মানুষ মাত্রই নীতিবোধ সম্পন্ন, প্রত্যেকেরই ভালো মন্দের ধারণা আছে। এই ধারণা গড়ে ওঠে তাঁর ভৌগলিক অবস্থান, ইতিহাস আর সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। আমাদের বাংলাদেশে এখনো জনসমাজে বিধবা বিবাহ খুব সহজ ভাবে গ্রহণ করা হয় না, হিন্দু মুসলিমে এই ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নাই। বিশেষ করে একজন বিধবা যদি মা হয়ে থাকেন সমাজ তার পুনরায় বিবাহ ভালো চোখে দেখে না। আর একজন কুমার ব্যাক্তি যদি একজন বিধবাকে বিয়ে করেন তবে সেইটা সচরাচর তার পরিবার এবং আশেপাশের সমাজ নিন্দার উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ এই দেশের জনসমাজে বিধবা বিবাহ নিয়া এক ধরণের প্রেজুডিস আছে। অথচ এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ মুসলমান, ইসলাম ধর্মের অনুসারী, যেই ইসলাম ধর্মে বিধবা বিবাহ নিয়া কোন আপত্তি বা প্রেজুডিস নাই। খোদ ইসলামের নবিই যেইখানে একাধিক বিধবাকে বিবাহ করেছেন সেইখানে তার বাঙালি অনুসারীদের এহেন প্রেজুডিসের মর্মার্থ কি? তাদের এই প্রেজুডিস আরব দেশ থেকে আগত ইসলামের সাথে আমদানি হয় নাই, এর উৎস এই বঙ্গভূমিতেই। ব্রাক্ষ্মন্যবাদী হিন্দু সমাজ নারীর সতিত্ব সংক্রান্ত যেই ধারণা ঐতহ্যগত ভাবে এই অঞ্চলের মানুষের মনে গেথে দিয়েছে সেই ধারণা অনুযায়ীই বিধবা বিবাহকে এই অঞ্চলে অনৈতিক হিসাবে দেখা হইতো। অর্থাৎ একজন বাঙালির নৈতিকতার উৎস যে স্বর্বক্ষেত্রেই ইসলাম বাস্তবতা কিন্তু আমাদের তা বলে না। এইবার আসা যাক বাল্যবিবাহ বিষয়ে। ইসলামে বাল্য বিবাহে কোন নিষেধাজ্ঞা নাই, নাই কোন প্রেজুডিস। খোদ ইসলামের নবিই নাবালিকা নারীকে বিবাহ করেছেন। আমাদের এই অঞ্চলে আরবের মতো অতো বেশি না হইলেও বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল বটে। অথচ বাল্য বিবাহের প্রসঙ্গ আসলেই আমরা ছিঃ ছিঃ করি। বাল্য বিবাহ নিয়া বাঙালির এই প্রেজুডিস এবং নৈতিক অবস্থান তার ধর্মগত না, তার ঐতিহ্যগতও না, তাহলে এই নৈতিক অবস্থানের উৎস কি? এই নৈতিক অবস্থানের উৎস ইউরোপিয় আধুনিক বিবাহের বয়স সংক্রান্ত ধ্যান ধারণা। ব্রিটিশ আমলে বিবাহের নতুন বয়স সংক্রান্ত আইন, তৎকালিন শিক্ষিত সমাজের প্রচার প্রচারণা এবং বিভিন্ন জনপ্রিয় লেখকের বহু জনপ্রিয় সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে এই নৈতিকতা আমাদের মনে স্থান কেড়ে নিয়েছে, এর উৎস কোরআনও না হাদিসও না। অর্থাৎ একজন আধুনিক বাঙালি হিসাবেই আমরা এই ছোটখাটো আলোচনাতেও আমাদের নৈতিক অবস্থানের তিন তিনটা ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক সাংস্কৃতিক উৎস খুঁজে পাচ্ছি।
এইবার আসি ইসলামের নৈতিকতা নিয়া। এইক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হবে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বাস্তব পর্যবেক্ষন নিয়ে। বাস্তব পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে আমরা বলতে পারি যে ইসলাম ধর্মে যেইসব নৈতিকতা আছে তাঁর মধ্যে কিছু তৎকালিন আরব ভূখন্ডের ইসলামপূর্ব সংস্কৃতি থেকে গ্রহন করা, কিছু ইহুদি খ্রিষ্টান নৈতিকতা এবং কিছু হযরত মোহাম্মদের নিজস্ব চিন্তা চেতনা থেকে উৎপন্ন। অথবা মুসলমানদের বিশ্বাসকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা ধরে নিতে পারি যে ইসলামের নৈতিকতার বড় অংশই এসেছে জিব্রাইলের মাধ্যমে, স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে। দ্বিতীয় ধারণার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে যে এই বক্তব্যকে প্রমান করার কোন উপায় নাই। একটা উপায় হতে পারে যে কোরআন থেকে এমন কোন নৈতিক আইন খুঁজে বের করা যেইটা কোন মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব না। আমি এই চেষ্টায় সফলতা লাভ করতে পারি নাই, উৎসাহি ব্যাক্তিরা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। “ইসলামী নৈতিকতার মূল ভিত্তী ঐশ্বরিক বাণী” এই তত্ত্ব নিয়া তাই আমাদের বিশ্বাসের বাইরে খুব বেশিদূর গবেষনা করার সুযোগ বা পদ্ধতি আপাতত আমাদের হাতে নাই। আমরা তাই আপাতত ইসলামী নৈতিকতার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাকার বাস্তব ভিত্তীর খোঁজ করার কিঞ্চিত চেষ্টা করে দেখি।
ইসলামী আইনের পাথর ছুড়ে হত্যা করা, হারাম এবং হালাল সংক্রান্ত বেশিরভাগ নৈতিক ধারণার উৎস ইহুদি শরিয়ত, এইসব বিষয়ে ইহুদি শরিয়তে বিসদ আলোচনা আছে। আবার আমাদের সময়ের হিসাবে বহু ছোট অপরাধের কঠোর শাস্তি, বাল্য বিবাহ, পর্দা প্রথা ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামী নৈতিকতা মূলত মক্কা মদিনা এবং ঐ ভৌগলিক অঞ্চলের ইসলাম পূর্ব সংস্কৃতি থেকে প্রাপ্ত, এইসব ইতিহাস থেকেই প্রমানিত। অন্যদিকে দাস দাসীর সাথে আচরণ, বিবাহের নিয়ম ও দাম্পত্ব জীবন, এতিমের সাথে আচরণ, পালক পূত্রের অধিকার এহেন বহু বিষয়ে মোহাম্মদের মৌলিক চিন্তা ভাবনা ইসলামের নৈতিকতার উৎস হিসাবে এসেছে। আমার এই বক্তব্যের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে উদাহরণ দেয়া এই প্রবন্ধে অসম্ভব। আমি শুধু বাল্য বিবাহ এবং পর্দা প্রথা নিয়া কিঞ্চিত আলোচনা করবো। আরব ভুখন্ডে বাল্য বিবাহের প্রচলন ইসলাম পূর্ব যুগেই ছিল, এটাকে নৈতিক ভাবে সমর্থনযোগ্য বলেই গন্য করা হতো। এর পেছনে তৎকালিন আরব ভুখন্ডের সামাজিক অবস্থা ভুমিকা রেখেছে। তৎকালিন আরব দুনিয়ায় নারীর নিরাপত্ত্বা ছিল একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বর্বর আরব সমাজে অপহরণের মাধ্যমে বিবাহের প্রচলন ছিল, ছিল নারী দাস ব্যাবসার জমজমাট বাজার। অন্যদিকে বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে এই ধরণের ঝামেলা অনেকটাই এড়ানো যেতো। আর তাই বাল্য বিবাহের প্রচলন স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছিল। উল্লেখ্য, বাঙলায় সেন আমলেও যখন সামাজিক নিরাপত্ত্বা হুমকির মুখে পড়েছিল এবং বিভিন্ন দস্যুর হামলা ও নারীর অপহরণ বৃদ্ধি পেয়েছিল সেই সেন আমলেই কিন্তু এই অঞ্চলে বাল্য বিবাহকে উৎসাহ প্রদান করা হয় এবং ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। পর্দা প্রথার ক্ষেত্রেও আরব ভুখন্ডের এই পটভুমিই ভুমিকা রেখেছে। জোর যার মুল্লুক তার যেইখানে প্রবল সেইখানে পুরুষ শাসিত সমাজের পুরুষ তার যাবতিয় সম্পত্তি শত্রু এবং দস্যুর চোখের আড়ালে রাখতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। আর তাই সোনাদানা সিন্দুকাবদ্ধ রাখার মতোই নারীকে পরানো হয়েছে পা হতে মাথা পর্যন্ত হিজাব বা বুরখা। এই হিজাবের ইতিহাস আরব ভুখন্ডে ইসলামেরও বহু আগের। বিভিন্ন লেখায় অতি প্রাচীন কালের আরব ভূখন্ডে বুরখা জাতীয় পোশাকের বর্ণনা পাওয়া গেলেও ইসলামী বুরখার কাছাকাছি আপাদমস্তক আবৃত করা যায় এমন বুরখার সবচেয়ে পুরাতন যে প্রতিকৃতি পাওয়া যায় তাও ২০০ খ্রিষ্টাব্দের সমকালিন, অর্থাৎ ইসলামের প্রায় ৪০০ বছর আগেকার। আধুনিক সিরিয়ায় অবস্থিত পালমিরা নগরির ধ্বংসাবশেষে পাওয়া এই প্রতিকৃতির চিত্র নিচে দেয় হলো।
এইভাবে প্রায় সকল নৈতিকতার ভিত্তি হিসাবেই বিভিন্ন সামাজিক প্রয়োজনিয়তা খুঁজে পাওয়া যাবে যা বিভিন্ন ভৌগলিক ভুখন্ডে বিভিন্ন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলার সময় বিভিন্ন সময়ে সৃষ্টি হয়েছে এবং যতদিন প্রয়োজন ছিল ততদিনই টিকে থেকেছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এইসব সামাজিকভাবে উৎপন্ন মানবিক নৈতিকতার ঐশ্বরিক উৎস দাবি এলো কেমন করে? এইটা অত্যন্ত কঠিন একটা প্রশ্ন। উত্তর আমি এই পোস্টে দিতে যাবো না। তবে পাঠকদের কিছু চিন্তার খোরাক অবশ্যই দিয়ে যাবো। আমরা মূলত আব্রাহামিক ধর্মগুলোর নৈতিকতাকেই ইশ্বর হতে প্রাপ্ত বলে মনে করে থাকি। এর বাইরে থেকে আমি কিছু উদাহরণ দেবো, যা নিয়া পাঠকসমাজ কিঞ্চিত চিন্তা ভাবনা করবেন এই আশা রাখি।
উদাহরণ ১- প্রখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস দাবি করেছিলেন যে, তিনি দেব দেবীর উপাসনা, মানুষের জ্ঞান এবং নীতি নৈতিকতা বিষয়ক যেইসব ধারণা তিনি প্রচার করেন এই কারণে যে একদিন ডেলফির মন্দিরে এক ঐশ্বরিক গায়েবী আওয়াজ তাকে মানুষের মধ্যে এইসব প্রচার করতে বলেছিল। (সক্রেটিস যদি তাঁর সময়ে তাঁর মুস্টিমেয় দার্শনিক শিষ্যের বদলে জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতেন তাহলে কি ঘটতে পারতো সেই বিষয়ক কল্পনা পাঠকের কল্পনাশক্তির উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
উদাহরণ ২- এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পুরাতন যে কয়টি লিখিত আইনখন্ড বা দেশ শাসনের সংবিধান পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে “হাম্মুরাবির কোড”। হাম্মুরাবি ১৭৯৬ থেকে ১৭৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের শাসনকর্তা ছিলেন। একত্ববাদী ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি তার তখনো আবির্ভাব হয় নাই। এই হাম্মুরাবি কোড হচ্ছে হাম্মুরাবির আইন বিষয়ক কিছু নির্দেশ যেখানে অপরাধ এবং অপরাধের শাস্তি, জরিমানা ইত্যাদি বর্ণিত আছে। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বের এই আইনকে ব্যাবিলনে এমন গন্য করা হতো যে স্বয়ং রাজাও এই আইন লঙ্ঘন করতে পারবেন না, অনেকটা আধুনিক সংবিধানের মতো। কিন্তু এইখানে একটা মজার ব্যপার আছে। হাম্মুরাবি প্রচার করেন যে এইসব আইন তিনি খোদ সূর্য দেবতার কাছ থেকে পেয়েছেন, অর্থাৎ এই আইন মানুষের আইনের চেয়ে উর্ধ স্বর্গিয় আইন। সেসময় ব্যাবিলন নগরির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ছিলেন সূর্য দেবতা শামাস। নিচে শিলালিপীতে লেখা হাম্মুরাবির কোডের একটা ছবি আর সূর্য দেবতা শামাসের হাত থেকে হাম্মুরাবির আইন লাভের খোদাইচিত্রের একটা ছবি দিলাম।
এইরকম অন্তত এক ডর্জন উদাহরণ আমি দিতে পারবো যেখানে কোন একজন নেতৃস্থানীয় মহামানব তার প্রদত্ত আইনকে স্বর্গীয় আইন বলে দাবি করেছেন। এইসব উদাহরণে কোন ইহুদি-খ্রীস্টান-ইসলামিক ট্রাডিশনের ব্যাক্তির কথা উল্লেখ করা হবে না। এদের মধ্যে আদিবাসী নেতা থেকে শুরু করে একেবারে দার্শনিক এবং ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে একেবারে হাল জমানার ব্যাক্তিবর্গ রয়েছে। একেক যায়গায় উৎস একেক দেবতা। এখন কিছু লোক ঠিক কি কারণে তার প্রদত্ত্ব আইনের সাথে কোন দেবতা বা ইশ্বরকে যুক্ত করেন সেই আলোচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন পোস্টে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, ঐশ্বরিক যোগাযোগ থাকুক বা না থাকুক তাতে এইসব আইনের যোগ্যতা বা প্রয়োজনীয়তা তাতে বাড়ে বা কমে না। মানুষ সামাজিক প্রাণী হওয়ায় এবং তার সুসংগবদ্ধ ভাষা থাকায় নিজের সমাজের স্ট্রাকচার সে ধরে রাখে নৈতিক আইনের মাধ্যমে। সমাজের প্রয়োজনে নৈতিকতার সৃষ্টি হয়, সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথেই তা পাল্টে যায়, পালটে যায় ভৌগলিক অবস্থান পরিবর্তনের সাথেও। লালনের গানের ছোট্ট দুইটা লাইনেই পুরো প্রশ্নের সহজ উত্তর আছে -
পাপ পূণ্যের কথা আমি কাহারে জিগাই,
এক দেশে যা পাপ গণ্য আরেক দেশে পূণ্য তাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১:৪৮