দশ-পনের বছর ধরে ভাবছি, পৃথিবীর আদি গোত্র বা জাতির যে সব ধর্ম বা সংস্কৃতি যা শ্রদ্ধা-সন্মানের সাথে প্রচলিত ছিল--যা হারিয়ে গেছে বা অন্য ধর্ম বা সংস্কৃতিতে বিলীন হয়ে গেছ, বা বিলীন হতে বাধ্য হয়েছে, সে সব ধর্ম এবং তাদের ধর্ম আশ্রিত জীবন ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিক লিখব। ধর্ম সংখ্যা খূঁজতে গিয়ে দিনকে দিন বিস্মিত হয়েছি, সেই সাথে সময় করে উঠতে না পারা এবং শ্যাঁওলা-কাঁটা-বেড়ায় আবদ্ধ সময়, চলমান বাস্তবতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এতটা সময় লাগল।
প্রথমে ভারতীয় উপমহাদেশে বহুল প্রচলিত প্রাচীন ধর্মগুলোর বিষয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করব, যেগুলোর অধিকাংশই বিলুপ্ত বা বিলুপ্তির পথে। ভবিষ্যতে এসব বিলুপ্ত ধর্ম নিয়ে বৃহৎ পরিসরে আলোচনা করব।
১.ধর্মঃ আজীবিক
খ্রীস্টের জন্মের ৫০০-৬০০ বছর আগের কথা। ভারতীয় জাতিগোষ্ঠী তাদের গোত্র, সমাজ, ভুস্বামী, জমিদারী থেকে ধীরে ধীরে নগর কেন্দ্রিক সীমানা ঘেরা রাষ্ট্র সৃষ্টির লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছে। তখন তাদের পারিবারিক, গোত্রীয় বা সামাজিক একান্ত নিজস্ব ছোট ছোট বিশ্বাসগুলো ধীরে ধীরে বড় বড় বিশ্বাসে বিলীন হতে শুরু করল, তাদের ছোট ছোট মূর্তিগুলো হারিয়ে যেতে লাগল, কোন কোন শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠীর মূর্তিগুলো অনেক বড় হতে লাগল। সহজ সরল মানুষের স্বার্থগুলো বড় বড় হতে হতে হিংস্র হয়ে উঠতে শুরু করল। শত শত ধর্ম, বিশ্বাসের, মতের মন্দির, সংঘ, বিহার বাড়তে লাগল, সেই সাথে অলস স্বপ্নবিলাসী সাধুসন্ন্যাসীদের সংখ্যা হতে লাগল অগণন। সেই সময়ে সাধুসন্ন্যাসীরা বেশ সন্মানীত ছিল। গ্রামে-গন্জে, রাজদরবারে, রাজধানীতে তাদের যথেষ্ট সন্মান করা হত।
৫০০-৬০০ খ্রীস্ট পূর্বে ব্রাক্ষণ্য সনাতন ধর্মের উচ্চ শ্রেণির অত্যাচারে, অবিচারে, অবহেলায় তখন বেদ বিরোধী নানান মতের সাধু সন্ন্যান্নীর জন্ম হতে লাগল। সম্রাট, রাজা, মন্ত্রী তথা রাজপরিবারের, ভুস্বামী জমিদারের ছিল আকাশ ছোঁয়া পাপ। তাই শেষ বয়সে তারা পাপ থেকে মুুক্তি লাভের আশায় পাপমুক্ত মানুষের শরণাপন্ন হত। অল্প সময়ে, সহজে পাপমুক্ত হবার জন্য সাধুসন্ন্যাসীদের পরামর্শে ধর্মের আশ্রয় নিত। সহজেই পাপমুক্ত হবার জন্য নিয়তিবাদের দিকে বহু রাজা, রাজণ্যবর্গরা ছুটে গেছেন। ছুটে গেছেন আজীবিক ধর্মের ছায়াতলে। সাধু -সন্ন্যাসীরাও অাধুনিক সময়ের মত সেই সময়েও সম্রাট-রাজা-মন্ত্রী তথা রাজণ্যবর্গদের নিজ ধর্মে বা মতবাদে অানার বা শিষ্য বানাবার চেষ্টা করতেন ঐ পরিবারে অন্তর্ভূক্ত তাদের অনুসারী কোন শিষ্যের সাহায্যে।
অাজীবিক ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্মগুলোর একটি। এ ধর্মের কোন গ্রন্থ বা টীকা পাওয়া যায়নি। হয়তো যত্নের অভাবে হারিয়ে গেছে, অথবা জৈন, বৌদ্ধ, হিন্দুরা তাদের লিখিত কোন গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলেছে, আবার এমনও হতে পারে রাজগ্রহের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সংরক্ষিত হয়নি। যতটুকু জানা গেছে, তার প্রায় সবটুকুই জৈন, বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের লিখিত গ্রন্থ থেকে। আসলেই এ ধর্মের নাম আজীবিক ছিল নাকি বিরোধীতা, ব্যাঙ্গার্থে তারা তাদের গ্রন্থে এ নাম দিয়েছে, সেটা সন্দেহের বিষয়। জৈন ধর্ম ভগবতী সূত্র , বুদ্ধঘোষ রচিত বৌদ্ধদের সম্মানফলের টীকাগ্রন্থ হল আজীবিক ধর্মের তথ্য জানার উপায়। এ ধর্মমত জৈনধর্মের মহাবীরের সময়কালে বেশ প্রচলিত ছিল। এ গ্রন্থগুলোতে বলা হয়, গোসাল মংখলিপুত্ত নামে একজন ভারতীয এ ধর্মমতের প্রচারক। ভারতীয় প্রাচীন ধর্মমত নিয়ে গবেষণা করেছেন নরেন্দ্র ভট্রাচার্য । তার মতে, গোসালের পূর্বতী আরো দুজন আজীবিক গুরুর নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন নন্দ বচ্চ, কিং সংকিচ্চ। শক্ত প্রমাণ ছাড়া বলা মুসকিল, আজীবিক ধর্মের বয়স কত এবং কে বা কারা এই ধর্মের প্রবর্তক? প্রাচীন গ্রন্থ থাকাতে আজ আমরা জানতে পারি, মহাবীর নয়, জৈন মতের প্রথম দিপঙ্কর হল ঋষবদেব এবং ঋষবদেবের কারণে জানতে পারি হিন্দু বা সনাতন নয়, জৈন ভারতের আদি ধর্ম।
আজীবিক মতের নিজস্ব গ্রন্থ না থাকাতে অন্য ধর্মের গ্রন্থে গোসাল ছাড়া আর কোন নাম নাই। জন্ম তারিখ জানা যায় না, তবে বলা হয় মৃত্যু ৪৮৪ খৃষ্ট পূর্বে। তার সময়ে মগধের সম্রাট ছিলেন বিম্বিসার। গোসাল বুদ্ধ ও মহাবীরের সমসাময়িক ছিলেন। জৈন ধর্মমতে,, মহাবীর গোসালের সাথে ৬ বছর ছিলেন। মতের অমিল হওয়ায় আলাদা হয়ে যান।
গোসালের মতে মানুষের কাজ তার জন্মান্তরকে কোনক্রমেই প্রভাবিত করে না। সম্রাট অশোকের শাসনামল পর্যন্ত এ ধর্ম মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে মনে করা হত। ১৪ শতক পর্যন্ত এ ধর্ম নানা অবয়বে ভারতে টিকে থাকলেও, তারপর তার অনুসারীরা কোন মতে, নতুন কোন ধর্মের ভীরে হারিয়ে গেল, জানা যায় না। নরেন্দ্র ভট্রাচার্য বলেন, এই ধর্ম মতটি বৈষ্ণব মতে বিলীন হয়ে গেছে। ধর্মমতটি ছিল বেদবিরোধী, নাস্তিক্যবাদী। সেই সময়ে এ মতের অনুসারীদের সংখ্যা বৌদ্ধ, জৈন মতের অনুসারীদের চেয়ে বেশি ছিল। তবে ধর্মে পৃষ্ঠপোষকতা করে, মন্দির, মঠ, বিহার তৈরীতে অর্থ দান করে ব্যবসায়ীরা। সেই সময়ে ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রভুত উন্নতি সাধিত হচ্ছিল। গোসাল নিয়তিবাদের প্রখর বিশ্বাসী, ফলে ব্যবসায়ীরা তার অনুসারী না হয়ে, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের অনুসারী হতে লাগল। সাধারনের মধ্যে এই মত জনপ্রিয়তা পেলেও আর্থিকভাবে সচ্চল ব্যবসায়ীদের মন জয় করতে না পারায় ধারাবাহিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু ধর্মের কুপ্রভাবে এটা আজ বিলুপ্ত।
মৌর্য যুগে এ মতটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিন্দুসার আজীবিক ধর্ম সম্প্রদায়ের মত বিশ্বাস করতেন। তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষক পিঙ্গলবস্ত বা জনাসন একজন ব্রাহ্মণ আজীবিক ছিলেন। বিন্দুসারের পত্নী সুভদ্রাঙ্গীও আজীবিক ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিলেন। সম্রাট অশোকের পৌত্র দশরথ এ মতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। যদিও বলা হয়, সম্রাট অশোক হাজার হাজার আজীবিক অনুসারীদের হত্যার আদেশ দিয়েছেন। পিতার বিশ্বাস অনুসারীদের কেন হত্যার আদেশ দিয়েছেন তা জানা যায় না।আবার এটাও জানতে পারি, গৌতম বুদ্ধ মহাবীরকে নতজানু হয়ে প্রণাম করছেন, এই চিত্র আঁকা এবং বাড়াবাড়ির অপরাধে আড়াই লাখের বেশি জৈন অনুসারীদের মহাস্থানগড়ে শোকের আদেশে হত্যা করা হয়। সেই সময়ের ঘটনার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া সম্ভব নয়।
গোসালের পরে কে বা কারা এই মতকে ১৪০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বয়ে বেড়িয়েছেন, তাও জানা যায় না। এই মত কি মানুষের মুখে মুখেই ছিল? কোন ভাষায় কি লিখিত নাই? প্রাচীনকালের ধর্মমত বা বিশ্বাসগুলো এরমকই গ্রন্থবিহীন ছিল। আধুনিক যুগেও দেখতে পাই উপজাতি বা অনেক জাতির ধর্ম- সংস্কৃতির ভাষার কোন লিখিত রূপ নাই। মুখে মুখে প্রচলন থাকার কারণে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের মৃত্যু, দেশান্তর, ধর্মান্তর তথা নানান কারণে তাদের জাতির ধর্ম, মত, ভাষা হারিয়ে গেছে।
গোসাল ও তার ধর্ম মত বিষয়ে পরবর্তী সংখ্যায় অকাট্য প্রমাণ ছাড়াই ধারনাগত, যুক্তিগত চিন্তা-চেতনা নিয়ে লিখব।
Gosala (d. c.484 BC), was, it is said, a friend of Mahavira, the founder of Jainism. Gosala denied that a man's actions could influence the process of transmigration, which proceeded according to a rigid pattern, controlled in the smallest detail by an impersonal cosmic principle, Niyati, or destiny. After a period of prosperity under Asoka, the sect rapidly declined and only retained local importance in SE India, where it survived until the 14th cent.(চলবে)