বৃদ্ধা নতুন বধূটির দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল। কার যেন একটা চেনা মুখ সে মুখের উপর ভেসে উঠল। চােখের কােণা বেয়ে এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে গেল।
বৃদ্ধ সুনীল আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এ বাড়িতে এসেছিল। তার পূর্ব পরিচয় কাউকেই দেননি। শুধু নামটাই বলেছিল। আর বলেছিল পৃথিবীতে আমি একা। আমার কেউ নেই। তখন থেকে বাড়ির সাধারণ কাজগুলোই তিনি করেন। কেউ তার কাজে অসুখী নয়।
এ বাড়ির বড় ছেলে ঢাকা চাকরি করত। বিয়ের এক বছর পর বাড়িতে ফিরছে। বউটি দারুণ সুন্দরী। বৃদ্ধাতো প্রথম দেখা থেকেই নিস্পলক তাকিয়ে আছেন।
সেদিন খাবার সময় তিনি একেবারেই নীরব হয়ে পড়লেন। ছেলেটি বলল, “কাকা, আপনার খারাপ লাগছে?”
“না। বয়স হয়েছেতো তাই একজনের ভেতর দিয়ে অন্য জনকে চেনার চেষ্টা করি।”
“আপনার কাউকে মনে পড়ছে? বলুন।”
“সব মুখই আবছায়া হয়ে গেছে।”
“জীবনের সব মুখ অচেনা হয়ে যায় না। মৃত্যুর আগেও ভেসে আসে যমের বেশে। তাইতো মৃত্যু সময় মানুষ তার আপন জনকে কাছে দেখে।”
সুনীল একটু হাসল। “তা যায় না। যায় না বলেই মানুষ নীরবে কাঁদে।”
খাবার শেষ বৃদ্ধা নিজের স্থানে চলে গেল। বিছানা পাতল। অনেক দিন পর সুলেখার কথা একটু মনে পড়ল। সুলেখাকে বলেছিল, মৃত্যু ছাড়া তারা কখনও আলাদা হবে না। অথচ্ কতগুলো বছর তাকে ছাড়া কেটে গেল। সব কথা মিথ্যা করে দিল।
আজ আর সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগল না। জেগে জেগে অনেকগুলো মুখ স্মরণ করছে। বড় বউ এসে তাকে যেন একেবারে নীরবে করে দিল। তাই ভাবছে তার সাথে একটু কথা বলেবে। কিন্তু কি করে বলবে? সে বাড়ির চাকরের মত। আর বাড়ির বড় বউ। যদিও তারা চাকরের মত দেখে না। নিজেকে নিয়ে ভয়।
সেদিন বড় বউ একাকি আম গাছটার নিচে চেয়ার পেতে বসে আছে। সুনীল কাছে গেল। নতুন বউটা তার দিকে একটু তাকাল। সুনীল ভয় পেয়ে গেল। আর কােন কথা বলল না। এমন ভাবে অনেকগুলো দিন কেটে গেল।
আবার একদিন সেই আম গাছের নিচে চেয়ারে বসল। আজ বাড়িতে লােকজন কম। বৃদ্ধার একটু সাহস হলো। খারাপ কিছু বললেও অন্যেদের কাছে তার মান-সম্মান যাবে না। নতুন বউটি বলল,“আপনি আমার দিকে ওমন করে তাকান †কনো?
“আমার চেনা মানুষদের খুঁজি। অনেক মুখ তােমার মুখের উপর ভেসে আসে।”
“আপনি কিছু বলবেন?”
“বলতেতো অনেক কিছুই চাই। তুমি কি শুনবে?”
“কি এতো বলতে চান? কিছু বলুন।”
“তোমার নাম কি।”
“সুজাতা।”
বৃদ্ধা বিস্ময়ে, “বাবার নাম?”
“সাগর।”
“মার নাম সরলা।”
“কিন্তু, আপনি?”
“আমি এক মিথ্যা দলিল। তােমার সব শােনার আগে আমার একটা গল্প শুনবে? না শুনলেও বলি। এক ভদ্র লােকের একটি মাত্র ছেলে ছিল। বাবা তাকে আদর করে বাড়ির পাশে বিয়ে দিল। বিয়ের এক বছর পর তাদের একটা মেয়ে হলো। মেয়েটি সবার আদরের। দাদু-দিদা, মা-বাবা তাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো। একদিন দাদু তাকে নিয়ে পাশের গ্রামে বেড়াতে গেল। দাদু এক জনের সাথে কথা বলছিল আর নাতিটি পাশে আরেকটা মেয়ের সাথে খেলা করছিল। দাদু কিছুক্ষণ পরে দেখল নাতিটি নেই। অনেক খুঁজল তবু পেল না। বাড়িতে একটু খবর নিল। সেখানেও পাওয়া গেল না। দাদু কি করবে? পােড়া মুখ কাউকে দেখাবে না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আর কােন দিন সে ফিরল না।”
“দাদু!”
বৃদ্ধা চােখের জল আটকিয়ে রাখতে পারল না। বাধ ভাঙ্গা নদীর মত দাদুর চােখের জল উপচে উঠল। কান্নার শব্দ বেড়ে উঠল। হাতের লাঠিখানা পড়ে গেল। সুজাতা তাকে জড়িয়ে ধরল।
“দাদু, আমি আজ জবাব পেয়েছি। আমি আবার ফিরবো। আমি তােমার বাবা-মাকে বলবো, আমি আমার দাদুভাইকে সাথে নিয়েই এসেছি।”
“দাদু, তুমি এতোগুলো বছর কিভাবে কাটালে?”
“ভয়ে, দাদু। আমি তােমার বাবা-মাকে কি জবাব দিতাম। আমি কি করে একা ফিরতাম?”
সুজাতাকে নিয়ে দাদু বাড়ি ফিরল। বৃদ্ধা নীরবে ঘরের কােণে একাকি বসে আছে। দাদু বৃদ্ধার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সেই যৌবনের প্রথম আকর্ষণের মত তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। কিন্তু পারল না। কেবল বলল, তুমি কেমন ছিলে?”
“তুমিই বলো আমি কেমন ছিলাম। তবে তােমার ভালোবাসাকে আমি ধন্যবাদ জানাই যে তুমি একা ফেরোনি। আমিও ফিরতাম না। ফিরতে পারতাম না।”
বৃদ্ধার চােখের কােণা দিয়ে জল গড়িয়ে গেল।
০৪/০৪/২০১৬ইং
কানাই বাগচীর বাড়ি,
কাশিয়ানী, গােপালগঞ্জ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৮:৩৪