। আমি তাদেরকে ফিরাইনা মা। আমি বাড়ি গেলেই ওদেরকে দেয়া তোমার প্রতিশ্র“তি পূরণ হবে এটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা মা। কারণ, আমি টের পাই তুমি অপেক্ষা করছো আমি কখন তোমার প্রতিশ্র“তি রক্ষা করব! তোমার এমন হার না মানা অসংখ্য প্রতিশ্র“তি আমাকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায়। সেই আগের মতো। তুমি যেমন আমাকে তাড়া দিতে ‘একে এটা দাও, ওকে ওটা দাও’ বলে। একবার ভাবো তো মা! আমার চারপাশের বাস্তবতায় সর্বক্ষণ তোমার এমন সরব উপস্থিতিতে আমি কি করে মেনে নিব তুমি নেই। কি করে অন্যের কাছে নিজের পরিচয় দিব যে আমি মাতৃহীন। তাহলে যে ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ এই পৃথিবীর বুকে যুদ্ধ করে টিকে থাকার সাহস ও শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলবো আমি।
মাগো, ভালোবাসা কি কখনও মরে যায়, তুমিই বলো? পৃথিবীতে তুমিই ছিলে আমার একমাত্র ভালোবাসা, আমার সুখ-স্বপ্নের বাসা, হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনার উৎস। আমার ভালোবাসার সেই মনটা এখনও মরে যায়নি মা। মনজুড়ে সুখ-স্বপ্নের আনন্দ-হিল্লোলে এখনও আমি দোলায়িত হই। হাসি-কান্না-অনন্দ-বেদনার অনুভূতি এখনও আমাকে সমানভাবে আলোড়িত করে। মাগো, তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতিগুলো ছিল এমনি প্রাণবন্ত, মুখরতার সীমাহীন উচ্ছলতায় ভরপুর। সেই অনুভূতিগুলো তো আমার তেমনি আছে মা। তাই তো তুমি নেই, এই ভাবনাকে মনে স্থান দিতে কষ্ট হয় আমার। যেদিন আমার এই অনুভূতিগুলো ডানা ভেঙে মাটির সাথে মিশে যাবে সেদিনই কেবল এই বিশ্বাস আমার মনে ঠাঁই পাবে যে তুমি নেই, চিরদিনের জন্যে চলে গেছো এই পৃথিবী ছেড়ে, তোমার সন্তানের ভালোবাসার মায়া কাটিয়ে।